ঘড়িরকাটা এখন চারটা ছুঁয়েছে। বিকেল চারটা। চারটার সময়তো বিকেলই হয়। বাড়িতে আমি একা। আব্বা কোথায় গেছে জানিনা। ভুলু মিয়া ফুল গাছে পানি ঢালছে। চারপাশের কোনো ব্যাপারে তার কোন ভাবনা নেই। চিন্তা চেতনাও নেই। এইটাই বোধহয় জীবন। এই লোকটার জীবন নিয়ে একটা গল্প লিখতে হবে। গল্পের নাম হবে -“ভুলু মিয়ার জীবন “।
সাইকেলের বেল বাজার শব্দ পেলাম। সাঈদ আংকেল। পোষ্টাপিসের পিয়ন। পৃথিবীতে যে ক’জন মানুষের হাসি আমার কাছে দারুন রহস্যময় মনে হয় সাঈদ আংকেল তাদের মধ্যে একজন। উনি একেক সময় একেক রকম করে হাসেন। আমার মনে হয় ভদ্রলোক তার একেকটা হাসিতে একেকটা কথা লুকিয়ে রাখেন। যে কথা কেউ বুঝতে পারেনা। আমি বোঝার চেষ্টা করছি। উনার আগমনের কারন কি? বুঝতে পারছিনা।
“আংকেল, ভালো আছেন?”
আংকেল কিছু বললেন না, শুধু একটা হাসি দিলেন।শব্দহীন হাসি। এই হাসির মানে হচ্ছে -“ওই আর কি। ”
সাঈদ আংকেল তার সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলানো কালো ব্যাগের জিপার খুলে একটা খাম বের করলেন। হলুদ খাম। খামটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ”তোমার চিঠি। ” খামটা হাতে নিয়ে খামের উপরে লেখা দেখলাম পরিচিত হাতের লেখা। খামের ডানদিকে সুন্দর করে লেখা-
প্রাপক
শিমুল বাছের
c/o : শহীদুল্লাহ বাছের
ঈদগাহ আবাসিক এলাকা,
দিনাজপুর।
খামের বামদিকে লেখা-
প্রেরক
বিজলী খালা
রংপুর।
আমি খাম খুলে চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। বিজলী খালার চিঠি। খালা লিখেছে-
শিমু,
অনেক দিন তোর কোন খবর নেই। খবর নেয়ার কোন উপায়ও নেই। এই যুগেও তোর ক্ষেত্রে আমি কত অসহায়! বাদাম ওয়ালা, রিকশা ওয়ালা সবার হাতে মোবাইল, তোর হাতে নেই! আজিব! অনেক কষ্টে তোর ঠিকানা পেয়েছি। তোর সাথে কথা আছে। দুইটা ঝাড়ু কিনে রেখেছি তোকে জাতে তোলার জন্য ; আয়, দেখাবো মজা।
ইতি
বিজলী খালা
রংপুর।
মায়ের মৃত্যুর পর যে ক ‘জন মানুষ আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে না দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন বিজলী খালা তাদের মধ্যে একজন। মা মারা যাওয়ার পর আমার প্রায় প্রত্যেকটি দিন, প্রত্যেকটি সময়ের খবর রাখতেন তিনি। একটা সময়ে এসে মায়ের অভাবটা ভুলেও গেছি। আগের মত মায়ের জন্য হাউ মাউ করে কাদিনা, দরজা বন্ধ করে ঘন্টার পর ঘন্টা চুপচাপ বসেও থাকিনা। বয়সের কারনে কিনা জানিনা। মা যখন মারা যায় আমার বয়স তখন ষোল, এখন পচিঁশ। নয়টা বছর মাকে ছাড়া কিভাবে কাটালাম সেটাও এক রহস্য!
