২০২০ সালের ২৭ মার্চ। ঘরের সামনে একচিলতে উঠোনে বসে আছেন মিনার বসুনীয়া। তখন সূর্য দুপুর ছুঁইছুঁই করছে। মনের ভেতরে এলোমেলো নানা কথা, হৃদয় বিষণ্ণ। নিজেকে বহুবার বিপদে পড়তে দেখেছেন মিনার, কিন্তু প্রিয় পৃথিবীর বিপদ যেন এই প্রথম। ততদিনে করোনা ভাইরাস বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। আতঙ্কে মানুষ দিশেহারা, ঘরবন্দি। জীবনে এই প্রথম দেখছেন ধীরে ধীরে কেমন অচেনা হয়ে উঠছে চিরচেনা শহর, প্রিয় পথ, নগর, বন্দর। এমনকি খুব চেনা মানুষগুলো পর্যন্ত! তারাও কেমন জানি অপরিচিত, অচেনা। পৃথিবী যেন আজ আরও ছোট হয়ে গেছে। মানুষের চোখে মানুষের সন্দেহের দৃষ্টি। এতদিন যাদের সাথে বেরিয়েছেন, কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন, হাত মিলিয়েছেন আজ তাদের আলিঙ্গনে যেতেও ভয় লাগে। ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে আত্মা অজানা আতঙ্কে। অদৃশ্য ভাইরাস মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি করে মানুষকে বানিয়েছে জীবন্ত লাশ।
কবি মিনার বসুনীয়া সেদিন তাকিয়ে ছিলেন উঠানের কোণায় বিদায়ী গাঁদা-ডালিয়া, লিচুর মুকুল, পেয়ারার ফুল, কচি মেহেদিপাতা, নতুন পাতায় ঢাকা মেহগনি-তেজপাতার দিকে। একপাশে লাউয়ের জাংলা। দুটো ডিম নিয়ে বসে থাকা মা ঘুঘু। দুপুর হয়নি তখনও, প্রকৃতির এই সন্তানদের দেখে সেই মুহূর্তেই জন্ম হলো সেই অনন্য সাধারণ কবিতার ‘ঈশ্বর হোক সবার’।
মিনার বসুনীয়া
——————-
তিনি তো তোমাদের একার ঈশ্বর নন।
তিনি হয়তো ডলফিনের আবেদন মঞ্জুর করেছেন-
তিনি হয়তো সাগরের মোনাজাত কবুল করেছেন-
তিনি হয়তো বনের প্রার্থনা মন দিয়ে শুনেছেন-
তিনি হয়তো পাহাড়ের দাবীগুলো যৌক্তিক ভেবেছেন-
তারাও হয়তো টিকে থাকার জন্য দু’হাত বাড়িয়েছিল!
হয়তো তারাও বাঁচতে চেয়ে কেঁদেছিলো রাতের পর রাত-
নইলে আজ আকাশ কেন হবে এতো নীল!
নইলে পাখিরা কেন আজ মুখরিত হবে দূরন্ত কোলাহলে?
তিনি তো মানুষের একার ঈশ্বর নন, আর
পৃথিবীও নয় তোমাদের একার।
……………………………………………
সেই জনপ্রিয় কবিতাটি লেখার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। একটি সফল কবিতার বর্ষপূর্তি!
কবি মিনার বসুনীয়ার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কবিতাটি কী করে এমন ভাইরাল হলো, ছুঁয়ে গেল অজস্র মানুষকে? তিনি জানান, কবিতাটি তিনি ফেসবুকেই লিখেছিলেন। শিরোনাম ছাড়া নিজের মনের ভেতর থেকে আসা কিছু কথা। ভেবেছিলেন অনলি মি করা আছে, পরে ঠিকঠাক করা যাবে। এরপর গোসল, নামাজ ও দুপুরের খাবারের পরে তিনি আরেকবার ফেসবুকে ঢুঁ মারতে যান। গিয়ে মোটামুটি হতবাক হয়ে পড়েন! কবিতা ভুলে ‘পাবলিক’ করা ছিল, আর পাবলিক সেটা লুফে নিয়েছে!
রাত নাগাদ তিনি কবিতার শিরোনাম দিয়ে দেন। ততক্ষণে কবিতাটি শেয়ার হয় পাঁচ শতাধিক বার। প্রচুর রিয়্যাকশন, অজস্র কমেন্ট। সারারাত আসতে থাকে ফোন, মেসেজ! এরমধ্যে মজার আরেকটা ব্যাপার ঘটে। মূল কবিতায় প্রথমে কবির নাম ও শিরোনাম না থাকায় অন্য অনেক ভাইরাল পোস্টের মতো এই কবিতাটিও অনেকের পোস্টে ‘কালেক্টেড বা সংগৃহীত’ হয়ে যায়।
সেই রাতেই কবিতাটি আপলোড করা হয় অনলাইন ম্যাগাজিন পাতাপ্রকাশ ডট কমে।
মিনার বসুনীয়ার পরবর্তী দিনকটা কাটতে থাকে অনেকটা হতবিহ্বল অবস্থায়! প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ কবিতাটি আবৃত্তি করে ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করছেন, কেউ কেউ লিঙ্ক পাঠাচ্ছেন। ঢাকা, কলকাতা, দিল্লি, নিউইয়র্ক সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে সেই কবিতা। আমেরিকান কালচারাল অ্যাকাডেমি কবিতাটি দিয়ে তৈরি করে একটি গীতিনৃত্য।
দু’দিন পরে মিনারকে ফোন করেন লেখক ও প্রথম আলোর উপসম্পাদক আনিসুল হক। অভিনন্দন জানিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিতে চাইলেন। প্রথম আলোর ‘অন্য আলো’ বিভাগে তা প্রকাশও হয়।
মিনার জানান, এ পর্যন্ত কয়েক শত কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে ‘ঈশ্বর হোক সবার’ কবিতার। তবে সবচেয়ে অভিভূত হয়েছেন খ্যাতিমান অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠে কবিতাটির আবৃত্তি শুনে। অনেকটা কাকতালীয়ভাবে এই কবিতাটি সামনে পড়ে আসাদুজ্জামান নূরের। তিনি কবি কামাল চৌধুরীর একটি কবিতায় কণ্ঠ দিতে এক স্টুডিওতে গিয়েছেন। কাজ শেষে বেরোবার মুহূর্তে স্টুডিওর সঞ্জয়’দ্ কবিতাটি দেখান নূরকে। কবিতা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান এবং তাৎক্ষণিক আবৃত্তি করে রেকর্ড করেন। রাতে স্টুডিওর সেই ভদ্রলোকের কাছে এই ঘটনা জানতে পারেন মিনার বসুনীয়া। পরের দিন মিনারকে আরও অভিভূত করে দিয়ে ফোন করেন আসাদুজ্জামান নূর! তিনিও কবিতাটির ভূয়সী প্রশংসা করেন।
কবি মিনার বসুনীয়ার জন্ম ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯, পাইকপাড়া, কুড়িগ্রামে। পেশায় তিনি একটি বেসরকারী হসপিটাল ও একটি নার্সিং ইনস্টিটিউটের পরিচালক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ নেই। একটি ভাঁজপত্র প্রকাশ করেছেন। জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং লিটলম্যাগে কবিতা ছাপা হয়েছে।
আপনার কবিতার বই পাব কবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, পাণ্ডুলিপির অনেক কিছু রেডি। শীঘ্রই হয়তো প্রকাশ হবে বইটি।
কবিতাটির এমন ব্যাপক সাড়ায় এবং স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সব লোকজনের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি অভিভূত। সবার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানান।