ডায়াবেটিস একটি হরমোন সংশ্লিষ্ট রোগ। হরমোনটি হলো ইনসুলিন।শরীরে ইনসুলিন তৈরি করার দায়িত্ব অগ্ন্যাশয়ের। কিন্তু কোন কারণে অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে কিংবা শরীর যদি এই তৈরিকৃত ইনসুলিন ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়,তখন রক্তে গ্লুকোজ বা শকর্রার উপস্থিতিজনিত অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। এই অসামঞ্জস্য অবস্থাকেই ডায়াবেটিস বলে।
ডায়াবেটিসের কারণে মানুষের নানা ধরণের জটিলতা সৃষ্টি হয় যেমন হার্টঅ্যাটাক,স্ট্রোক,অন্ধত্ব,কিডনি নষ্ট হওয়া,পায়ে ইনফেকশন ইত্যাদি।
বিজ্ঞাপন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বিশ্বের সর্বাধিক মৃত্যুর জন্য দায়ী রোগগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিসের অবস্থান ছিল ৭ নম্বরে। ২০১৯ সালে সারা পৃথিবীতে ১৫ লক্ষ মানুষ প্রতক্ষ্যভাবে ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যুবরণ করেন।জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)-এর একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ।আইসিডিডিআরবি’র তথ্যমতে, ২০১৫ সালে প্রায় ১ লাখ ২৯ হাজার বাংলাদেশীর মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিস প্রধানত দুই প্রকার, টাইপ-১ ও টাইপ -২ । টাইপ-১ হলো এমন অবস্থা যেখানে অগ্ন্যাশয় একেবারেই ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না।মূলত জেনেটিক কারণে এমনটা হয় ।তাদের ইনসুলিন বা পুরোপুরি ওষুধের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেজন্য সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।
সাধারণত কোন খাবার গ্রহণ করার পর আমাদের শরীর সেই খাদ্যের শর্করাকে ভেঙে গ্লুকোজে রূপান্তরিত করে। ইনসুলিন আমাদের শরীরের কোষগুলোকে এই গ্লুকোজ গ্রহণ করার জন্যে নির্দেশ দেয়। কিন্তু শরীরে যখন ইনসুলিন ঠিকমতো তৈরি হতে পারে না তখন রক্তে গ্লুকোজের পরিমান স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেড়ে যায়। এটাই টাইপ-২ ডায়াবেটিস। বিশ্বের ৯৫% ডায়াবেটিসই এই টাইপ-২ ডায়াবেটিস।ব্যায়াম ও খাদ্যবিধির সাহায্যে একে প্রথমে মোকাবিলা করা হয়।অনেক সময় প্রয়োজন হয় মুখে খাওয়ার ওষুধ, এমনকি ইনসুলিন ইনজেকশন।
বংশগত কারণ ছাড়াও ডায়াবেটিস হওয়ার পেছনে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন অভ্যাস দায়ী। এর মধ্য থেকে খাদ্যাভাস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । যেসব খাদ্যাভাস ডেকে আনতে পারে ডায়াবেটিসঃ
রাতে অধিক খাবার গ্রহণঃ রাতে শরীরের পরিশ্রম কম হয়। কাজেই শক্তির দরকারও কম। কিন্তু আমরা অনেকেই রাতে বেশি পরিমাণ খাবার গ্রহণ করে থাকি। গবেষণা বলছে,রাতে বেশি খাওয়া, খাবার পর পরই ঘুমাতে যাওয়ার ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। ইনসুলিনের মাত্রায় তারতম্য ঘটে।
বিজ্ঞাপন
চিনিযুক্ত পানীয় পানঃ চিনিযুক্ত পানীয় পানে বিশ্বের সর্বত্র মানুষের ওজন বাড়ছে। পানীয়গুলো থেকে যে শক্তি আসে তাতে পুষ্টিমান নাই বললেই চলে,স্বাদ বাড়াতে সুগার জাতীয় পদার্থ বেশি দেওয়া থাকে। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যেতে পারে।