ভুলু মিয়া ফুল গাছে পানি ঢালা বন্ধ করেছে। মধ্য বয়স্ক লোক। বাসার কাজের জন্য আমদানি করা। কাজ বলতে ওই দু ‘বেলা রান্না বান্না আর মাঝে মাঝে বাজার টাজার করা। বাজার বলতে ওই শাকসবজি। বাসার কাজ কর্ম আর রান্না বান্নার জন্য আব্বা এই মধ্য বয়স্ক লোকটাকে কেন সিলেক্ট করেছে সেটাও এক রহস্য!
ভুলু মিয়া তার ঘাড়ে ঝুলানো গামছা দিয়ে চোখ মুখ মুছতে মুছতে আমার দিকে আসছে। তার এই চোখ মুখ মোছার ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত! চোখ মুখ মোছার সময় সে তার মুখটাকে এমন ভাবে বাঁকায় যেন কারো মরার খবর পেয়েছে। চিৎকার করে কাঁদতে না পেরে গুমরে গুমরে কাঁদছে -এমন অবস্থা।
“ভাইজান, পত্তর আইছে? ” পত্তর মানে-“পত্র “।
“হুম! ”
“আপনের? ”
“হু। ”
“কইতাছি কার পত্তর? ”
আমি কিছু বললাম না। ভুলু মিয়ার তৃতীয় প্রশ্নের জবাব দেয়া মানে বিপদ। আর্থিক বিপদ। তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর যাই হোক শোনার পর বলবে, “দশটা টাক দিবেন, চা খামু! ”
ভুলু মিয়া তার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর পেতে আবার বলল – “ভাইজান কইলেন না কার পত্তর? ”
আমি ভুলু মিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। পকেট থেকে দশ টাকার একটা চকচকে নোট বের করলাম। ভেবেছিলাম চকচকে দশ টাকার নোটটা দেখে ভুলু মিয়ার মুখটা চকচকে হয়ে যাবে। তা হলোনা। আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে লোকটা। মনে হচ্ছে ভড়কে গেছে। তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর ছাড়া, চাওয়ার আগেই আমি তাকে চকচকে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে দেব সেটা বোধয় ভুলু মিয়ার চিন্তার মধ্যে ছিলনা।
বাসা থেকে বেড়িয়ে অল্প বয়সের একজন বাদামওয়ালাকে দেখতে পেলাম। মতি’র পুকুরের ধারে বড়ই গাছের নিচে দাড়িয়ে বাদাম বেচছে। মাঝে মাঝে বিশেষ সুরে হাক মারছে-“ওই বেদেম। ওই টিপাটিপি। ”
আমি পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করলাম। বাদাম ওয়ালাকে মোটা গলায় বললাম, “ওই,বাদাম টাটকা? ”
“হ, টাটকা।
“আজকের ভাজা? ”
“না, ভাজছি কাইল। টাটকাই আছে। ”
“মচমচে হবে? ”
বাদাম ওয়ালা এবার কিছু বললো না। আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকালো। কি কারনে কে জানে!
“পাঁচ টাকার বাদাম দাও। টাটকা দেখে দিও। ”
ছেলেটা আমার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে লুঙ্গির ভাঁজ থেকে মোবাইল বের করে কার সাথে যেন কথা বলা শুরু করল। আমি ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলাম তাঁর কথা শেষ হওয়ার জন্য । বাদাম ওয়ালার কথা শেষ হলোনা। পাঁচ টাকার বাদাম ক্রেতাকে বোধয় তার ঠিকঠাক পছন্দ হয়নি।
বিজলী খালা ঠিক বলেছে। বাদাম ওয়ালা, রিকশা ওয়ালা সবার হাতে মোবাইল ,আমার হাতে নেই। এটা খুব খারাপ কথা। এতদিন খালার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখাও ঠিক হয়নি। খালার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। খালা আমাকে জাতে তোলার জন্য দুইটা ঝাড়ু কিনে রেখেছে , ঝাড়ু দুটা দেখতে হবে। আব্বাকে বলতে হবে আমার জন্য একটা মোবাইল কিনতে। দামি মোবাইল, একেবারে লেটেষ্ট!
মনি’র দোকানে আব্বাকে পাওয়া গেলনা। এই সময় এখানে বসে চা সিগারেট খাওয়ার কথা। প্রতিদিন রুটিন মাফিক এই সময় আব্বা লুঙ্গি পান্জাবী পরে মনি মিয়ার দোকানে আসে। মনি’র দোকানের সামনে পাতা বেন্ঞে বসতে বসতে বলবে, “কি খবর মনি মিয়া,সব ঠিক আছেতো? ”
“কুনু খবর নেই ছ্যার,তয় সব ঠিক আছে। ছ্যারে কি চা খাইবেন না ছিগ্রেট?”
“চা সিগারেট পরে। আগে কথা বলি। চা সিগারেট পরে খাওয়া যাবে কিন্তু কথা বলা যাবেনা। বুঝলা?”
“বুঝলাম। ”
“কি বুঝলা? ”
মনি মিয়া কিছু বলেনা। চুপচাপ চায়ের কাপে চামুচের টুংটাং শব্দে চা বানাতে থাকে। উদ্দ্যেশ্য আব্বাকে চুপ রাখা।
আব্বা চুপ থাকেনা। পান্জাবীর পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন ধরায়। সিগারেটে টান দিয়ে মুখে নাঁকে ধোঁয়া ছারতে ছারতে বলে,”মনি মিয়া বল্লেনাতো-কি বুঝলা? ”
মনি মিয়া আঁড় চোখে আব্বার দিকে তাকায়। বলে, “ঐ আপনে একা মানুষ। ম্যাডামতে নাই, একা একাতো কথা কইবার পারেন না! ”
আব্বা এবার কিছু বলেনা। চুপ করে থাকে। আব্বাকে চুপ করানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায়টা মনি মিয়া ভালই জানে। ব্যাটাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। উচ্চ শিক্ষা।
বাসায় ফিরে দেখলাম আব্বা বারান্দায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখ দুটা বন্ধ। কেন? আব্বার ডান হাতের আঙ্গুলে চেপে রাখা জ্বলন্ত সিগারেট থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ড্যামটা আরেকটু হলেই টুপ করে পরে যাবে। ধরানোর পর ওটাতে টান পরেছে বলে মনে হয়না।
”আব্বা-”
আব্বা চোখ খুলল না -বলল,”হুম।”
“শরীর খারাপ? ”
“না। ”
“মন? ”
“না।”
“মনির দোকানে গিয়েছিলে? ”
আব্বা কিছু বলল না। চুপ করে থাকলো।
“গিয়েছিলে মনির দোকানে? ”
“হুম।”
“চা খেয়েছ? ”
“হুম। ”
“গল্প হয়েছে? ”
“হুম। ”
“জমেনি? ”
আব্বা চোখ খুলল। চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে বসতে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছারতে ছারতে বলল, “শিমু,তোর মাকে মনে
আছে?”
“আছেতো, কেন? ”
“এম্নি।”
“এম্নি?”
“তোর মা’র কথা খুব মনে পরছে। ভাবছি একবার রংপুরে যাবো। কবরটা অনেকদিন জিয়ারত করা হয়না। ”
অনেকদিন বাদে আব্বার মুখে মায়ের কথা শুনলাম। মনে হলো দীর্ঘ্যদিন চেপে রাখা একটা কথা খুব কষ্ট করে বলে ফেলেছে। কেন এই চেপে রাখা?
আমার জন্য? হতে পারে।
“শিমু -”
“বলো।”
“যাবি?”
“যাবো। ”
“গুড।”
আব্বা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। বলল-“তোর জন্য একটা জিনিস আছে। তোর ঘরের পড়ার টেবিলে। ”
“কী জিনিস? ”
আব্বা হাসলো। চেনা অথচ অনেক পুরনো। শব্দহীন হাসি। আমার মনে হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাসি এটা ! এমন সুন্দর হাসি আব্বার মুখে সচরাচর দেখা যায়না। কি কারনে সেটাও রহস্য ! হাসিটা মুখে রেখেই বলল-“তোর জিনিস তুই দেখে নে। ”
পড়ার টেবিলের উপর একটা মোবাইল সেট। মস্ত সাইজের ঝকঝকে নতুন একটা মোবাইল। ধবধবে সাদা। তাজমহলের মতো। টেবিলের উপর মোবাইল দিয়ে চেপে রাখা একটা চিরকুট। চিরকুটে লেখা –
শিমু,
একটা মোবাইল পাঠালাম তোর জন্য। সীমকার্ড, ফেসবুক একাউন্ট, ফোনবুকে সেভ করা নাম্বার (মেসেজ অপশনের ইনবক্সে ফেসবুকের ইমেইল ও পাসওয়ার্ড পাবি), কমপ্লিট মোবাইল। কি বলিস? স্যামসাং ব্রান্ডের একেবারে লেটেস্ট ! হাতে পাওয়া মাত্র কল দিবি। মিস্ কল। মিস্ কল দিতে পারিসতো?
ইতি
বিজলী খালা
রংপুর।
মিস কল আর মিস কল থাকলো না। হয়ে গেল মিস্টার কল। রিং হতে না হতেই খালা রিসিভ করে ফেললো।
“হ্যালো, শিমু? ”
“হু। ”
“কলটা রিসিভ করে ফেলেছি। তাড়াহুড়ো, বুঝলি? তাড়াহুড়ো! তাড়াহুড়োয় তোর ফোন রিসিভ করে ফেললাম। ”
“ও। ”
“তো তুই ভাল আছিসতো? তোর আব্বা ভালো? ”
“হু ”
“ফোনটা পছন্দ হয়েছে? তোর আব্বা কোথায়? ”
“হয়েছে। আব্বা টয়লেটে। ”
“টয়লেটে? কি করে? ”
“ওই পায়খানা। ”
“ওয়াক! একি, তোর কথাবার্তা একদম রাবিস হয়ে গেছে দেখি। ডাইরেক্ট পায়খানা ! ওয়াক! পটি বলবি, পটি। ঠিক আছে? ”
“ঠিক আছে। ”
“ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিস? ”
“হু।”
“কি স্ট্যাটাস? ”
“আমার হাতে শাহাজাহান-মমতাজ,
মুঠো বন্দি একটা আস্ত তাজমহল।”
“খালা,পড়োনি তুমি? ”
“নারে, ফেসবুক খুলিনি আজ। ”
“ও।”
“আচ্ছা শোন, তোর আব্বার সাথে কথা হয়েছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আয়। রাখি? ”
“আচ্ছা। ”
টি-সার্ট পড়তে দেখে আব্বা বলল, “কোথায় যাচ্ছিস। ”
“মনি’র দোকানে, চা খাবো। তুমি যাবা? ”
“না, বুকটা ব্যাথা করছে। গ্যাসটিক।”
“ঔষধ খেয়েছ? ”
“খেয়েছি।”
“এবার চা-সিগারেট ছেড়ে দাও। ডাক্তারের নিষেধ আছেতো। ”
“ছেড়ে দেব। ”
“গুড। রংপুর যাচ্ছ কবে? ”
“তোর খালার সাথে কথা হয়েছে? ”
“হয়েছে। কবে যাচ্ছো? ”
“কালকে। সবকিছু গুছিয়ে রাখিস। ”
মনি মিয়া পৃথিবীতে যে ক’জন মানুষকে অতিমাত্রায় ভয় পায়, তাদের মধ্যে আমিও একজন বলে আমার ধারনা। এই ভয়ের পিছনে কারনটা কি-এটা আমার জানা নেই। জানার চেষ্টা করতে হবে।
