তরুণ কবি সোমের কৌমুদির জন্মদিন আজ। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ গ্রামে মাতুতালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটোবেলা থেকেই লেখালেখির সাথে জড়িত তিনি। মূলত কবিতাচর্চাতেই মগ্ন থাকেন তিনি। বর্তমানে তরুণ এই কবি ঢাকায় বসবাস করছেন। তাকে জন্মদিনে তাকে মুগ্ধতা ডট কমের পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
[শিল্প স্বভাবতই এক কঠিন-রুক্ষ পথ। অনেক সাধনার পথ। পথ কঠিন বলেই এর ফল সুন্দর। এই পথে হাঁটার এক অনন্য মাধ্যম হলো কবিতা। নিখিল মানবের মানবিক অনুভূতি একজন কবির কণ্ঠস্বরে ফুটে ওঠে, এ কি কোনো সহজ ব্যাপার হতে পারে?
হাজার বছর ধরে বাংলা কবিতাই ছিল সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের কথাকে তুলে আনার একমাত্র মাধ্যম। এরপর বাংলা সাহিত্য বিচিত্র ধারা-উপধারায় বিস্তৃত হয়েছে। কবিতাও বদলে ফেলেছে তার শরীর। চারশো বছর আগে কিংবা একশো বছর আগে এমনকি পঞ্চাশ বছর আগেও যে কবিতার শারীরিক রূপ আমরা দেখি এখন আর তেমনটি নেই। কোনো কিছুই তো আসলে একরকম থাকে না। কবিতাও নেই। এখন কবিতার শব্দ, অনুষঙ্গ, রূপ, রস, গন্ধ সবই যেমন বদলে গেছে তেমনি বদলে গেছে এর স্বাদ নেবার প্রক্রিয়াটিও।]
অনেক দিন ধরে কবিতা নিয়ে নীরিক্ষা চালাচ্ছেন তরুণ কবি সোমের কৌমুদি। প্রকৃত নাম মশিউর রহমান বিরু। দেশে ও বিদেশে নানা মাধ্যমে তার কবিতা প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এরই মধ্যে আমরা দেখতে পাই তার কবিতায় নানা ধরনের বাঁক বদল। বিচিত্র এই বদলের বাতাস বইছে এই সময়ের কবিতার বাতাসের অনুকুলেই।
আমরা দেখতে পাই, তরুণ কবিদের প্রথম জীবনের অধিকাংশ কবিতারই মূল অনুষঙ্গ হয় প্রেম ও দুঃখ। সোমের কৌমুদিও এর ব্যতিক্রম নন। সেটা দোষেরও নয় নিশ্চয়ই।
কিন্তু একরকমের কবিতাধারায় কবি নিজেও সন্তুষ্ট থাকেননি কখনও। পাশাপাশি তিনি নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন বাঁকবদলের। কবিতার অনুষঙ্গ, শব্দের গাঁথুনী, অলঙ্কারের ব্যবহার আর গতিময়তা নিয়ে বারবার কাজ করেছেন এবং করে চলেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
যেমন, গতানুগতিক বিরহগাথা বাদ দিয়ে তিনি আচমকা লিখতে থাকেন একধরনের শান্ত স্নিগ্ধ গদ্য ঢঙের কবিতা। যেখানে ছোটো ছোটো পংক্তিগুলো শান্ত ভঙ্গিতে একেকটা ছবি তৈরি করে দিচ্ছে। পড়া যাক তার ‘সভ্যতা-২’ শিরোনামের কবিতাটির অংশবিশেষ:
“স্নিগ্ধ সকাল। সময়ের ঢেউ আছড়ে পড়ে জীবন নদীর তীরে।
প্রহর নীড়ে। জীবনের রঙে রাঙা হয়ে ওঠে মহাকাল।
কাঁচা রোদ। খসখসে হাতের স্পর্শে ধারালো হয়।
রঙিন ধূসরতায়। সবুজ মাঠে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ায় বোধ।”
এই নির্মাণ-ঢঙ কবির চিন্তা ও চেষ্টার প্রতিচ্ছবি হয়ে ধরা দেয় আমাদের সামনে। এই পর্যায়ে সোমের কৌমুদি একজন পরিণত কবিমানস ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়ে ওঠেন পাঠক মননে। ‘ছায়া’ শিরোনামের এ ধরনের আরেকটি কবিতায় দেখা যায়:
