ধরুন আপনার প্রিয়জনের যক্ষা কিংবা হাম অথবা ডিপথেরিয়া হয়েছে। কেমন লাগবে? আপনি কি ডিপথেরিয়ার কোন রোগীকে কখনও দেখেছেন?
লালনের যে গুটি বসন্ত হলো। সবাই পরিত্যাগ করলো। তারপর ঠাঁই হলো এক মুসলিম পরিবারে। হয়ে উঠলেন লালন।
সেই গুটি বসন্তে আক্রান্ত কোন রোগীকে এ জীবনে দেখেছেন? খাঁচার ভিতর অচিন, পাখি কেমনে আসে যায়৷ বসে ভাবি পাখি কোথা থেকে এসে, কোথা চলে যায়। কখনও কি ভেবেছেন, মরণঘাতী এ রোগগুলো কীভাবে কোথায় চলে গেল? এ মরণব্যধিগুলোকে তাড়িয়েছে টিকার আবিস্কার।
শতশত বছর আগেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সাপের বিষ পান করতো বিষে বিষ ক্ষয় করার জন্য।
টিকার জনক এডওয়ার্ড জেনার প্রথম তের বছর বয়সী এক ছেলের শরীরে গরুর পক্স প্রবেশ করান গুটি বসন্তের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য, সময়টা ছিল ১৭৯৬।
বৈপ্লবিক সূচনা ১৭৯৮ সালে প্রথম গুটি বসন্তের টিকা আবিস্কারের মাধ্যমে। সেই গুটি বসন্ত পৃথিবী থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় ১৯৭৯ সালে। এরপর কত ধরণের টিকা হাম, রুবেলা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ, টিটেনাসকে শিকল পরিয়ে রাখা হয়েছে।
আর এখন করোনার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য গবেষকরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে টিকা আবিস্কারের। বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠান দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। টিকা আবিস্কার সময়ের ব্যাপার। সময় লাগবে এক থেকে দেড় বছর। এতো সময় কই সময় নষ্ট করার?
তাই গবেষকরা করোনা সারানোর দাওয়াই তৈরিতে ব্যস্ত। বেইলর কলেজ অফ মেডিসিন ন্যাশনাল স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিন হাউসটন টেক্সাসের ভাইরোলজিষ্ট প্রফেসর পিটাট জে হর্টজ বলেন, কোভিক-১৯ এর জরুরী চিকিৎসা হিসেবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ব্যক্তির শরীরে যে এন্টিবডি পাওয়া যায় তা করোনায় আক্রান্ত অসুস্থ মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে ফল পাওয়া যেতে পারে।
তাঁর মতে আগামী ছয় মাসের মধ্যে এন্টিভাইরাল ড্রাগ চলে আসবে। পঁচিশ বছর ধরে ইসরায়েলের রিসার্স বিভাগের প্রধান আবু লাফিয়া লাপিত বলেন, ইসরায়েল এরই মধ্যে এগারোটি ওষুধ ট্রায়াল দেবার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছে।
সেসব ওষুধ হয় এককভাবে নয়তো কয়েকটা ওষুধ মিলে ককটেল থেরাপি হিসেবে ব্যবহৃত হবে। তবে তার আগে অনুমোদন নিতে হবে বিজ্ঞানীদের, এফডিএ সহ যারা জড়িত একাজে।
ক্যালিফোর্নিয়ার বায়োটেক কোম্পানি জিলিয়ার্ড সাইন্স পরীক্ষামূলকভাবে এন্টিভাইরাল রেমডিভিসির যা ইবোলায় আক্রান্তদের ব্যবহার করে সফলতা লাভ করেছিল তা করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে করোনায় আক্রান্তদের ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। হয়তো আগামী ছয় মাসের মধ্যেই আমরা করোনার ওষুধ হাতে পেয়ে যাব। থেমে নেই গবেষণা।
রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন আমাদের জন্য গবেষকরা। মানুষের পাশে মানুষ ছাড়া বিপদে আর কেই বা দাঁড়ায় বলেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনারও টিকা তৈরি হবে। তবে কতদিন সময় লাগবে সেটাই হচ্ছে কথা।
মারাত্মক আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আমেরিকার গবেষণাগুলো বলছে, এক বছরের মধ্যে লাখ লাখ টিকার তৈরি হওয়াটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তবে এখানে একটি কোম্পানি মানবদেহে করোনাবিরোধী একটি ভ্যাক্সিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করেছে। তবু এর যাত্রা অনেক লম্বা। আবার যুক্তরাজ্যের গবেষকরাও বলছে মে মাসের মধ্যে নতুন কিছু করা সম্ভব না, যাতে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে।
তবে মুকসাল ইনফেকশনা অ্যান্ড ইমিউনিটি বিভাগের প্রধান ড রবিন শ্যত্তকের নেতৃত্বে যুক্তরাজ্যের গবেষকরা বলছেন, তারা ইঁদুরের শরীরে সফলভাবে করোনার টিকা প্রয়োগ করেছেন এবং আগামী জুনের মধ্যে মানব শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করতে পারবেন।
এদিকে ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের সিনিয়র গবেষক ড পল মিকি বলেন, ‘আমি ভ্যাকসিন প্রয়োগের (ইঁদুরের শরীরে) এক মাস পর ফলাফল পেয়েছি এবং এটি সত্যি দারুণভাবে কাজ করেছে।’
বানরের শরীরে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নির্ধারণের জন্য দলটি প্যারিসের বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করছে বলেও জানান মিকি।
কানাডিয়ান বিজ্ঞানীদের একটি দল সফলভাবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করছে এবং বিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করা করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে তারা কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। খবর নিউইয়র্ক পোস্ট।
কানাডার করোনা আক্রান্ত রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টোর সানিব্রুক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং ম্রাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এ নিয়ে কাজ করছেন।
করোনাভাইরাসের টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে চীনের আটটি প্রতিষ্ঠান পাঁচটি উপায়ে কাজ করছেন বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক পোস্ট। চীনের বিজ্ঞানীদের বরাত দিয়ে এতে বলা হয়, জরুরি পরিস্থিতিতে এবং ক্লিনিকালি আগামী মাসে প্রয়োগ করা হবে।
দ্য ইকনোমিক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের অগ্রগতি নিয়ে কিছু দিনের মধ্যেই ঘোষণা দিতে যাচ্ছে ইসাইলের বিজ্ঞানীরা।
ইসরাইলের গণমাধ্যম হায়ের্টাজের গত বৃহস্পতিবার দেশটির মেডিকেল সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তদারকিতে ইসরাইল ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল রিসার্চ করোনার টিকা আবিষ্কারের পথে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি করেছে।
তবে করোনার এ টিকা মানব শরীরে কার্যকরভাবে প্রয়োগের আগে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। এজন্য কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান জানার অন্যতম ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে শনিবার পর্যন্ত ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৪৩৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৫৯ হাজার ১৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তথ্যসূত্র: জেরুজালেম পোস্ট ও ইউএনবি
ডা. ফেরদৌস রহমান পলাশ
সহযোগী অধ্যাপক
প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর