মধ্যবিত্তের চাল-নুন, জামা, জুতা, ঘড়ি, সবকিছু নিয়েই হৃদয়স্পর্শি গল্প আছে। এসব গল্পই হয়ে ওঠে সিনেমা-উপন্যাসের জীবনছোঁয়া উপাখ্যান।
মহান দারিদ্র্য আর নিখাদ ভালবাসার স্বর্ণালী চাদরে ঢাকা সংসারের সুখ দুঃখ এখনও এক অশ্রুসজল অভিব্যক্তির জন্ম দেয়, জেগে ওঠে ভালবাসা ও অনুভূতির হাজার দোয়ার। উচ্চমাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষার আগ পর্যন্ত আমার কোন ঘড়ি ছিলোনা। ক্লাসে দু’একজনের হাতে হাত-ঘড়ি। তখন হাত ঘড়ি মানে বিশাল স্ট্যাটাস।
মনে আছে আব্বার ঘড়ি হাতে দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম।
বড় আপা (বড় বুবু) কেবল প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেয়েছেন। বেতন সাকুল্যে ৯০০ টাকা। পিটিআই ট্রেনিং করছেন ঝিনেদাতে।
আমি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ হোস্টেলে। সামনে টেস্ট পরীক্ষা। আপা চিঠি লিখলেন ঝিনেদা যাওয়ার জন্য।
খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে এক বিকেলে আপার সাথে দেখা করতে গেলাম ঝিনেদা। কত কি যে রান্না করেছেন আপা।
ঝিনেদা থেকে আসার সময় আপা আমার হাতে কিছু টাকা গভীর মমতায় ধরিয়ে দিয়ে আড়ষ্ঠ ও কাঁপা কন্ঠে বললেন ‘ একটা ঘড়ি কিনে নিস’ আর কিছু বলতে পারলেন না, শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলেন।
শেষে শুধু বললেন ‘ভালভাবে পড়াশুনা করিস’।
দারিদ্র্যেরগৌরব আর মধ্যবিত্ত আবেগ মেশানো ছোট ভায়ের জন্য বড় বোনের ভালবাসাটুকু রক্তকনিকায় অদৃশ্য এক তুফান এনে দিলো।
আমি আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম স্বর্গীয় এক অনুভুতিতে।
আপা তার চোখের জল আর নিবিড় আদর দিয়ে দায়িত্ববোধ ও ভালবাসার অনির্বান এক প্রদ্বীপ জ্বেলে দিলেন অন্তরে।
অব্যক্ত এক উচ্ছ্বাস নিয়ে কুষ্টিয়া এসে জীবনের প্রথম ঘড়ি কিনলাম ২৭০ টাকা দিয়ে।
ঘড়িটা পরেছিলাম অনেকদিন।
আমাদের সাত ভাই-বোনের মধ্যে বড় আপা দ্বিতীয়।
মেয়েরা জন্মগতভাবে বোধহয় ধৈর্যশীলা ও মমতাময়ী হয়।
আপা খুব অল্প বয়সেই নিম্ন মধ্যবিত্তের চেতনা ধারণ করে হয়ে উঠলেন ছোট চার ভায়ের জন্য অপরিহার্য একজন।
জোর করে মাথায় তেল দিয়ে দেওয়া, শীতের ধুলা ধুসরিত মুখে, শুষ্ক ঠোটে ক্রিম লাগিয়ে দেওয়া, ময়লা জামা-গেঞ্জি ধুয়ে দেওয়া থেকে কত কীনা করতেন আপা।
দুরন্তপনায় মমতাময়ী বকুনি এখনও কানে বাজে।
একবার তুহিনের সাথে মারামারি ঠেকাতে গিয়ে আপার কপাল কেটে গেলো, রাগ করলেন না আপা।
বোনের সম্ভ্রম-মর্যাদা রক্ষার জন্য সব ভাইই বোধহয় জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত।
১৯৮৫ সাল। আপা দশম শ্রেণিতে। আমি ক্লাস সেভেনে। বখাটের উৎপাতে চরম নিরাপত্তাহীনতা চারিদিকে।
বড় ভাই কুষ্টিয়াতে।
আমিই তখন দুই বোনের পুলিশিং এর দায়িত্বে।
একসাথে স্কুলে যাই। কোথাও বেরুলে আপা আমাকে সঙ্গে নেয়।
