মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

শিশুদেরও ডায়াবেটিস হয়!

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ

১৪ জুলাই, ২০২১ , ১০:৪০ অপরাহ্ণ

শিশুদেরও ডায়াবেটিস হয়-mugdhota

নীলা, বয়স ১২ বছর। বাবা-মায়ের আদরের সন্তান। থাকে রংপুর শহরে। বাবা-মা চাকরিজীবী। ফ্ল্যাটে বসবাস। স্কুল বন্ধ করোনার কারণে। ঘরে বন্দি তাও তো প্রায় এক বছর হয়ে গেল। নেই স্কুলে যাওয়া, নেই আর মাঠে খেলাধুলা। এখন খেলা বলতে ভিডিও গেমস। পাঁচ তলা থেকে নামা হয়ে ওঠে না। ঘরে বসেই জুমে ক্লাস, বন্ধুদের সাথে খুনসুটি। ফুডপাণ্ডার সুবাদে ঘরে বসেই ফাস্টফুড।

গত কয়েকদিন ধরে নীলার মা লক্ষ্য করলেন নীলার পানির পিপাসা বেড়ে গেছে, সাথে ঘন ঘন প্রস্রাব। প্রথমে নীলার মা খুব একটা গুরুত্ব দেননি, ভেবেছেন গরমকাল তাই হয়তো বেশি বেশি পানি পান করে। আর যেহেতু বেশি বেশি পানি পান করে তাই প্রস্রাবও বেশি করে। কিন্তু কিছুদিন পরেই নীলার কারণে তার মা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কারণ দেখা গেল, নীলা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে, ঘনঘন খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাচ্ছে, তখন নীলার মা শরণাপন্ন হন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে।

বিজ্ঞাপন

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন তারপর তার শারিরীক ও রক্ত পরীক্ষা করার পরে বললেন নীলার ডায়াবেটিস হয়েছে। নীলার বাবা মা চমকে ওঠেন। চমকে ওঠার মতোই কথা বটে।এতদিন তারা শুনে এসেছেন বড়দের ডায়াবেটিস হয় আর এখন শুনছেন ছোটদেরও ডায়াবেটিস হয়

নীলার বাবা অবাক হয়ে জানতে চান, শিশুদেরও ডায়াবেটিস হয় নাকি?

ডাক্তার স্মিত হেসে বললেন, জ্বী শিশুদেরও ডায়াবেটিস হতে পারে। সারাবিশ্বে লক্ষ লক্ষ শিশু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।ন্যাশনাল ডায়াবেটিস স্টাটাস রিপোর্ট ২০২০ এর বরাত মতে খোদ আমেরিকার দুই লক্ষ দশ হাজার শিশু(যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমাদের দেশে এ বিষয়ে ডাটা না থাকলেও এ সংখ্যা এত না হলেও একেবারে যে কমও না তা আন্দাজ করা যায়। শিশুরা সাধারণত টাইপ ১ ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হয়, তারপরও ডায়াবেটিস টাইপ-২ তেও শিশুরা আক্রান্ত হতে পারে। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের মতে প্রতি বছর টাইপ-১ বাড়েছে ১.৮% আর টাইপ-২ বেড়েছে ৪.৮% হারে। নীলার মতো যেসব শিশু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে তারা সারাজীবনই কোনও না কোন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগে থাকে। ঠিক কী কারণে শিশুদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয় তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয় শরীরে রোগ প্রতিরোধের জন্য যে ইম্যুউন সিস্টেম আছে, যাদের প্রধান কাজ শরীরে অনুপ্রবেশকারী ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের সাথে কুস্তি করে তাদের মেরে ফেলে।

অজানা কারণে এই ইম্যুউন সিস্টেম বুমেরাং হয়ে নিজ শরীরে প্যানক্রেজের লেজে যে আইলেটস অব ল্যাঙারহ্যান্স আছে তাকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। এই আইলেটস অব ল্যাঙারহ্যান্স থেকেই তৈরি হয় ইনসুলিন। ইনসুলিনের প্রধান কাজ রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ঠিক রাখা। যেহেতু ইনসুলিন নাই বা পরিমাণে কম তাই রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যায়। আর এই অতিরিক্ত গ্লুকোজের কারণে প্রকাশিত হয় বিভিন্ন শারীরিক লক্ষ্মণ। এ ছাড়াও পরিবারে কারও ডায়াবেটিস থাকলে অথবা শারীরিক পরিশ্রম না করলে, ফাস্টফুড বেশি পরিমাণে খেলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে চারটি বিষয়ের উপর নজর রাখতে হবে –

১.আপনার শিশু কি ঘন ঘন প্রস্রাব করছে?

২ ঘন-ঘন পানি পান করছে ঠিকই কিন্তু পিপাসা মিটছে না।

৩.শিশু কি একটুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে?

৪. বেশি খাবার পরও ওজন কমে যাচ্ছে?

নীলার বাবা-মায়ের হতাশামাখা মুখ দেখে ডাক্তার হাসতে হাসতে বলে এতো ঘাবড়ানোর কিছু নেই, ডায়াবেটিস নির্মূল করা না গেলেও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। বিশ্ব বিখ্যাত পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলোয়াড় ওয়াসিম আকরাম তাঁর ডায়াবেটিস নিয়েও বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চাম্পিয়ান হয়েছিলেন। নিয়মিত শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়মিত পরিমাপ করা এবং অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলা-এইতো। নীলার বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটে উঠলো এমন আশ্বাসের কথায়। চেম্বার থেকে বের হয়ে তারা তিনজন আজ আর রিকসা না নিয়ে হেঁটেহেঁটে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। আজ তারা হেঁটেই বাড়িতে যাবে।

বিজ্ঞাপন

পুনশ্চঃ নীলার মতো এমন অসংখ্য শিশুরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে তবে বড়দের মতো তাদের লক্ষ্মণ প্রকট না হওয়ায় রোগ ধরা পড়তে পড়তে অনেকটা সময় চলে যায় এবং ডায়াবেটিস কিটো এসিডোসিসের মতো জীবন নাশকারী পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। গল্পের ছলে বলা এ কথার শেষে একটু আশার কথা জানিয়ে যাই, বিজ্ঞান থেমে নাই। চলছে গবেষণা। চেষ্টা চলছে কৃত্রিম প্যানক্রিয়াজ বা অগ্নাশয় তৈরির যাতে থাকবে একসাথে গ্লুকোজ মনিটরিং ও ইনসুলিন পাম্প। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনসুলিন রক্তে এসে গ্লুকোজের পরিমানকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। হাসি ফুটে উঠবে নীলাদের মুখে।

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ
Latest posts by ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ (see all)