সকালের নাস্তা না খাওয়াঃ সকালের নাস্তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে থাকলে শরীরে একটা অটো রিয়াকশন শুরু হয় যাতে ইনসুলিন এবং গ্লুকোজের মাত্রা বিঘ্নিত হয়।গ্লুকোজ থেকে শক্তি উৎপাদনের জন্য দায়ী বিটা সেলের কার্যকারিতা কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ডায়াবেটিস রোগী সকালের নাস্তা এড়িয়ে যান তাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়।
মাছ কম খাওয়াঃ মাছ প্রোটিনের ভালো উৎস। টুনা, স্যামন,সারডিন প্রভূতি মাছে অনেক বেশি ওমেগা -৩ ফ্যাটি এসিড থাকে, যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। কাজেই সপ্তাহে অন্তত ২ দিন মাছ খেতে হবে।
মধ্যরাতে খাবার গ্রহণঃ অনেকেই মধ্যরাতে ১টি অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করে থাকেন। বৃটিশ জার্নাল অব নিউট্রিশন এর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেসব শ্রমিক রাত জেগে কাজ করেন এবং মধ্যরাতে খাবার গ্রহণ করেন তাদের রক্তে গ্লুকোজ এবং ইনসুলিনের সামঞ্জস্যতা নষ্ট হয়ে যায় এবং তাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্তের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের উপর নির্ভরশীলতাঃ ব্যস্ততা এবং অভ্যাসগত কারণে আমরা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণের ফলে শরীর দ্রুত সুগার পাচ্ছে। এতে গ্লুকোজ এবং ইনসুলিনের পরিমানের অসাঞ্জস্যতা তৈরি হচ্ছে। মসৃণ সাদা আটার পরিবর্তে খেতে হবে ভুসিওয়ালা আটা। জাঙ্ক ফুড গ্রহণের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
মাখন এবং তেলের যথেচ্ছ ব্যবহারঃ মাখন এবং অন্যান্য স্যাচুরেটেড ফ্যাট ইনসুলিন প্রতিরোধী যা টাইপ-২ ডায়াবেটিস তৈরি করতে পারে। তেলে শক্তি বেশি সঞ্চিত থাকে। কাজেই বেশি মাত্রায় তেল ব্যবহার ক্ষতির কারণ হতে পারে।মাছের তেল,এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ ওয়েল,ভেজিটেবল ওয়েল বিকল্প হতে পারে।
পানি কম খাওয়াঃ শরীরবৃত্তীয় কাজের জন্য পানি গুরুত্বপূর্ণ। যকৃত এবং বৃক্ক থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে পানি অতীব প্রয়োজনীয়। শরীরের কোষগুলো যদি শুষ্ক থাকে,তবে কোষগুলোর কার্যকারিতা কমে যায়।এতে শরীরে গ্লুকোজ বেড়ে যেতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে,প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ গ্লাস পানি পানে হাইপারগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি ২১% কমানো যেতে পারে।
শাক-সবজি কম খাওয়াঃ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে হলে স্টার্চি শর্করা বাদ দিয়ে সবুজ এবং পাতাওয়ালা শাক সবজি যেমন পালং শাক, ফুলকপি,স্কোয়াশ,টমেটো প্রভূতি খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। শাক-সবজিতে অধিক ফাইবার থাকে যা অধিক খাদ্যগ্রহণ থেকে রক্ষা করে।ডায়াবেটিস প্রতিরোধে শাক-সবজির ভূমিকা অপরিসীম। সেই সাথে সতেজ ও ধূসর রঙের ফলমূল খেতে হবে।
প্লাস্টিকের কনটেইনারে খাদ্য গরম করাঃ প্লাস্টিকের কনটেইনারে খাদ্য রেখে তা আবার অনেকেই মাইক্রোওভেনে গরম করে খান। এতে করে প্লাস্টিকের বিভিন্ন উপাদান খাদ্যে মিশে যেতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, এই রাসায়নিকগুলো শিশু ও তরুণদের ডায়াবেটিসে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেননা এই রাসায়নিকগুলো ইনসুলিন প্রতিরোধী এবং তা উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়,সেই সাথে ডায়াবেটিসেরও।
মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
এমএসসি,পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।