এক. কানে ছোলা বুট ঢুকানো:
আমাদের অনেকের জীবনের শৈশবটা দুষ্টুমিতে ভরা। আমার শৈশব কেটেছে অতি শান্ত ভদ্র ছেলে হিসেবে। আব্বা ছিলো অনেক রাগী। তখন আমরা দুই বোন আর আমি। তাই ভিতরে ভিতরে দুষ্ট মিষ্ট ভরা থাকলেও প্রকাশ হতো না বললেই চলে। আমার বয়স তখন তিন কিংবা চার। রমজান মাসের ইফতারে প্রতিদিন থাকত ছোলা। একদিন আমার মেজ বোন আর আমি শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছোলা ঢুকানোর খেলায় মেতে ছিলাম।
আমার বোন কানে ঢুকিয়ে বের করতে পারলেও আমি পারলাম না। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। ছোলা কানের পানি পেয়ে বড় হওয়ায় আর বের করতে পারছিলাম না। কানে ব্যাথা-বেদনা শুরু হওয়ায় বাবা-মাকে জানাতে বাধ্য হলাম। বাবা মায়ের টেনশনে সেকি অবস্থা। কানে বেশ কিছুক্ষণ ঢুকে থাকার কারণে কানের ভিতরে ধীরে ধীরে ফুলে আরো বড় হয়ে উঠেছিলো ছোলা। ব্যথাও বাড়ছিল। অনেক চেষ্টার পরও বের করতে পারায় হাসপাতালে নিয়ে অজ্ঞান করে ছোলা বের করেছিলো ডাক্তার। সামান্য বড় হয়ে শুনেছিলাম সেই তুলকালাম ঘটনা। আশ্চর্য বিষয় হলো আমার ছেলে এইরকমই ঘটনা ঘটালো। তবে আমার মতো ছোলা ঢুকায়নি। কানে ঢুকিয়েছিলো একটি পুথি। ভয় উৎকন্ঠা নিয়ে চিমটা দিয়ে বের করতে সক্ষম হয়েছি। ছেলে ফারিহান খুব সামান্যই ব্যাথা পেয়েছে। মহান আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন বড় দূর্ঘটনা থেকে। আলহামদুলিল্লাহ।
দুই. হারিয়ে যাওয়ার গল্প:
এবার বলি শৈশবে আমার হারিয়ে যাওয়ার গল্প। আমার বয়স তখন দুই কি তিন। আমরা সবে মাত্র তাজহাটের বাসায় উঠেছি। একদিন এক লোকের পিছনে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুদূর চলে গিয়েছিলাম। তখন এলাকায় বাড়িঘর ছিলো খুবই কম। আমাকে এক মহিলা পেয়ে চিনে ফেলে এবং বাসায় পৌঁছে দেয়। আব্বা নাকি শার্ট প্যান্ট পড়ে মোটরসাইকেল বের করছিল আমাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে। তাতেই বোঝা যাচ্ছিল আমাকে হারানো নিয়ে বাসায় বেশ হৈচৈ হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার মেয়েও ছোট বেলায় এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিল। হয়তো পৃথিবীতে কিছু ঘটনা এভাবেই ঘুরে ফিরে আসে। আমাদের মেয়ে আসফি হারিয়ে যাওয়ার সময় বয়স ছিলো দুই/তিন বছর। তখন শাড়ি পড়া মহিলা দেখলেই তাকে মা করে ডাকত। যেমন আসফির মায়ের স্কুলের সব ম্যাডামসহ তার নানি, খালাকেও মা বলেই ডাকত। যদিও সেই মা ডাকা অতি অল্পদিন স্থায়ী ছিল।
একদিন বাসায় আসা এক শাড়ি পড়া মহিলার পিছে পিছে আসফি অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। সেই মহিলা অবশ্য খেয়ালই করেনি। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর সেই মহিলাকে হারিয়ে ফেলে আসফি। একা হয়ে যাওয়ায় এক বাসার সামনে কান্না করতে থাকে। কান্না করার সময় সেই বাসার এক মহিলা সেটা খেয়াল করে, আর বুঝতে পারে এটা মিলন ভাইয়ের মেয়ে। দ্রুততার সাথে সেই বাড়ির বউ মা আমাদের বাসায় দিয়ে যায়। মজার ব্যপার হচ্ছে আমি যখন ছোট বেলায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমি যখন হারিয়ে গিয়েছিলাম তখন সেই বাড়ির বউ আমাকে একই ভাবে পেয়ে আমাকে বাসায় দিয়ে গিয়েছিল। আমার মেয়েকে বাড়িতে পৌঁছে দেয় সেই বউ এর ছেলের বউ।
আরও কাকতালীয় ঘটনা হলো আসফির মাও হারিয়ে গিয়েছিল ছোট বেলায়। তবে আসফির মায়ের হারিয়ে যাওয়ার গল্প অনেক বেদনাময়। আসফির মায়ের নামটা জানিয়ে রাখলে গল্প বলতে সুবিধা হবে। নাম সুচনা। সুচনার বয়স তখন দুই আড়াই বছর হবে। ওরা তখন নাটোর জেলায় পুলিশ কোয়ার্টারে থাকত। একদিন সুচনারা নানা ওদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল। কয়েকদিন থাকার পর সকালের দিকে কুড়িগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সবারই মন খারাপ সুচনার মা তার বাবাকে বিদায় দিয়ে সুচনার ছোট বোনকে নিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। আর এদিকে সুচনা নানার পিছু নেয়। কিন্তু নানা খেয়াল করে না। একসময় কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে যায় সে। পাহারারত সিপাইও খেয়াল করে না।
একা একা এক কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে গ্রামে ঢুকে যায়। এক স্কুল ছাত্র তাকে রাস্তায় কান্না করতে দেখে জিজ্ঞেস করেও বাবা মায়ের নাম বলতে পারে না। সে সুচনাকে বাসায় নিয়ে যায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরু হয়। এক মেয়ে পাওয়া গেছে এই খবর আসে পাশে ছড়িয়ে যায়।
সেই গ্রামে পুলিশের এক কনস্টেবল দুপুরে খেতে এসেছিলেন বাসায়। তার কানেও চলে আসে খবরটা। তিনি দ্রুত যান সেই ছেলের বাসায়। থানায় হৈ চৈ উঠেছে দারোগা স্যারের মেয়ে হারিয়েছে।
তিনি সুচনাকে দেখেই চিনতে পারেন যে এটি ফজল দারোগার মেয়ে। আমার শশুরের বাবার নাম আবুল ফজল।সেই কনস্টেবল সাথে সাথে তার স্যারের মেয়েকে নিয়ে কোয়ার্টারে বুঝিয়ে দেয়। এদিকে বড় মেয়েকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে আসফির নানি অজ্ঞান প্রায়। সেই কনস্টেবল বড় মেয়ে সুচনাকে বুঝিয়ে দিয়ে আরেক নতুন পৃথিবী ফিরে পেয়েছিল ওরা। আরও অতি আশ্চর্যজনক হলো আমাদের ছেলেও ছোট বেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। ওদের মা ও খালার সাথে মার্কেটে শপিং করার সময় হঠাৎ খুঁজে পাচ্ছিল না ফারিহানকে। আশেপাশে খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল এক লোকের কোলে। এভাবে শৈশব গুলো আনন্দ বেদনার মিশ্রিত হয়ে বেড়ে উঠি আমরা। বড় হলেই শৈশবের ঘটনাগুলো দিয়ে গল্প তৈরি হয়।