মাহবুব উল আলম চৌধুরী ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন সরাসরি ভাষা আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত। এই সময়ে তিনি ‘সীমান্ত’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯৫২ সালে তিনি ছিলেন চট্রগ্রাম প্রাদেশিক ভাষা আন্দোলন কমিটির সদস্য। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে চট্টগ্রাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। মাহবুব উল আলম ছিলেন এই কমিটির আহবায়ক।
২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচী সফল করার জন্য চট্রগ্রামের নেতা-কর্মীরাও ব্যাপকভাবে প্রচার চালিয়েছিলেন শহর ও গ্রামগঞ্জে। নির্ধারিত কর্মসূচীর আগের দিন ২০ ফেব্রুয়ারি কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়েন। জল বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলেন তিনি। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা যে মিছিল বের করেছিল সেই মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হলো।
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলি হয়েছে এ খবর যখন মাহবুব উল আলম শুনলেন তখন তাঁর গায়ে ১০৪ ডিগ্রী জ্বর। সে সময় তাঁর নিজের হাতে কোনো কিছু লেখা সম্ভব ছিল না। পরিচর্যাকারী ননী ধরকে বললেন আমিতো লিখতে পারব না। আমি বলছি তুমি খাতা কলম নাও। কবি বললেন, ননী ধর লিখলেন একুশের প্রথম কবিতা। কবিতাটি হাতের লেখায় ছিলো ১৭ পৃষ্টা। কবিতার শিরোনাম-“কাঁদতে আসিনি,ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি”। কবিতার প্রথম কয়েকটি পংক্তি এরকম- “ওরা চল্লশজন কিংবা আরো বেশী/ যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে-রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়/ ভাষার জন্য/ মাতৃভাষার জন্য-বাংলার জন্য”। কবিতাটি পরবর্তীতে মাহবুব উল আলমের ‘সূর্যাস্তের রক্তরাগ’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ নামে আরও একাধিক কবিতার বই প্রকাশ করা হয়।
এই কবিতা যেদিন লেখা হলো সেদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় নেতা খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস কবিকে দেখতে এসেছিলেন। কবি তখন বেশ অসুস্থ তবুও কবিতাটি পড়ে শোনালেন তাঁকে। ইলিয়াস বললেন, এখনই এ কবিতাটি ছাপতে হবে। পুস্তিকা আকারে প্রকাশের দায়িত্ব নিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। আন্দরকিল্লার কোহিনুর প্রেস থেকে পুস্তিকা আকারে ছাপা হলো একুশের প্রথম কবিতা। এক ফর্মার এই পুস্তিকার প্রথম পৃষ্টায় ছিলো কবিতার শিরোনাম “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি” নিচের দিকে ছিলো কবির নাম মাহবুব উল আলম চৌধুরী। প্রকাশকের নাম ছিলো কামাল উদ্দিন খান এবং মুদ্রাকর প্রেসের ম্যানেজার দবির উদ্দিন আহমদ। শীতের রাতে কম্পোজ ও প্রুফের কাজ যখন প্রায় শেষ সেই সময় পুলিশে হানা দেয় প্রেসে। আঁচ করতে পেরে পালিয়ে যান খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। সাথে নিয়ে যান কম্পোজ ম্যাটার। পুলিশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে কিছু না পেয়ে চলে যায়। পরে একরাতে প্রায় ১৫ হাজার কপি ছাপা হয় এই পুস্তিকা বিতরণ ও বিক্রির জন্য।
ঢাকায় একুশের মিছিলে পুলিশের গুলি ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২৩ ফেব্রুয়ারি সমগ্র চট্টগ্রামে ধর্মঘট পালিত হয়। লাল দিঘির ময়দানে বিকাল তিনটায় সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভায় ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন চট্রগামের তৎকালীন তরুণ প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী চৌধুরী হারুনুর রশীদ। কবিতাটি যখন একজনের মুখ থেকে অন্য জনের মুখে মুখে ঠিক তখনই কবিতাটি নিষিদ্ধ করে সরকার। মাহাবুব উল আলমের নামে হুলিয়া জারি হলো। বোরকা পরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন কবি। আত্মগোপনে ছিলেন নয় মাস। কবিতাটি লুকিয়ে রাখা ছিলো কবির বাড়িতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কবির বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। মাহবুব উল আলমের লেখা একুশের প্রথম কবিতাটিও পুড়ে গেল।
তারপর ১৯৯১ সালে চট্রগাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জহুরুল হক পূর্ণাঙ্গ কবিতাটি উদ্ধার করেন।
[তথ্যসূত্র: তাপস মজুমদার/ইন্টারনেট]
কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি
মাহবুব উল আলম চৌধুরী
ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য—বাংলার জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য
আলাওলের ঐতিহ্য
কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের
সাহিত্য ও কবিতার জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
পলাশপুরের মকবুল আহমদের
পুঁথির জন্য-
রমেশ শীলের গাথার জন্য,
জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে
ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, গজল
নজরুলের “খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার দেশের মাটি।”
এ দুটি লাইনের জন্য
দেশের মাটির জন্য,
রমনার মাঠের সেই মাটিতে
কৃষ্ণচূড়ার অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর
অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত।
রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সেরা কোনো ছেলের বুকের রক্ত।
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের প্রতিটি রক্তকণা
রমনার সবুজ ঘাসের উপর
আগুনের মতো জ্বলছে, জ্বলছে আর জ্বলছে।
এক একটি হীরের টুকরোর মতো
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছেলে চল্লিশটি রত্ন
বেঁচে থাকলে যারা হতো
পাকিস্তানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ
যাদের মধ্যে লিংকন, রকফেলার,
আরাগঁ, আইনস্টাইন আশ্রয় পেয়েছিল
যাদের মধ্যে আশ্রয় পেয়েছিল
শতাব্দীর সভ্যতার
সবচেয়ে প্রগতিশীল কয়েকটি মতবাদ,
সেই চল্লিশটি রত্ন যেখানে প্রাণ দিয়েছে
আমরা সেখানে কাঁদতে আসিনি।
যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে
যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে
আমরা তাদের কাছে
ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ।
আমরা এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।
আমরা জানি ওদের হত্যা করা হয়েছে
নির্দয়ভাবে ওদের গুলি করা হয়েছে
ওদের কারো নাম তোমারই মতো ওসমান
কারো বাবা তোমারই বাবার মতো
হয়তো কেরানি, কিংবা পূর্ব বাংলার
নিভৃত কোনো গাঁয়ে কারো বাবা
মাটির বুক থেকে সোনা ফলায়
হয়তো কারো বাবা কোনো
সরকারি চাকুরে।
তোমারই আমারই মতো
যারা হয়তো আজকেও বেঁচে থাকতে
পারতো,
আমারই মতো তাদের কোনো একজনের
হয়তো বিয়ের দিনটি পর্যন্ত ধার্য হয়ে গিয়েছিল,
তোমারই মতো তাদের কোনো একজন হয়তো
মায়ের সদ্যপ্রাপ্ত চিঠিখানা এসে পড়বার আশায়
টেবিলে রেখে মিছিলে যোগ দিতে গিয়েছিল।
এমন এক একটি মূর্তিমান স্বপ্নকে বুকে চেপে
জালিমের গুলিতে যারা প্রাণ দিল
সেই সব মৃতদের নামে
আমি ফাঁসি দাবি করছি।
যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে তাদের জন্যে
আমি ফাঁসি দাবি করছি
যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্যে
ফাঁসি দাবি করছি
যারা এই মৃতদেহের উপর দিয়ে
ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে
সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে।
আমি তাদের বিচার দেখতে চাই।
খোলা ময়দানে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে
শাস্তিপ্রাপ্তদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায়
আমার দেশের মানুষ দেখতে চায়।
পাকিস্তানের প্রথম শহীদ
এই চল্লিশটি রত্ন,
দেশের চল্লিশ জন সেরা ছেলে
মা, বাবা, নতুন বৌ, আর ছেলে মেয়ে নিয়ে
এই পৃথিবীর কোলে এক একটি
সংসার গড়ে তোলা যাদের
স্বপ্ন ছিল
যাদের স্বপ্ন ছিল আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে
আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার,
যাদের স্বপ্ন ছিল আণবিক শক্তিকে
কী ভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায়
তার সাধনা করার,
যাদের স্বপ্ন ছিল রবীন্দ্রনাথের
‘বাঁশিওয়ালার’ চেয়েও সুন্দর
একটি কবিতা রচনা করার,
সেই সব শহীদ ভাইয়েরা আমার
যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়েছ
সেখানে হাজার বছর পরেও
সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন
মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ।
যদিও অগণন অস্পষ্ট স্বর নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করবে
তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘণ্টা ধ্বনি
প্রতিদিন তোমাদের ঐতিহাসিক মৃত্যুক্ষণ
ঘোষণা করবে।
যদিও ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিপাতে—বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভিত্তি পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে
তবু তোমাদের শহীদ নামের ঔজ্জ্বল্য
কিছুতেই মুছে যাবে না।
খুনি জালিমের নিপীড়নকারী কঠিন হাত
কোনো দিনও চেপে দিতে পারবে না
তোমাদের সেই লক্ষদিনের আশাকে,
যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেব
ন্যায়-নীতির দিন
হে আমার মৃত ভাইরা,
সেই দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকারে
ভেসে আসবে
সেই দিন আমার দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।
চট্টগ্রাম, ১৯৫২
[কবিতার মূল পাঠের বানান অবিকৃত রাখা হয়েছে ]