বখাটেদের উৎপাত প্রতিহত করার সাহস সঞ্চয় করতে থাকি মনে মনে।
প্রয়াত সাইফুল ভাই ছোট্ট একটা চাকু আর সাইকেলের চেইন দিয়েছিলেন আমাকে নিরাপত্তার জন্য।
কিভাবে চাকু কোমরে লুকিয়ে রাখতে হবে, কিভাবে বখাটেকে চাকু মারতে হবে তাও শিখিয়েছিলেন। খুব গোপনে কোমরে সাইকেলের চেইন বাধা শুরু করেছিলাম।
আপা জানতোনা ছোট্ট জুয়েলের বুকের ভিতর সাহসের এমন বারুদ তৈরি হয়েছে তার সম্ভ্রম-সম্মান রক্ষার জন্য।
সত্যিই সেদিন পণ করেছিলাম আপাকে কেউ কিছু বললে খুন করে ফেলবো চাকু দিয়ে। যাহোক আল্লাহ হেফাজত করেছেন সবাইকে।
আপার বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখলেও হঠাৎ একদিন শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে এসে জানতে পারলাম রাতে আপার বিয়ে।
ছেলে এলাকারই। মংলা পোর্টে চাকরি করে।
আমার বুকের ভিতর সেদিনের হাহাকারের কথা মনে করলে এখনও ধমনীত ঝড় উঠে।
আপা তখন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে।
আব্বা বলতেন বড় ভাই ভাল চাকরি পাবে, আমাদের অভাব দুর হবে। পাকা ঘর হবে। এর পর মহা ধুমধামে আপার বিয়ে হবে।
যাহোক বিকেলে শুরু হয়ে গেলো বিয়ের অস্বচ্ছল কেনাকাটা।
আমি আমার খেলার সাথিদের নিয়ে কলা গাছ সংগ্রহ করে রাতেই বানিয়ে ফেললাম একটা বিয়ের গেট।
রাত দশটার মধ্যেই বিয়ের আনুষ্ঠিকতা শেষ হলো।
আকস্মিক মৃত্যুর মতই আমরা আপাকে আমাদের সংসার থেকে হারিয়ে ফেললাম।
এসএসসিতে ফার্ষ্ট ডিভিশন পাওয়া মেধাবী আপার লেখাপড়া আর এগুলোনা।
বিয়ের পরে অবশ্য আপা উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন।
আপা চলে গেলেন দুলাভায়ের মংলা পোর্টের বাসায়। আমাদের কাছে অনেকটা বহুদুর নির্বাসনের মত।
কিছুদিন পর অবশ্য প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হওয়ার সুবাদে আবার গ্রামে চলে আসলেন।
এর পর থেকে বড় আপা আমাদের এক পরম নির্ভরতার নাম, ভালবাসা আর উৎসাহের নাম।
কত গল্প , কত স্মৃতি আপাকে নিয়ে।
আপাকে না বলে কোন কাজই হয়না আমাদের। আপার সাথে মোবাইলে কথা বলতে হয় হাতে সময় নিয়ে। কথা শেষ হয়না।
আপার নাতি হয়েছে, আমরা দাদু হয়েছি।
সময় বয়ে গেছে বহুদুর।
কিন্তু আমাদের বিনাসুতোর বন্ধনটা অটুট আগের মতই।
সময় হলে হঠাৎ আপার বাসায় যায়, আপা নিবিড় আদরে পাসে দাঁড়িয়ে ডালের বড়ি দিয়ে রান্না করা তরকারি তুলে দিতে দিতে আমার ছোটবেলার দুরন্তপনার দু’একটা গল্পও বলে ফেলেন। ছোটবেলার মত গভীর মমতায় মাথায় হাত রাখেন। আমি নিরবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি বড় বোনের নিখাদ ভালবাসায়।
ধমনীতে বয়ে যাওয়া সহোদর রক্তের অদৃশ্য মিলন, আর মাতৃজঠরের উষ্ণতা অনুভব করি একসাথে, একাকার হয়ে যায় অন্তরের সব কান্না-হাসি , জীবনের সব গান, স্বপ্ন-ভালবাসা….. আজ বড় আপার জন্মদিন। মায়ামমতায় জড়াজড়ি করে কেটে যাক জীবনের প্রতিক্ষণ।
রওশন জামাল জুয়েল
আর্মিডেল,অষ্ট্রেলিয়া।