‘‘র্পণমোচী বৃক্ষরে বন। সঙ্গোপনে যুবতী বসন্ত লালন করে দশ মাস।
চরিহরিৎ বৃক্ষের আবাস। শীত–শরৎ–বসন্ত সবুজ, কোকিল উচাটন।।
ঝলসানো রোদের ঝাঁজ। প্রহরের তৃষ্ণা মেটায় আলো–আঁধারের দিবাকর।
ফুলে বসা মধুকর। আহত পাখির খসে পড়া পালকে সময়ের কারুকাজ।।’’
এখানে ঢঙটি একই হলেও এবং কবিতার উপাদান থাকলেও কঠিন শব্দ ব্যবহারের চেষ্টাটি লক্ষণীয়। আমাদের মনে হয়, এটি তেমন দরকারি কোনো প্রবণতা নয়।
কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে আমরা আচমকা দেখতে পাই সোমের কৌমুদির কবিতায় আরেক ধরনের বাঁক-বদল।
‘‘খরস্রোতা নদীর বুকে
ঝরঝর বৃষ্টি
যুবতী ঢেউ
পাড়ে বাঁধা ডিঙি
নিরুদ্দেশ মাঝি।
নদীর ওপারে যেতে
সহায় ডিঙি
ডিঙি নেচে উঠে
জলের উল্লাসে
বৃষ্টির বিশুদ্ধতায়
সিক্ত নদী।’’
এখানে দেখা যায়, খানিকটা অক্ষরবৃত্ত ছন্দের গাঁথুনি মিশিয়ে পাঠ-সহায়ক ছোটো ছোটো পংক্তি সৃষ্টির প্রয়াস। এসব চেষ্টা কবিকে শক্তি যোগায় নিঃসন্দেহে। নিজেই নিজেকে ভেঙে ফেলবার সাহস এবং প্রজ্ঞা সবার থাকে না।
সোমের কৌমুদির কবিতা একটা পর্যায়ে আমাদের মুগ্ধতা ও প্রত্যাশাকে স্পর্শ করে যখন দেখি অদ্ভুত এক ভাষা-ভঙ্গিতে তিনি নির্মাণ করতে শুরু করেন ‘দেশীয় কবিতা’গুলি। আসুন পড়ি তার ‘বিষুদবারের রাত’ কবিতাটি:
‘‘পাটশাক কুটে বধূ, পুঁইশাক কুটে। বধূ কচু পাতা কুটে আর সজনে পাতা কুটে। শহর থেকে আজ বিষুদবার রাতে, সপ্তাহ বাদে সোয়ামি আসবে বাটে। বধূ রান্ধে শোলকা আর সিদল ভর্তা। আজ বিষুদবার রাতে আসবে বাড়ির কর্তা।
বধূ চোখে কাজল মাখে, বধূ পায়ে আলতা মাখে। মনের যত প্রেম শাড়ির আঁচলে মেখে, দাওয়ায় দাঁড়িয়ে পথ পানে চেয়ে থাকে। আজ বিষুদবার রাতে আসছে বাড়ির কর্তা। বধূ রান্ধি রাখছে শোলকা আর সিদল ভর্তা।
অমাবস্যাতেও বিষুদবারের রাতে, বধূর ঘরে জোনাক জ্বলে ওঠে।’’
কবিতার অদ্ভুত সুন্দর এই ভঙ্গিটি আমরা প্রথম লক্ষ্য করি কবি মুজিব ইরমের কবিতায়। কবিতাগুলোতে দেশের জন্য, পরিবারের জন্য কিংবা ভালোবাসার মানুষগুলোর জন্য কবির যেমন মন উতলা হয় তেমনি দেশীয় সংস্কৃতিবোধের প্রতি প্রবল ভালোবাসা ফুটে ওঠে। সোমের কৌমুদির কবিতার পাণ্ডুলিপি পাঠে এরকম আরও কিছু কবিতা পাওয়া যায়, যেমন: বাবুই পাখির বাসা মাচা, বেনারসি ইত্যাদি।
এভাবে সময়ে সময়ে নানান ধরনের কবিতাভাষ্য বিনির্মাণে অব্যাহত চেষ্টা জারি রেখেছেন তরুণ কবি সোমের কৌমুদি। মা, মাটি ও দেশের গন্ধ পাওয়া যায় তার কবিতাগুলোতে। শব্দের যথোপযুক্ত ব্যবহার, শব্দের সাহায্যে ছবি আঁকা, ভাব ও বক্তব্য প্রকাশের প্রয়াস-এই সমস্ত চেষ্টা তরুণ এই কবিকে নিয়ে যাবে অনন্য উচ্চতায়-এই শুভকামনা রইল।
২০২০ সালে তরুণ কবি সোমের কৌমুদির এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন পাতাপ্রকাশ ডট কমের সম্পাদক জাকির আহমদ।
প্রশ্ন : কেমন আছেন? বসন্ত কেমন কাটছে?