ইচ্ছে হলেও আজ অবধি মনি’র দোকানের বেন্ঞে আমি বসতে পারিনি। আমার জন্য একটা টুল আছে। আর এফ এল কোম্পানির টুল। দোকানের সামনে দাড়ালেই ওটা আমার জন্য পেতে দেয়া হয়। আমার বসার জন্য মনি মিয়া’র আলাদা ব্যাবস্হা রাখার কারন কি সেটাও এক রহস্য।
মনি মিয়া আমার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে একজনকে চায়ের বদলে পান দিয়ে ফেলেছে। আমি বললাম, “মনি মিয়া, ব্যাপার কি? চায়ের বদলে পান বানায় দিচ্ছ। ঘুম পাইছে? ”
“ব্যাপার কিছুনা। ভিমড়ি খাইছি।”
“ভিমড়ি খেয়েছ খাও। তবে, ভিমড়ি খেয়ে অদব বদল করবা না। ”
“আইচ্ছা। এইবার আপনি কন, কি খাইবেন? চা? ”
“না। ”
“মিষ্টি পান? ”
“না। ”
“তাইলে কি ঠান্ডা খাবেন? ”
“না। সিগারেট দাও। বেনসন সিগারেট। ”
আমি বুঝতে পারছি মনি’র মাথায় বাজ পড়ে গেছে। চোখে মুখে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু কোন প্রশ্ন তার মুখ থেকে বেরুলো না। সম্ভবত সেই সাহস তার নাই। এতগুলো বছরে সে আমাকে মিষ্টি পান খেতে দেখেছে।কিন্তু সিগারেট এই প্রথম। মনি মিয়া সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমি সিগারেট ধরালাম। সিগারেটে টান দিয়ে নাকে মুখে ধোঁয়া ছাড়তে গিয়ে বুঝলাম, সিগারেট টেনে নাকে মুখে ধোঁয়া ছাড়াটাও একটা শিল্প। এই শিল্পের প্রদর্শনী যার তার দ্বারা সম্ভব না।
নিজেকে সামলে নিয়ে গলা মোটা করে বললাম, মনি মিয়া, বেনসন সিগারেটটা খুব হালকা। এরপর থেকে গোল্ডলীফ দিবা। বুঝাইতে পারছি? ”
“পারছেন। ”
“এবার একটা চা দাও। কড়া চা। লিকার কম, দুধ বেশি।”
“আইচ্ছা। ”
সিগারেটের টান কমিয়ে দিয়েছি। হালকা একটা টান মেরে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম, “আব্বা এসেছিল। ”
“হ।”
“গল্প হয়েছে। ”
“হ।”
“জমেছিল? ”
“হ। আপনার আব্বায় যা গল্প কয়, না জমায়া পারে? একেবারে দুধের সরের মত জমছে। ”
“কিন্তু, আমি জানি-গল্প জমেনি। সর জমার আগেই তুমি পানি দিয়ে পাতলা করে দিয়েছ! আর একটা সিগারেট দাও। এবার গোল্ডলীফ দিবা। আর একটা চা বানাও ভাল করে। আগের চা’টা ভাল হয়নি। লিকার পাতলা ছিল। এরকম চা পাবলিকরে খাওয়াইলে দোকান পুকুরে যাবে। বুঝছ? ”
“বুঝছি। সিগারেট হাতে দিয়ে মনি মিয়া বলে, “শিমু ভাই কি আমার সাথে রাগ করছেন। ”
“মনি মিয়া, আমার আব্বা একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক ম্যানেজার। জানো? ”
“জানিতো। কি কন, এইডা না জানার কি আছে?”
