মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

শুভ জন্মদিন, মাসুদ বশীর

মুগ্ধতা.কম

৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ , ১:২৩ অপরাহ্ণ

শুভ জন্মদিন, মাসুদ বশীর

কবি মাসুদ বশীরের জন্মদিন আজ ৪ সেপ্টেম্বর। জন্মদিনে মুগ্ধতা ডট কমের পক্ষ থেকে কবির জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। জন্মদিনে পড়ুন মাসুদ বশীরের কয়েকটি কবিতা এবং একটি ছোটগল্প। 

মাসুদ বশীরের কবিতা

গগনবিহারী

পৃথিবীটা গদ্যময়। মায়ার সংসারে সকলি ছায়া। যিনি চিরন্তন সত্য তিনিও এর বাইরে নন। তবে, ভালোবাসা অমলিন। ভালোবাসার জন্যেই আজ এতোকিছু- তিনি, আমি, আমরা, ধরীত্রী এবং অসীম কালোগহ্বর….।

.

রাজার সন্ন্যাসব্রত পালন করতে নেই, সিংহাসন উল্টে যাবে, সব লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। শেষতক সৃষ্টির খেলা স্বার্থের ওপিঠে ভালোবাসায় নির্দ্বিধায় স্নান সারে, এখানেই পরম তৃপ্তি ও নির্মল পরিচ্ছন্ন এবং পূতপবিত্র একমাত্র ভালোবাসা। ভালোবাসতে ভালোবাসা- মায়া-টান-স্বার্থ একাকার!

.

তোমার-আমার জন্ম হলো কী করে?

অতএব….

দেবী

তোমার সঙ্গে আমার কথা বলতে বেশ ভালো লাগে,

অথচ?

.

তোমার সঙ্গে আমার কথা বলতে বেশ ভালো লাগে,

অথচ!

.

তোমার সঙ্গে আমার কথা বলতে বেশ ভালো লাগে,

অথচ….

প্রাণবায়ুটার ভেতরে আকাশ ভেঙে পড়লো!(?)

.

কর্দমাক্ত মাটির আদল জুড়ে শিল্পের বিলাস

ছবির গভীরে তোমার মুখাবয়ব।

অথচ,

চোখজোড়া নদী হয়ে গেলো।

বাঁকের পরতে পরতে দ্বিতীয় সত্তার ঊর্ধ্বে উঠতে উঠতে হাওয়ায় ভেতরে বাতাস ঢুকে গেলো…..

নীলাকাশ

মনে করেও করতে পারলাম না। এখানেই মানুষের সীমাবদ্ধতা। মানুষ কী করে চিনি, নিজেকেই নিজে আজও চিনতে পারলাম না যে। আকাশের ওপারে কী আছে, কী ছিলো? কীইবা নেই? জানিনা, বুঝিনা। আমি সীমাবদ্ধ। আমাতে তার বসবাস অথচ তাকেই খুঁজে ফিরি বারংবার!

.

কী আশ্চর্য, তবে পুরোটাই সত্য। সত্যের বাইরে তুমি, তোমার বাইরে সত্য। সত্য কি করে মিথ্যে হলো, হয়? আমাতে তুমি, তোমাতেই আমি। তারপর, আর সে কোথায় লুকালো ঘরের কোনে?

প্রশ্ন ছিলো, চিন্তা ছিলো, কিন্তু তুমি ও সে তোমাদের মাঝে বসে আছে কে?

.

অতঃপর বাকিটা……

লুকোচুরি

দেখা যদি নাই দাও; নাই দিতে চাও,

তবে দেখা দিও না আর কখনোই।

অসম অসার রণে অংশগ্রহণে,

ভীষণ অবান্তর তথ্য-উপাত্তের কী এমন প্রয়োজন আর?

.

তোমার সুতীব্র চুলের ঘ্রাণ বাতাসে ছড়িয়ে আছে,

নীলাকাশে মেঘের পল্লবে দেখে নিয়েছি তোমার নীড়।

প্রখর রোদের শরীরে দেখা হয়ে গেছে তোমার তীব্রতা!

সন্ধ্যাকাশে শুকতারা জ্বলে জোছনা আলো ছড়ায়- সেখানে পেয়ে গেছি তোমার আলোকময় মুখচ্ছবি!

রাত্রি নিশীথে অন্ধকারে দেখলাম তোমার নিটোল পায়ের নিস্তব্ধ নীরবতা।

মিষ্টি ভোরের আলোয় পবিত্র আজানের ধ্বনিতে পাওয়া হয়ে গেছে তোমার শাশ্বত সুন্দর সত্যের অমায়িক-কথন।

.

আর কী চাই বলো? দেখা অদেখায় কীইবা এমন এসে যায় বন্ধু? যেখানে তুমিহীন আমি আর আমিহীন তুমি একাকার হয়ে সাগর ছাড়িয়ে বুকের গহীনে একদম গভীর স্রোতে নিরন্তর বহমান….

.

দেখা হোক বা না হোক ভালোবাসা থাক বা না থাক,

শুধু এতোটুকুই জেনে যাও, জেনো রেখো বন্ধু-

ঘৃণার পরতো কিন্তু তেমন কোনই নিরবিচ্ছিন্ন বিন্দু ছিলোনা….

ক্ষত

থাক না ক্ষত কবি!

সৃষ্টির উপাসনা উল্লসিত হোক….

.

দু মেরুর টান মেঘের গর্জন

বৃষ্টির সৃষ্টি অমায়িক দৃষ্টি!

রিমঝিম চোখের গহীনে উঁকি দিয়ে দেখো-

সেখানে ভালোবাসা নিরন্তর….

সিংহাসন

যে ভুলে যায় তাকে ভুলে যেতে দাও।

ভুলবার পূর্বে কেন ব্যর্থ চেষ্টা করো তুলবার?

ভুলেরা ভুলের মাঝেই লুটোপুটি খেলে খেলুক!

.

ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা?

কে বলেছে ফুল সবটাই যে ভুল।

রাজত্ব কেড়ে রাজা বসেন সিংহাসনে।

সিংহের আসন করেন শাসন সিংহ থাকে বনে।

ভুল রাজার বেজায় বাজার বনবিহারী বন্য কথন-

এককথায় বেহিসাব মেলে লাঠিরবারি অংক খেলে!

ভুলতে দাও ভুলুক সবই মোগল পাঁটের বাগাড়ম্বরি।

.

ইতিহাস সাক্ষী রইলো….

মন

অনন্য আলোর ভেতর

তোমাকে দেখতে চাওয়া-

নির্বোধের অবোধ উল্লাসের মতোন লাগে।

বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদের দেখা নাই,

জোনাকি মনে ঝিঁঝি’র কথন ডাক শুনতে পাই!

.

কপোলের ডান পাশে অস্পষ্ট কালো তিলকের গভীরে- নিবিড় ছোঁয়ায় বৃষ্টি বসে আছে!

মেঘ বলেছে যাবো যাবো….

.

সন্ধ্যা নেমে আসে।

রাত্রি নিশীথে গোপন বৈভবের দোলা,

একটা বইয়ের পাতায় শব্দগুলো আলো ছড়ায়…

সে আলোর রক্তিম আভায় সূর্যে খেলা করে মন-

একদম সেই নিরন্তর নির্মল ভোরের রেখায়!

মাসুদ বশীরের গল্প

মাটির মায়া

শেষমেশ বাড়িটা বিক্রিই করে দিলেন অরুণ মাষ্টার। বাড়িতে এখন আর থাকবার মতো কোন মানুষই নাই, অগত্যা কি আর করা জমিসহ বাড়ি, বাড়িসহ নিজেকেই যেন তিনি তুলে দিলেন বহু কষ্টার্জিত সেই মাটিরই কাছে। শহরের এই একটুকরো জমির জন্য কতোই না তাকে স্ট্রাগল করতে হয়েছিল একজীবনে।

.

অরুণ মাষ্টারের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের ছিলো প্রবল আগ্রহ কিন্তু বাবার অভাবের সংসার তার সেই ইচ্ছেকে প্রায় ধূলিসাৎ-ই করে দিতে বসেছিল। মেট্রিক পাশের পরে তার বাবা তাকে একদিন ডেকে নিয়ে বললেন- “বাবা অরুণ অনেক তো পাশ দিয়ে ফেলোছো এখন একটু সংসারের হালটা ধরো, বিয়েথা করে ফেলো, তুমি  তো আমার বড় সন্তান, তোমার মায়েরও বয়স হয়ে গেছে, আর এদিকে আমিও আর পারছিনে, আমার শরীর মন কোনটাই আর পেরে উঠছে না বাপু।”

বাবার মুখে এমন কথা শুনে সে তৎক্ষনাৎ যারপর নাই একদম স্থবির নিশ্চুপ হয়ে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন!

বাবা ছেলের কোন প্রতি উত্তর না পেয়ে আবারো বললেন- “কী ব্যাপার চুপ করে রইলে যে কিছু একটা বলো?”

অরুণ ভয়ে ভয়ে ভাবছে কী বলবে? তবুও বুকে একটু সাহস নিয়ে বলে ফেললো- “বাবা আমি আরও পড়তে চাই, এজন্য আমাকে শহরে যেতে হবে, এখানে তো কোন কলেজ নাই, তাই….”।

একথা শুনে অরুণের বাবা একটু রাগত স্বরেই বলে উঠলেন-” কি…? তুমি কি জজ-ব্যারিস্টার হবা নাকি, যে তোমাকে আরও পড়তেই হবে, তাছাড়া বামন হয়ে চাঁদ ছুঁতে যেওনা, যতটুকু আছো ততটুকুই থাকো, আমার চৌদ্দ পুরুষে কেউ পড়ালেখা করেনি, তারপরও তো তুমি বেশ শিক্ষিতই হয়েছো, আর বেশি শিক্ষিত হয়ে কাজ নাই বাপু এবং আমিও বলে রাখছি আর কোনরূপ খরচ দিতে পারবোনা তোমাকে, একথাটি খুব ভালো করে কান খুলে শুনে রাখো অরুণ, বুঝতে পেরেছো কি….?”

অরুণ তৎক্ষনাৎ তার বাবাকে আর কিছু না বলে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

.

গ্রামের স্কুলে মেট্রিক পাশ শেষে অরুণ উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে সেই কতদিন আগে এসেছিলেন এই শহরে। (তখন তো উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য শহরে আসা ছাড়া আর কোন পথই খোলা ছিলো না। তখনকার দিনে কয়েক গ্রাম মিলে দু-একটি প্রাইমারী স্কুল এবং বড় জোর একটি উচ্চ বিদ্যালয় ছাড়া আর তেমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ছিলো না।)

শহরে কোথায় থাকবে, কী করে চলবে, কী করে পড়ালেখা চালিয়ে যাবে, এ নিয়ে প্রথমেই তাকে একটা প্রচন্ড হোঁচট খেতে হলো। অবশেষে তার এক সহপাঠীর সহায়তায় শহরের এক বাড়িতে থাকার ব্যবস্থাটা সে করে ফেললো লজিং মাষ্টার হিসেবে। এভাবেই চলতে লাগলো তার পড়ালেখা।

চালচলন ও ছাত্র হিসেবে বেশ ভালো হওয়ার কারণে যে বাড়িতে সে লজিং থাকতো সে বাড়ির কর্তাব্যক্তির নজরে পড়ে গেলো সে এবং বংশ-গোত্র মিলে যাওয়ায় একদিন বাড়ির কর্তা তার সাথে তার বড়মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন অরুণ কে। এ প্রস্তাব পেয়ে প্রথমে অরুণ রাজি না হলেও পরবর্তীতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি মনের মাঝে আমলে নিয়ে অবশেষে বিয়েটা করেই ফেললো সে।