সোমের কৌমুদী : এই তো। ভালো আছি। বসন্ত আসলে হৃদয় কাননে ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক প্রকৃতিতে ফুল ফুটবেই আর সে ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়বে মন বাগানেও। বসন্তে যেমন প্রেমিক কোকিল গান গায় তেমনি বিরহী কোকিলও গান গায়। বসন্ত সবার মনকেই ছুঁয়ে যায়, এটাই বসন্তের বৈশিষ্ট্য। আমিও বসন্তের গান গাইছি।
প্রশ্ন : আপনার লেখালেখির শুরুর গল্পটা শুনতে চাই…
সোমের কৌমুদী : আমরা সব ভাই-বোন নানাবাড়িতে বড় হয়েছি। আমার বড় দুই ভাই। আমার নানা ছিলেন প্রাইমারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। নিয়িমিত খবরের কাগজ ও অন্যান্য বই পড়তেন। বাড়িতে বড় ভাই নিয়মিত গানের রেওয়াজ করতেন। তিনি ছিলেন সাহিত্যের ছাত্র। ছোটবেলা থেকেই আমাকে সাহিত্যের বিভিন্ন বই পড়তে দিতেন এবং পড়েছি কি না তা যাচাই করতেন। ছোট মামাও টুকটাক লিখতেন। এমন পরিবেশ পেয়েই লেখালেখির প্রতি আগ্রহ জন্মে। আমি আমার বড় ভাইয়ের কাছে শিখেছি কীভাবে লেখায় শিল্পরস নিয়ে আসতে হয় আর ছোটভাইয়ের কাছে শিখেছি লেখাটাকে কীভাবে জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলতে হয়। যারা অন্যের ভালো চান তাদের অধিকাংশই অন্যের ভালো করতে গিয়ে সেই ব্যক্তির ভালো হবার পর সেখানে নিজের স্বার্থ খুঁজে না পেলে চরিত্র বদলে ফেলে। কিন্তু আমি আমার নানাজি ও ছোট ভাইজানের কাছে শিখেছি কীভাবে নিঃস্বার্থ ভালোবাসতে হয়।সাহিত্যকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার শিক্ষাটাও আমি আমার ছোট ভাইজানের কাছ থেকে পেয়েছি।
প্রশ্ন : ছোটোবেলায় জীবনের লক্ষ্য কী ছিলো? তা কি হতে পেরেছেন?
সোমের কৌমুদী : ছোটবেলায় জীবনের লক্ষ্য ছিলো ক্রিকেটার হওয়া। কিন্তু যখন কলেজে পড়ি তখন থেকে লেখকই হতে চেয়েছি। আমি সে পথেই হাঁটছি।
প্রশ্ন: আপনি নিজেকে কি কবি ভাবেন? নাকি অন্যকিছু?
সোমের কৌমুদী : কবিতা লিখতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখা কখনোই লক্ষ্য নয় আমার। কবিতার পর শিশুসাহিত্য নিয়ে ভাবতে বেশি ভালো লাগে।
প্রশ্ন : নিজের বই নিয়ে উপলব্ধি কী?
সোমের কৌমুদী: দেখুন, আর দশটা মানুষের ন্যায় লেখকেরাও পরিণত হয় বয়স আর অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে। লেখার বয়স বাড়ার সাথে সাথে লেখকও পরিপক্বতার দিকে ধাবিত হয়। আমার কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। যার শেষেরটি ‘জোছনা রাঙা বৃষ্টি’। এ পর্যায়ে এসে সত্যি বলতে, আমি আমার বই নিয়ে পুরোপুরি তৃপ্ত না। আমি মনে করি আমার আরো ভালো কিছু দেয়া উচিৎ ছিল। এবং উপরওয়ালা আমাকে সে সামর্থ্য দিয়েছেন বলে মনে করি। পরবর্তী বইগুলোতে আরো ভালো কিছু দেবার চেষ্টা করবো। এজন্যই তিন বছর নতুন বই প্রকাশ করা থেকে বিরত আছি।
প্রশ্ন: আপনার কাছে কবিতা কী?
