শতবাধা পেরিয়ে ভ্রমণের ঝুলি কাঁধে ঝুলিয়ে রাস্তায় নামি। জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, শেষ হিসাব না মিলায় কষ্ট যখন নীল জামা পরায় আমি তখন ভ্রমণে যাই। চাঁদের দেশের গাড়িতে চেপে বসে রওনা। সকালের নাস্তা করার পর গান পেয়ে বসে আমাদের। আমাদের মানে আমাদের সকলের, এমনকি ছোট্ট আয়ানেরও। সব গানের কথা মনে মনে রাখা অপু, সাথিপা আর লাবনী। আর আমার শুধু গানের লাইন ভুলো মন। এত সুর,এত প্রেম নিয়ে ইট-পাথরের শহরে শীতনিদ্রায় থাকি। ভ্রমণে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠি। পাহাড়ের গায়ে তখন আগুনের হলকা। পুড়ছে সবুজ গাছ গুল্ম। পুড়ছে প্রজাপতি আর বুনো ব্যাঙ। ধোওয়ায় গাছদের হাঁচি কাশি। পুড়ুক,পুড়ে নতুন জমি হবে। ফলবে ফসল, জুমচাষে। পুড়েই তো সোনা খাঁটি হয়।
হয় নাকি? তবে সোনামাটি পুড়ে যে ইট হয়, তারপর শহরের দেয়ালে আটকা পড়ে সিমেন্টের জালে। তার কি ভালো লাগে? কান্না পায় না মাটির কথা ভেবে? চাঁদের গাড়ির গতির কাছে হার মানে উঁচু নিচু পথ। দমবন্ধ করে সবুজ দেখি। যেতে হয় দলবেঁধে তারাদের মতো। সব চাঁদের গাড়ি নিয়ে যায় সেনাবাহিনী। সাজেকের শেষ বাড়ির কাছে যাওয়ার ইচ্ছে দমন করে উঠে পড়ি কাঠের রিসোর্টে। রহস্য উপন্যাসের মতো কাঠের সিড়ি বেয়ে পৌঁছে যাই কাঙ্খিত ঘরে। যে ঘর ছাড়লাম আবার সেই ঘরেই মাথা ঠুকি। মানুষ তবে এমনই। হেথা নয়,হোথা নয়, অন্যকোথা। আসলে কোথায় যায় মানুষ? যাক গে যার যেখানে খুশি। আমরা আপাতত রুইলুই পাড়ায় দার্জিলিং হোটেলে। আমার কাছে হোটেল মানে বারান্দা। বারান্দায় বুদ্ধের মতো বসে ধ্যান। মনে কত হাবিজাবি কথা। দুপুরের পিঠে পিঠ রাখে স্বর্ণালি বিকেল। আমাদের চাঁদের গাড়ি উড়ে চলে হেলিপোর্টে। উঁচুতে উঠলে মন নরম হয়। বিশালতার কাছে হামাগুড়ি দিয়ে চলি। নিচে তাকাই গভীর খাদ। হাত বাড়িয়ে ডাকছে। লাফিয়ে পড়তে মন চায়। নিজেকে সামলে নেই লাবনী আর আয়ানের উচ্ছ্বাস দেখে। সব মুহুর্ত সে ধরতে চায় স্বার্থপরের মতো। ওগো মেয়ে সবকিছু ধরা যায় না,অনুভব করতে হয়।একদিন তুমি ঠিক বুঝবে। বুঝবে সব থেকেও কেন মানুষ ভুতে পেয়ে অশ্বত্থের গাছে ঝুলে পড়ে। নিচে কোলাহল। স্থানীয়রা পশরা সাজিয়ে বসে আছে। তেঁতুল চা, লাল চা, চপ, পেঁপে, কলা নিয়ে। আমি চোখ বন্ধ করে ধুলোর গন্ধ নিই। ধুতি পরে খালি পায়ে আমি হাটে ঘুরছি। কিনছি লবন, চাল, তেল আর প্রেমিকার জন্য কাঁচের কালো চুড়ি। সম্বিত ফিরে পাই বন্ধুর ডাকে। ছবি তুলতে হবে জিরো পয়েন্ট সাজেকের। স্মৃতি করে রাখতে। আমি তো তোমাকে মনে রাখবো, তুমি কি আমায় মনে রাখবে প্রিয়তমা সাজেক?