এভাবেই ঘরজামাই থেকে সে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলো কিন্তু শ্বশুরবাড়িসহ চারপাশের মানুষের নানাধরণের অপমানজনক কথাবার্তার কারণে একদিন সে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে কঠিন জীবন যুদ্ধে নেমে পড়লো। কোনরকম একটা ঝুপড়ি ঘর ভাড়া করে নিয়ে সেখানেই আবার নতুন করে শুরু করলো তার সংসার। তখন তার আয়ের একমাত্র পথ বা অবলম্বন হলো টিউশনি। এই টিউশনি পড়াতে-পড়াতেই শহরের এক বিদ্যালয়ে সে শিক্ষক হিসাবে চাকুরিও যোগাড় করে নিলো, পাশাপাশি নিজের পড়ালেখাটাও চালিয়ে যেতে লাগলো।

একদিন সেই ঝুপড়ি ঘর আলো করেই তার প্রথম পুত্র সন্তানের জন্ম হলো। এদিকে সে তখন ডিগ্রিটাও পাশ করে ফেলেছে, স্কুলের চাকরিটাও পার্মানেন্ট হয়ে গেছে। তবুও, অভাব যেনো কিছুতেই তার পিছু ছাড়ছে না। এই ঝুপড়ি ঘরে এভাবেই তার আরো তিনটা সন্তানের জন্ম হলো।তাদেরকে নিয়ে অরুণমাষ্টার অনেক কষ্টে দিনরাত টিউশনি আর স্কুলের চাকুরী থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করলো। সঞ্চয় করে করে বহুকষ্টে শহরে একটুকরো জমি কিলনো, সেখানে অনেক পরিশ্রমের টাকায় একটা বাড়ি করলো, দুই ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার ও দুই মেয়েকে মাস্টার্স করালো, বড়ছেলে ও দুই মেয়ের বিয়ে দিলো, দুই ছেলেকে বিদেশে পড়ালেখার জন্য পাঠালো। এখন তার দুই ছেলে বিদেশে বড় চাকুরী করছে, বড়মেয়েও জামাইসহ বিদেশে বসবাস করছে, এক মেয়ে দেশে থাকলেও সে-ও তার জামাইসহ ঢাকায় চাকুরী করছে, সংসার করছে।

.

সন্তানেরা যে যার মতো কর্ম নিয়ে ভালোই আছে, কিন্তু এদিকে একদিন অরুণ মাষ্টারের স্ত্রী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো এবং অবশেষে তাকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য পরপারে চলে গেলো!

বহু কষ্টে গড়া বহু সাধের তার শহরের জমি-বাড়ি এখন যেন একটা কোলাহলহীন পদচিহ্ন সর্বস্ব ভুতুড়ে বাড়ি, পাখপাখালির নির্ভরযোগ্য আবাসস্থল। যে মাটি, যে বাড়ির জন্য, যে সাফল্যের জন্য, একসময় তার এতো হৃদয়িক আকুতি ছিলো স্বপ্ন ছিলো তা যেন আজ তার কাছে একটা বড় ধরনের দুঃস্বপ্ন! এটাই অদ্ভুত বাস্তবতা, এটাই নিয়তি….। মানুষের জীবনের সব হিসেব কি সবসময় ঠিক থাকে? না থাকে না।

.

কার জন্য রাখা আর এই জমি-বাড়ি? কে আসবে আর এখানে? কেনই বা আসবে? এমনটাই ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত অরুণ মাষ্টার নিজেকেই যেন মাটির মাঝেই সমর্পণ করলেন। শেষমেশ শহরের ভিটেমাটি সব বিক্রি করে দিয়ে তার সেই মাটির আদরমাখা পৈত্রিক বসতবাড়ি গ্রামের মায়াভরা মাটিতেই মানুষ হয়ে আবারো ফিরে আসলেন….