“কিছু নেই।”
আমি আবার সিগারেট ধরাই। এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে মনি’র দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলি,
“আমার আব্বা একজন অতি সজ্জন ভদ্রলোক।”
“হ, আপনার আব্বার মত মানুষ হয়না। ”
“মানুষটা তোমার কাছে আসে তোমাকে ভালবেসে গল্প করে নিজর একাকিত্বটা তোমার সাথে ভাগ করতে। তুমি তাকে আমার মৃত্য মায়ের কথা মনে করিয়ে দাও, যাতে তিনি চুপ করে থাকেন। মনি, তুমি কি আমার কথা শুনতে পারছো? ”
“শুনতে পারছি।”
“বুঝতে পারছো? ”
“পারছি।”
“বুঝতে পারলে ভালো, না পাররলে সোজা পুকুরে! ”
মনি অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকি থাকে। আমি সিগারেটে একটা ছোট টান দিয়ে আবার বলতে শুরু করি, “তিনি চুপ থাকেন-কারন আমার মাকে উনি ভীষণ ভালবাসতেন। ভবিষ্যতে এমনটা করবা না। যাতে আমার আব্বা কষ্ট পায়। কারন, আমি আব্বাকে ভীষণ রকম ভালবাসি। মনে থাকবে?
“থাকবে স্যার। ”
আমি গোল্ডলীফ সিগারেটে জীবনের শেষ টানটা দিয়ে উঠে পড়ি মনি’র বিশেষ ব্যাবস্হার আর এফ এল কোম্পানির টুল থেকে। হাটতে শুরু করি ইট বিছানো চিকন রাস্তাটা দিয়ে-বাসার দিকে।
সদ্য প্রাপ্ত স্যামসাং ব্রান্ডের মোবাইলটা বেজে উঠল। “আমারো পরানো যাহা চায়” মধুর রিংটোনে। স্কীনের দিকে তাকালাম। তামিসা। বিজলী খালার মেয়ে। অসম্ভব সুন্দর দুটি চোখের এই মেয়েটার সাথে সবশেষ কথা ও দেখা হয়েছিল নয় বছর আগে। নয় বছরে তার অনেক পরিবর্তন হওয়ার কথা। ওর শরীর থেকে অদ্ভুত রকমের সুন্দর একটা গন্ধ বেরুতো। সেই গন্ধটা কি আজও আছে? আশ্চার্য্য জনক হলেও সত্য, তামিসার শরীরের মিষ্টি গন্ধটা আজও মাঝে মাঝে আমার নাকে আসে। কোত্থেকে কেন আর কিভাবে সেটাও এক রহস্য ! অনেক পারফিউম, আতরের দোকানে সেইরকম আতর কিংবা পারফিউম নাকে লাগিয়ে পরখ করেছি, গন্ধটা মেলেনি। কিছু গন্ধ সম্ভবত একবার নাকে ঢুকে সারা জীবনের সাথে মিশে যায়। ওর সুন্দর দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে এতদিনে ক’টা ছেলের বুকের পাজর ভেঙেছে কে জানে।
আমি মোবাইল রিসিভ করলাম। বললাম, “হ্যালো। ”
“শিমু ভাই? ”
“হুম। ”
“কোথায় আছিসরে? ”
“আগ্রায়। তাজমহল হাতে নিয়ে সেলফি তুলছি, ফেসবুকে আপলোড দেব! ”
“ওই ছোকরা,ফাজলামি করবি না। ফাজিল কোথাকার! সত্যি করে বল কোথায় আছিস? ”
“মতি’র পুকুরের পাড়ে। ”
“মতি? মতি কে? এই বিকেলে পুকুর পাড়ে কি করিস? ”
“সাঁতার কাটবো। আর, মতি হলো ‘নূরবানুর’র ভাই! ”
“নূরবানু? এটা আবার কে? ”
“আমার হবু বউ। নামটা সুন্দর না।”
“না, সুন্দর না। ‘নূর’টা ঠিক আছে -কিন্তু, ‘বানু’টা কেমন জানি!”
“ঠিক আছে, বিয়ের পরে কেটেছেটে ‘নূরী’ বানিয়ে দেব।”
তামিসা কিছু বললো না। চুপ করে থাকলো। আমি বললাম, “হ্যালো তামিসা। ”
“হু।”
“চুপ হয়ে গেলি কেন? ”
“এম্নি। শিমু ভাই, একটা কথা বলব?”
