রাজিয়া সুলতানা আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক। তিনি সেখানকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে পরিবারসহ বসবাস করছেন এবং সেখানে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের দুঃসহ সময়ে লকডাউনে থাকাকালীন তিনি লিখছেন তাঁর সেইসব অভিজ্ঞতার কথা।
পুরো পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখার আগে করোনা কীভাবে বদলে দিল আমাদের জীবন -আজ সেই বিষয়ে বলব- করোনা তখন প্রথম চীনে, উহানদের ওপর হামলে পড়েছে। তখন প্রথম শুনি ‘কোয়ারেন্টিন’। আহা কি দারুণ শুনতে! কি ফ্যান্সি একটা শব্দ।
লকডাউন শুনেছি বহু আগেই। মাসে একবার দু’বার করে লকডাউনের ড্রিল হয় এখন অ্যামেরিকার স্কুলগুলোতে। স্কুল শুটারদের ঠেকাতে বা পরাস্ত করতে এই মেক বিলিভের দুনিয়ায় আমাদের মানে টিচার আর স্টুডেন্টদের ফিল্মি ফিল্মি অভিনয়- বাস্তবতা।
স্কুলে ইনট্রুডার যদি ঢুকেই পড়ে তাহলে কী করণীয় – এই ভাবনায় ভাবনাগুলো সাজিয়ে বাস্তব একটা চিত্র তুলে ধরা এবং সেইমতন অ্যাকশনে যাওয়া। কিন্তু করোনার থেকে বাঁচতে যে লকডাউন আর স্কুলশুটার এর হাত থেকে বাঁচার জন্য যে লকডাউন -এই দুই লকডাউনের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক সেকথা আমি ভালো করেই জানি।
যখন করোনার মত অভূতপূর্ব বা আনপ্রেসিডেন্টেড কিছু ঘটে যায়, তখন চারটা স্তরে মানুষের হুঁশ হয় বা চারটা স্তরে সে রিঅ্যাক্ট করে -এইটা শিখেছিলাম হেলথ সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ক্লাসগুলো নেয়ার সময়। মনে পড়ে গেল আমাদের সেই প্রফেসরের কথা।
তখন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়ি।
আমার বড়মামা ড. আর কে মোল্লা তখন সেখানে প্রিন্টিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। আরেক বাংলাদেশি প্রফেসর ড. নূরুল আমিন পড়াতেন অ্যাকাউন্টিং বিভাগে। তাঁরই মাধ্যমে পরিচয় ঘটে প্রফেসর ব্র্যায়ান উইলিয়ামসের সঙ্গে।
রেড ইন্ডিয়ান আর আফ্রিকান অ্যামেরিক্যান রক্ত-বীজের মিশ্রণে উৎপন্ন এই মানববৃক্ষ। আমার ডিগ্রির জন্য তাঁর ক্লাসে হেলথ সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বেশ কিছু কোর্স করতে হয়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! নিজ দেশে মৃত্যু লেখা ছিল না তাঁর কপালে।
এক গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডে ছুটি কাটাতে গিয়ে সেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। এইডস বিষয়ে পড়াতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন সেই চারটি স্তরের কথা। অবিশ্বাস্যরকম কিছু যখন ঘটে যায়, তখন প্রথমে মানুষ তা অস্বীকার করে। ভাবে- এ রকম একটা রোগ? নাহ-হতেই পারে না। হি ইজ ইন টোটাল ডিন্যায়াল দেন। ইম্পসিবল! তার এ রোগ হতেই পারে না।
কীভাবে সম্ভব? কীভাবে ঘটে গেছে তা সেই কারণ যখন জানতে পারে- এরপর ধীরে ধীরে সে কনভিন্সড হতে থাকে। ভাবে, রোগটা তার দেহে বাসা বেঁধেছে। সিম্পটম দেখা দিয়েছে। আর অস্বীকার করে লাভ নেই। তখন সে মেনে নেয়।
এরপর চলে ইনফরমেশন সংগ্রহ আর মানসিক প্রস্তুতি। কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, চিকিৎসা কী? এইসব নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে যায়। সবশেষ স্তরে সে চিকিৎসা গ্রহণ করে রোগ থেকে বাঁচার জন্য। করোনার আবির্ভাবে ও আক্রমণে আমরাও একইরকম আচরণ শুরু করে দিই।
অচেনা একটা বীজাণুর প্রকোপে যখন চীনে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে তখনও আমরা প্রতিদিনের স্বাভাবিক নিয়মে চলছিলাম। কেউ বিশ্বাসই করতে পারি নি যে করোনা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
তৃতীয়বিশ্ব, প্রথমবিশ্ব একইরকম আচরণ করতে লাগল। ওদের হয়েছে। আমাদের হবে না। উই অল অয়্যার ইন ডিন্যায়াল। হোয়েন ফাইনালি ইট স্যাংক ইন, তখন দেরি হয়ে গেছে। সাধ্যমত সবই করা হচ্ছে, সময়টা মিস হয়ে গেছে শুধু।
করোনার বিরুদ্ধে শুরু হলো যুদ্ধ ঘোষণা।
কারও কারও রেটোরিক স্পিচের উন্মাদনা আমাদের জন্য হাসির খোরাকও যোগালো। কীরকম যুদ্ধ যে এটা তা মাথায় ঢুকল আরও পরে। আমাদের সো-কল্ড লিডার ট্রাম্পও গায়ের জোরে কথা বলতে লাগলেন।
মানুষের জীবনের চেয়ে দেশের অর্থনীতির ব্যাপারেই দেখা গেল তার যত উদ্বেগ। অনেক বোঝানোর পর তবেই টনক নড়ল তার। হায়! এখন চলছে প্রতীক্ষা। এ যেন কোনও এক গডোর জন্য প্রতীক্ষা আমাদের। ভাগ্যের পরিহাস নাকি কর্মের ফল ভোগ করতে আজ আমাদের এই করুণ, অসহায় পরিণতি! অদ্ভুত এক সময়! উদ্ভট এক অনুভূতি!
We all are waiting for Godot in the weirdest point in time in the hope that something will happen. We want to get this pandemic over with. Thoughts are passing our mind – is it really going to happen, are we going to die? If that happens, happens. Let’s get done with this. Is it going to happen that we will outdo death? Will we? Who knows! A puzzling, weird feeling but we all know how it feels like.
রাজিয়া সুলতানা
কবি, লেখক ও অনুবাদক।
জন্ম গাইবান্ধা জেলার সৈকতপাড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে তিনি অনার্স ডিগ্রি নেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। সেখানে তিনি গণিত ও অন্যান্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনশেষে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। ভালোবেসে ভালো নেই তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন (২০১৫)। দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থের নাম হারপুনে গেঁথেছি চাঁদ (২০১৬) । সম্প্রতি ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ইংরেজিতে অনূদিত বাংলা কবিতার সংকলন পোয়েটিকস অব গ্রীন ডেল্টা য় তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। এছাড়া তার অনূদিত আরও দুটো বই-‘ইশিগুরো তিনটি বড় গল্প’ এবং স্লোভেনীয় কবি গ্লোরজানা ভিবারের নির্বাচিত কবিতাগ্রন্থ In Proximity of Silence এর অনুবাদ ‘নৈ:শব্দ্যের কাছাকাছি’। এই গ্রন্থটি স্লোভেনিয়া থেকে প্রকাশিত হয়।