জমিদারি রক্ত

আমার বন্ধু অনি একটা গল্প বলেছিলো। গল্পটা খুবই ট্রাজেডিময়। এক জমিদার পরিবারের একটা ছেলে ছিলো। সে সর্বদা অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতো। যেমন ধরুন সে গল্পের ছলে প্রায়শই বলে বেড়াতো- তার দাদা বিশাল জমিদার ছিলেন, তেনার হাতি ছিলো, ঘোড়া ছিলো, দুইটা বিরাট টি-গার্ডেন ছিলো তাঁর। দাদা প্রায়ই হাতিতে চড়ে শিকার করতে যেতেন। বছরান্তে কোচবিহার মহারাজার ডাক পড়তো তাঁর রাজপ্রাসাদে খাজনাদি, হিসাবকিতাব দেওয়ার জন্য। মহারাজের আতিথেয়তায় কেটে যেতো জমিদার দাদার ৭/৮দিন। বিদায় বেলায় প্রতিবারই মহরাজের দেয়া বিশেষ উপঢৌকনাদি সঙ্গে করে নিয়ে দাদা বাড়িতে ফিরতেন। এভাবে দাদার কথা বলতে বলতে তার মুখে যেনো ফেপনা উঠে যেতো আবার অকস্মাৎ তার চোখের কোল ঘেষে নেমে আসতো বিষাদের শীতল জল। কারণ, একদা ছিলো রাজ্যপাট, ছিলেন রাজা, সভাসদ, পরিষদবর্গ কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে নেই সেই জোতদারি-জমিদারি, নেই আর আগের মতো সেই পাইকপেয়াদা বরকন্দাজ কিন্তু আকাশ আহমেদ আছে। আছে তার অলীক স্বপ্নবিলাসী অতীত সুখস্মৃতি কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে সে আজ বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক হতাশাগ্রস্ত প্রেমিক যুবক।

আকাশ আহমেদ বয়সে প্রায় ২৪বছরের টগবগে যুবক। গ্রামের স্কুলে পড়া শেষ করে সে এসেছিলো এই ঢাকা শহরে। এইচএসসি ভর্তি হয়ে যথারীতি পড়াও শুরু করেছিলো কলেজে কিন্তু অতীত স্মৃতি ঘাটতে ঘাঁটতেই চলে যেতো তার দিনকাল। কোনরকম এইচএসসি পাশ দিয়ে ভর্তি হয়েছিলো সে ডিগ্রি ক্লাসে তবে ডিগ্রির রেজাল্ট তেমন ভালো না হওয়ার তার আর পড়াশোনা এগোয়নি বেশিদূর এবং তেমন ভালো কোনো চাকুরীও সে যোগাড় করতে পারেনি। অবশেষে অগত্যা একটা বিলাসবহুল শপিং মলে গেইট কিপার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলো আকাশ। বেতন তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিলো না তার কিন্তু বাস্তবের এই বাজারে তা নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলো। তবে, শরীরে জমিদারের রক্ত প্রায়শই তাকে হতাশায় ডুবে ফেলতো, চালচলনেও জমিদারী রক্তই যেনো কথা বলতো সবসময়। খেয়ে না খেয়েও বাহ্যিক চাল-চলনে, বসনে-ভূষণে মনে হতো সে যেনো বিরাট এক কোটিপতির সন্তান।

১৯৪৬ এ বৃটিশদের কুটচালে সৃষ্ট হলো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, রায়ট অবশেষে ১৯৪৭ এ ভারত উপমহাদেশ থেকে বৃটিশদের বিদায় কিন্তু উপমহাদেশটাকে বৃটিশরা কূটকৌশলে শেষমেশ ভাগ করে দিয়েই গেলো। দুভাগে বিভক্ত হলো ভারতবর্ষ- ভারত ও পাকিস্তান।

অতঃপর জোতদারি-জমিদারি প্রথারও বিলুপ্তি ঘোষণা  করা হলো। দেশভাগের ফলে মূল ভূখণ্ড থেকে মাতৃভূমি ত্যাগ করলো অনেকে এবং অনেক নামীদামী জমিদার এবং যারা তৎকালীন জোতদার-জমিদার ছিলেন তাদের বেশিরভাগই তখন রাতারাতি গরীব, মধ্যবৃত্ত, সহায় সম্বলহীন পর্যায়ে নেমে গেলো। কারণ, সরকার তখন সকল জোতদারি সরকারী আওতায় নিয়ে নিলো।

