বাংলা সাহিত্যে আলোচিত, সমালোচিত লেখকের নাম আসলে এসে যায় তাঁর নাম। হালকা, তরুণ-তরুণীদের টার্গেট করে আবেগী ভাষায় লেখা তাঁর উপন্যাসগুলো যতটা না উপন্যাস তার চেয়েও বেশি ছোটগল্প বলে দুর্নাম আছে। তবুও বইমেলায় তাঁর বই বিক্রি হতো হুহু করে। যেখানে অনেক দাপুটে লেখকের বই তিনশত কপি বিক্রি করতে ঘাম ছুটে যেত সেখানে তাঁর বইয়ের সংস্করণ হতো একাদশ, দ্বাদশতম। ভারতীয় উপন্যাসে বুঁদ হয়ে থাকা পাঠক শ্রেণিকে বাংলাদেশের বই পড়তে অভ্যস্ত করলেন তো তিনিই।
আগে মা খালাদের দেখতাম দুপুরবেলা সংসারের সব কাজ শেষ করে নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই হাতে। দেশি বইয়ের বাজার ছিল মন্দা। এক ঝটকায় সে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটান তিনি।
তিনি আর কেউ না, সাহিত্যের বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদ। আগে মনে করা হতো সাহিত্যের ভাষা আর যাপিত জীবনের ভাষা ভিন্ন। কিন্তু উনি সেটাকে পরিবর্তন করতে পেরেছিলেন বলেই ভাইবেরাদার গ্রুপের সৃষ্টি হয়ে মোস্তফা ফারুকীরা অবলীলায় কথ্য ভাষায় সিনেমা করতে পারছেন। অনেক লেখকও উৎসাহিত হয়েছেন সহজ করে লিখতে। হালের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের লেখা পড়লে বুঝাই যায় হুমায়ূন প্রভাবে কতটা প্রভাবিত তিনি। তিনি প্রভাবিত করতে পারতেন বটে। বিষয়টা এমন না যে উনি ভারী কিছু লিখতে পারেন না বলেই হালকা বিষয় নিয়ে লিখেন কিন্তু মনে রাখতে হবে হুমায়ুন রাজশাহী বিভাগ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের শিক্ষক। পিএইচডি করেছিলেন আমেরিকা থেকে। তিনি ইচ্ছে করলে অনেকেই যে ভারী কিছু লিখছি বলে ভাব ধরেন তাদের চেয়েও ভালো লিখতে পারতেন বলে আমার বিশ্বাস। তার প্রমাণ কিন্তু তিনি দিয়েছেন বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী, ছোটদের নিয়ে লেখা, গান, ছবি আঁকা, মুক্তিযুদ্ধ, ভ্রমণকাহিনী নিয়ে লেখা লিখেও। তবে হ্যাঁ তিনি কবিতা লিখেন নাই যদিও তার কাব্য প্রতিভা শুরু হয়েছিল কবিতা দিয়েই। সে সময় তিনি একটা কবিতা লিখেছিলেন অনেকটা এরকম,
“দিতে পারো একশ’ ফানুস এনে , আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই। ”
তো সে কবিতাটা হুমায়ূন আহমেদ নিজের নাম না দিয়ে বোনের নাম দিয়ে চালিয়ে দিয়েছিলেন। কবিতাটা ছাপানো হয়েছিল এবং সম্পাদক চিঠি লিখেছিলেন ধন্যবাদ জানিয়ে। তবে সম্বোধনে ছিল আপা। তারপর থেকে তাঁকে আর কবিতা লিখতে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে তার কোনও দুঃখবোধ ছিলো বলে আমার মনে হয় না। উনি বেঁচেছিলেন রাজার মতো। প্রকাশক-সম্পাদকরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত তাঁর লেখা পাবার জন্য। তিন বছর আগেই অগ্রীম টাকা নিয়ে এখনও কয়জন লিখে? একবার বইমেলার আয়োজক তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান জানান, বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের কত বই বিক্রি হতো তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে ধারণা, গত ২০১১ সালের বইমেলায় প্রায় ৩০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে এবং এর অর্ধেক হুমায়ূন আহমেদের। কখনো কখনো দেখা গেছে যে একটি বইয়ের সব কপি তিন বা চার দিনে বিক্রি হয়ে গেছে এবং মেলার মধ্যেই তিন-চার বার ঐ বই ছাপতে হয়েছে।
সময় প্রকাশনের স্বত্ত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের ৪০টি বই প্রকাশ করেছেন। তাঁর ধারণা, বছরে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের আড়াই লক্ষ কপি বিক্রি হয় এবং এই সংখ্যা বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া মোট বইয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ। হুমায়ূন আহমেদকে কেন কথার জাদুকর বলা হয় তা বোঝা যায় তাঁর লেখা ছোটগল্প পড়লে। নিজে ম্যাজিক জানতেন এবং সেই ম্যাজিক দেখিয়ে লোকজনকে চমকে দিতে ভালবাসতেন। মেধাবী এ লেখক সৃষ্টি করেছেন মিসির আলি, হিমু চরিত্র। কঠিন বিষয়গুলোও লিখে গেছেন নিজের মতো করে,হাস্যরসের মাধ্যমে। তাঁর বই পড়ে মনে হয়, বই পাঠ মানেই এন্টারটেইনমেন্ট, এন্টারটেইনমেন্ট। বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ৭৩। বর্ষা এলেই মনে পরে যায় তাঁকে। লিখেছিলেন বেহেশতে সব আছে নেই শুধু বর্ষাকাল,বেহেশতের আবহাওয়া অনেকটা এয়ারকন্ডিশনে থাকার মতো। বর্ষা আসে যায়, চান্নি পসর রাতে আলোড়িত হয় অনেকেই শুধু তিনি আর ফিরে আসেন না, আসবেনও না কোনোদিন।
মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পরেও সে সমভাবে সমুজ্জ্বল, থাকবেন যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে। জন্মদিনে কথার এই জাদুকরকে জানাই শ্রদ্ধা।