“বল। ”
“সত্যি কি ‘নূরবানু ‘ বলে কেউ আছে? ”
আমি হেসে ফেললাম। বললাম, “না। তেমন কেউই নেই, তোর সাথে মজা করলাম। এবার বল, ফোন করেছিস কেন? ”
“তোকে একটা কথা বলব।”
“কি কথা? ”
“পানের পাতা! ”
“মানে? ”
“মানে তুই বুঝবি না। কোন কালেই বুঝবি না। আর একটা কথা বলি? ”
“বল। ”
“দুটি পাখি এক দেশ, তিন টোক্কায় কথা শেষ। বুঝলি?”
“না। তামিসা, তুই এখনো আগের মত আছিস। আমার মনে হয় পৃথিবীর সব কথা আমি বুঝতে পারি, শুধু তোর কথা ছাড়া। সহজ সরল মানুষ আমি।
সহজ করে বল, ঠিক বুঝে যাবো। ”
“কালকে রংপুর আসছিস? ”
“হুম। ”
“আয়, তোকে নিয়ে চিকলীর পার্কে যাবো। চিকলীর পার্ক চিনিসতো? ”
“চিনি, একবার গেছিলামতো! চাঁরদিকে গাছ, মধ্যিখানে পানি। ‘আম পাতা জোড়া জোড়া’ জাতীয় জায়গা। ”
“হুম, এখন আর গাছ তেমন নাই। ‘জোড়া জোড়া’টা আছে। ”
“তাই?”
“আয়, দেখবি সব। এখানে বসে বাদাম খেতে খেতে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ এবং সরল ভাষায় আমার কথাটা তোকে বলব। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।”
“তবে একটা শর্ত।”
“কি।”
“আমি বাদাম ছোলাতে পারবোনা। তুই আমাকে বাদাম ছুলে দিবি আর আমি বাদাম খেতে তোর সাথে কথা বলব। আচ্ছা? ”
“আচ্ছা। ”
লাইন কেটে গেল।
বাসার সামনে এসে চমকে গেলাম। এত লোক কেন? ভুলু মিয়া বারান্দার মেঝেতে বসে হেচলি তুলে কাঁদছে আর কাঁধে ঝুলানো গামছা দিয়ে চোখ মুছছে। আমাকে দেখে তার কাঁন্না বেড়ে গেল। আমার বুকের ভিতরটা ধক্ করে উঠল। মানুষের ভীড় ঠেলে বাসার ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। পারলাম না। কেউ একজন আমাকে ধরে ফেলল। বলল, “বাবা, এখন ভিতরে যেওনা। একটু শান্ত হও। এইযে চেয়ারটায় বসো।”
কেউ একজন আব্বার রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তার চোখে পানি! কেন ? বাসার সামনে জড়ো হওয়া মানুষগুলো ক্রমশই ঝাপসা হতে থাকে। শুনতে পেলাম-কেউ একজন বলল, “আত্বীয়দের খবর দেওয়ার ব্যাবস্হা করেন।” কিসের খবর?
নয় বছর আগে এমনি এক বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে এরকমই এক দৃশ্য দেখেছিলাম বাড়ীর আঙিনায়। পরে বুঝেছিলাম মা মারা গেছে। সেদিন আব্বার বুকে মাথা গুজে কেঁদেছিলাম। সেদিনের সেই দৃশ্যের সাথে আজকের দৃশ্যের একটাই পার্থক্য -সবই আছে আব্বা নেই। কোথায় আব্বা? আব্বার কিছু হয়নিতো? নিজের অজান্তেই কেঁদে উঠলাম হু হু করে।
আকাশের দিকে তাকালাম। বিকেলের পরিচ্ছন্ন নীল আকাশ। বিশাল নীল আকাশে বুকে সাদা সাদা মেঘ উড়ে বেরাচ্ছে। একেক সময় একেক ছবি আঁকার খেলায় মেতেছে মেঘগুলো। এই নীল আকাশের নিচে আমার আর একটা বিশাল আকাশ আছে । সে আকাশে বোধয় সাদা মেঘ হয়ে আর কোনদিনও ওড়া হবেনা আমার।