আকাশের দাদার ছিলো ৮ছেলে ও ৪মেয়ে এই নিয়ে মোট ১২জন সন্তান। তার দাদা সকল ছেলেকে তেমন পড়াশোনাও করাতে পারেননি কারণ ছেলেরাও মনে করতো তাদের বাবার অনেক জোতদারি-জমিদারি আছে এই নিশ্চন্ততায় ও আত্ম অহংকারে তারাও পড়াশোনা শিখতে তেমন আগ্রহী ছিলো না। শুধুমাত্র আকাশের বাবাই কোনরকম মেট্রিক পাশ করে গ্রামের এক পাঠশালায় শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেছিলেন।

.

আকাশ ও তার ক’জন বন্ধু মিলে ঢাকার উত্তরায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলো মেস হিসেবে। তাদের মেসের পাশের ফ্ল্যাটটিই ছিলো অষ্টাদশী সুধা ইসলামের বাবার বাড়ি মানে সুধাদের বাড়ি। অফিস যেতে আসতে প্রায় প্রতিদিনই সুধার সাথে দেখা হয়ে যেতো আকাশের। তাদের দুজনের প্রায় দিনই চোখাচোখি হতো কিন্তু কখনো কথা হতো না। একদিন হঠাৎ সুধার সাথে কথা বিনিময় হলো মানে সুধাই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলো আকাশের সাথে। এভাবে প্রতিদিনই সুধার সাথে আকাশের কথা হয় তবে আকাশ একটু এড়িয়ে যেতে চায় কিন্তু মনে মনে সুধা আকাশের সুন্দর চেহারা, তার সুশ্রী কথাবার্তা ও চলনেবলনে আকৃষ্ট হয়ে টিনএজ বড়লোকের এই আদুরে দুলালী আকাশের প্রেমে পড়ে যায় এবং সরাসরি তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েই বসে। প্রথম প্রথম আকাশ না না করলেও পরবর্তীতে সুধার প্রেম-সুধায় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না আকাশ। এভাবেই ধীরে ধীরে চলতে থাকে আকাশ ও সুধার অসামঞ্জস্য প্রেম কাহিনী।

আকাশ আসলে কী জব করে তা সুধা জানতো না এবং কখনো জানতেও চাইতো না সে কিন্তু আকাশ প্রায়ই সুধাকে তার সত্যিকারের জীবন ও তার জব সম্পর্কে সুধাকে বলতে চাইতো তবে টিনএজ বড়লোকের আদুরে দুলালী আকাশের সে কথায় কখনোই গা করতো না বরং উল্টো আকাশ কিছু বলার আগেই সুধা তখনই তা হেলার ছলে শুনতে না চেয়ে হাসতে থাকতো এবং আকাশকে বলতো- থাক না আকাশ এখন ওসব কথা, অন্য কথা বলো প্লিজ।

শপিং মলের দরজায় দাঁড়িয়ে আকাশ যথারীতি প্রতিদিনের মতো ডিউটি করছে। শপিং মলের দরজা খুলতেই তার চোখে চোখ পড়ে গেলো এক অষ্টাদশী সুন্দরী তরুনীর চোখ! হতবিহ্বল হয়ে সে তখন কিংকর্তব্যবিমুঢ়! নিজেকে ক্ষাণিক সামলিয়ে সে কিছু বলার আগেই সুধা আকাশকে বলে- ছিঃ ছিঃ আকাশ তুমি এই জব করো? আমিতো ভাবতেই পারছি না আকাশ! আকাশ তুমি….

আকাশ সুধাকে বলে- কেন সুধা আমি কি চুরি করি নাকি ছিনতাই করি? তাছাড়া তোমাকে তো আমি আমার জব সম্পর্কে অনেকবার বলতে চেয়েছি কিন্তু তুমি তা কখনোই শোনোনি, শুনতে চাওনি তবে এখন কেন এমন আশ্চর্য হচ্ছ?

সুধা বলে- তাই বলে এই জব? না আকাশ আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না, কিছুতেই না। তুমি না বলতে তুমি নাকি জমিদারের নাতি, তোমার দাদার নাকি কতকিছু ছিলো, তাহলে সে সবকিছু কি মিথ্যে? আকাশ বলে- মিথ্যে হতে যাবে কেন সুধা, বিশ্বাস করো সুধা, সব সত্যি। সত্যি সত্যিই আমার শরীরে জমিদারের রক্ত প্রবাহমান, বিশ্বাস করো সুধা, সব সত্যি।

সুধা বলে- থাকো তুমি তোমার ঐ অতীত ঐতিহ্য, জমিদারি আর অলীক ভাবনা নিয়ে। আমাকে ভুলে যাও, ভুলে যেও আকাশ। কারণ, তুমি মোটেও একদমই আমার যোগ্য নও।

আকাশ সুধার হাত ধরে কিছু একটা বলতে যাবে, অমনি সুধা রাগান্বিত হয়ে হাত ঝটকিয়ে নিয়ে আকাশকে বলে- তোর এতো বড় সাহস, দারোয়ান কোথাকার! মনে রাখিস আর কখনো, কোনদিনই আমার ত্রিসীমানায় যেনো তোকে না দেখি। দারোয়ানের বাচ্চা দারোয়ান, সে আবার নিজেকে বলে জমিদার।

এই বলে সুধা তার বিএমডব্লিউ তে চড়ে শপিং মল ত্যাগ করলো। বিএমডব্লিউর সাইলেন্সরের গভীর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আকাশের সুন্দর মুখমণ্ডল নিমিষেই যেন আষাঢ়ের আঁধার কালো ঘণ মেঘে ছেয়ে গেলো এবং দুচোখ বেয়ে ঝরতে লাগলো অবিরাম বর্ষণ।

একদিন হঠাৎ শোনা গেলো আকাশ আহমেদ আর নেই। সুধার সাথে অমন ঘটনার পর থেকে আকাশ আরও চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো এবং প্রায়ই সে অন্যমনস্ক হয়ে পথ চলতো। এভাবেই আকাশ কোনো একদিন আনমনে পথ চলতে চলতে, সুধা ও তার জমিদার দাদার কথা ভাবতে ভাবতেই একদিন এক দ্রুত বেগে ছুটে আসা গাড়ির চাকার নীচে পিষ্ট হয়ে দেহ ত্যাগ করেছে।

মাসুদ বশীর

মাসুদ বশীর

জন্ম তারিখঃ সেপ্টেম্বর ০৪, ১৯৬৭ সাল।

রাশিঃ কন্যা।

পরিচয়ঃ কবি, গল্পকার, লেখক ও উন্নয়ন কর্মী।

লেখালেখির শুরুঃ ১৯৮০ সাল থেকে।

প্রথম প্রকাশিত লেখাঃ কবিতা(প্রতিদান), ১৯৮৪ সাল।

প্রকাশিত বইঃ প্রতীক্ষায় প্রতিদিন(কবিতা), ১৯৯০ সাল।

পুরস্কারঃ দেশব্যাপী অভিযাত্রিক সাহিত্য প্রতিযোগিতায়(১৯৯১ সাল) কবিতা বিষয়ে ১ম স্হান অর্জন।

প্রিয় ব্যক্তিত্বঃ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)।

প্রিয় কবিঃ কাজী নজরুল ইসলাম।

প্রিয় সঙ্গীতঃ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।

প্রিয় বিশ্বাসঃ স্বার্থহীন ভালোবাসা।

নিজের প্রিয় উক্তিঃ “মনের চেয়ে বড় গতি কিছু নেই, সুন্দর মনের চেয়ে সুন্দর কিছু নেই”

প্রিয় ফুলঃ লাল গোলাপ।

প্রিয় রংঃ সবুজ।

প্রিয় শখঃ খোলা সবুজ প্রান্তরে একাকী বসে থাকা।