হোটেলের নাম পেদা টিং টিং। হেসে নিলাম একটু। কী নামরে বাবা! আগে অর্ডার না করলে খাবার নাই। চাকমা শব্দগুচ্ছ পেদা টিং টিং মানে হলো পেট টান টান।
মানে পেটপুরে খাওয়ার পর পেটের যে অবস্থা হয় তাই পেদা টিং টিং। পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে ঝুম করে। ইতিউতি হাঁটি। এ দোকানে ও দোকানে। আদিবাসী নারী বাঁশের হুক্কায় লম্বা টান দেওয়া দেখে বড় সাধ জাগে একবার আমিও টানি। দমকা কাশিতে সে শখ নিভে যায়। নারীর মুখের দিকে তাকাই আড়চোখো, না বাবা হাসছে না। সহযাত্রীরা হাসলেও তার মুখ পাথর কঠিন। পরে বুঝলাম তারা আবেগ প্রকাশে বড্ড হিসেবি। খাবার কষ্ট পানির কষ্ট কি তাদের হিসেবি করেছে? জানি না। কিচ্ছু জানি না। না জেনেই তো এ জীবন চলে গেল।
আসলেই কি সব জানা যায় এই ছোট্ট জীবনে? বিকট একটা শব্দ হুক্কু, হুক্কু কানে আসে। সম্পূর্ণ অচেনা শব্দ। হেসে নিই আবারও এক চোট। কবি সোহাগ আর অপু শব্দটার ডাক নকল করে ডাক দেয়। শব্দটা করছে পাহাড়ি গিরগিটি। কুমিরের বাচ্চার সাইজের এমন গিরগিটি দর্শন প্রথম টিকটিকি দেখলে গা শিরশির করে আমার, এই হোৎকা গিরগিটি দেখে গা ঝমঝম করা শুরু হলো। রাত ছুটে চলছে সময় রথে আমরা রেষ্টুরেন্টের ভিতর বারান্দায়, ওপরে খোলা আকাশে তারার সামিয়ানা। কবিতা পেয়ে বসে সকলকে। আমি পাঠ করলাম ইমতিয়াজ মাহমুদের ‘হারুন’। কবি মজনুর রহমান পড়ে শোনাল তানিম কবিরের ‘পৃথিবীর বুকে’।
কে কবে কোথায় চলে যাব। দূর তাঁরারা কি মনে রাখবে এ কবিতারাতের কথা?
ঘর থেকে ঘরেই ফিরি। সারাজীবন মানুষ একটা শান্তির কুঠির চায়। দার্জিলিং রিসোর্টে তখন রাতের আমেজ। বারান্দায় বসে পড়ে সাথিপা, লাবনী, অপু, সোহাগ।
কথা ভুলে যাওয়া গানে কন্ঠ সবার। দূরে সাক্ষী নিবিড় বন। পাহাড়ের গায়ে কবরের নীরবতা। মেঘ আসি আসি করেও আসছে না। হয়তো সময়টা মেঘ কাছে আসার না। দূরের বন্ধু বলেছিল, মেঘ এসে চুমু দিবে ঠোঁটে চোখে। আপনি জেগে থাকবেন। প্রেমিকা এসে চলে গেলে আপনার পাপ হবে। রাত গভীর হলে প্রেমিকার মতো বুকে এলিয়ে পড়বে সাদা মেঘ।আমি অপেক্ষা করি। শত লাজ লজ্জা বিসর্জন দিয়ে রাধার জন্য। আসরের লোক সমাগম কমে যায়। পূর্ব আকাশে রঙের আবীর। মেঘ এলো না ঘরে, বুকে শুন্যতা নিয়ে ফিরে আসি ঘরে। বিড়বিড় করে বলি, আমি আবার আসবো, আমি তোমার ঠোটে ছোঁয়াবো আমার ঠোঁট।
কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়, কেমন করে বলি!
জানলার ওপাশে তখনও আলো অপ্রকাশিত। রাঙা আলোয় আলোকিত হবার অপেক্ষায় রাঙামাটি। আমাদের গন্তব্য কাপ্তাই লেক। গোছানো রেস্তোরাঁ অন্নপূর্ণায় সকালের নাস্তা।সাদা ভাতে হলুদ আলপনা আঁকে পাহাড়ি কুমড়ো। তরীর মাঝি ফয়সাল তাড়া দেয় যেতে হবে সূর্যকে ফাঁকি দিয়ে। কাপ্তাই লেকে তখন জীবনের আয়োজন। লেকের পাড়ে আদিবাসী নারীদের স্নানের আয়োজন। লেকের নিঃস্তব্ধতা চিরে এগিয়ে চলছে আমাদের নৌকা। শুধু শব্দটা না থাকলে ধ্যানে বসে যেত ঋষি। জলের দুধারে নজর বিস্তৃত উঁচু পাহাড়। সবুজে সবুজ হয়ে কিসের সাক্ষী হে বৃক্ষ। কত যুগ পার হয়ে এমনি দাঁড়িয়ে তোমার পা ধরে আসে না কেন? আমি মানুষ, একটুতেই ধৈর্যচ্যুতি। মুঠোফোনে ঘনঘন দৃষ্টি। এখানে নীল আকাশ আর মুঠোফোনে দাঁড়িয়ে নেই কোন প্রতীক্ষা। আমার অপেক্ষায় কেউ নেই, এ ভেবে দীর্ঘশ্বাস গোপন করি। ঠিক তখুনি পানি ঘেষে উড়ে আসে পানকৌড়ি। বুকে ভালবাসা নিয়ে নীরব শান্ত সৌম্য প্রেমিক কাপ্তাই লেক। ডুব দেয় প্রেমিক বুকে পানকৌড়ি। ভালবাসায় সিক্ত হয়ে পানকৌড়ির প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি দেখা হয়ে ওঠে না। তরী বয়ে চলে, চলে যাই। আমার জানা হলো না,পানকৌড়ির মুখে রক্ত লেগে ছিল কিনা? না হোক প্রেমিকার মুখে রক্ত না দেখাই ভালো।