সোমের কৌমুদী: আমার সবসময়ই মনে হয় ,কবিতা হলো কবির আত্ম প্রতিকৃতি। তবে এজন্য কবিকে অবশ্যই তাঁর ব্যক্তিসত্তাকে জাতিসত্তায় পরিণত করতে হবে। যে কবিতায় মাটি ও মানুষের ঘ্রাণ নাই, তা পরিপূর্ণ কবিতা মনে হয় না আমার কাছে। কবিতা একটা মাধ্যম যা মানুষের ভাবাবেগকে জাগ্রত করে।
প্রশ্ন: আপনার মাথায় লেখার ইমেজ কীভাবে আসে?
সোমের কৌমুদী : জীবনে পাওয়া কষ্ট, অভাববোধ, জানা সত্ত্বেও উত্তর দিতে না পারা প্রশ্নগুলোই আমার সবচেয়ে বড় সম্বল। দৈনন্দিন জীবনে ঘুরেফিরে এরা আমার জীবনে আসে, আমি আসতে দেই। এগুলোই আমাকে লিখতে তাড়িত করে।
প্রশ্ন: আপনি কার লেখা বেশি পড়েন? বিশেষ কারও লেখা কি আপনাকে প্রভাবিত করে?
সোমের কৌমুদী: ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম-এর বই পড়া হয়। অনেকের লেখাই পড়া হয়। তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, নির্মলেন্দু গুণ আর হেলাল হাফিজ-এর কবিতা এবং হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল আর ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়-এর বই আমাকে বেশি টানে।
বি…শে….ষ কারো লেখা………….. না, বিশেষ কারো লেখা আমাকে প্রভাবিত করে বলে মনে করি না। তবে সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের জীবন আমাকে অনেক প্রভাবিত করে।
প্রশ্ন: আপনার সমকালীন লেখকদের কবিতা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? কার লেখা বেশি ভালো লাগে?
সোমের কৌমুদী : সমকালীন অনেক কবি-ই ভালো কবিতা লিখছেন। তাঁদের কবিতার কাব্যরস পাঠককে ভাবনার ক্ষেত্র এনে দিচ্ছে। চিত্রকল্প,কল্পনাবোধ,পরিমিত কাব্যালঙ্কার,সময়ের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁদের সৃষ্ট কাব্য সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখছে এবং ভবিষ্যতেও রাখবে। বর্তমান সময়ের ওবায়েদ আকাশ, ফারুক আফিনদী’র কবিতা আমার বেশি ভালো লাগে।
প্রশ্ন: সবশেষে, লেখক হিসেবে চূড়ান্ত লক্ষ্য কী?
সোমের কৌমুদী : পাঠকের ভালোবাসা অর্জন করা, দেশ ও কালের গণ্ডি পেরিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পাঠকের মনে বেঁচে থাকা।এমন একটা পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে যাওয়া যাতে মা-বাবা আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারেন।
স্নিগ্ধ সকাল। সময়ের ঢেউ আছড়ে পড়ে জীবন নদীর তীরে।
প্রহর নীড়ে। জীবনের রঙে রাঙা হয়ে উঠে মহাকাল।
কাঁচা রোদ। খসখসে হাতের স্পর্শে ধারালো হয়।
রঙিন ধূসরতায়। সবুজ মাঠে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ায় বোধ।
পূর্ণিমা শেষ। তীরে পলির আস্তরণ ভেদে উঁকি দেয় সভ্যতা।
ক্লাইম্যাক্স, নাটকীয়তা। জীবনের গায়ে লেপ্টে জীবন অবশেষ।
রাখালের বাঁশি। মাঠ পেরিয়ে নদীর কূল ভরা ছোপ ছোপ আচ্ছন্নতা।
দুঃখের দীনতা। মরা দেহে জেগে উঠে প্রাণ, মলিন মুখে ফোটে হাসি।
সোনালী চিল। উড়ে চলে, ডানার ছায়ায় ফ্যাঁকাসে কাশের শুভ্রতা।
মমতার মুখরতা। প্রকৃতির সজীবতায় ম্লান প্রান্তহীন আকাশের নীল।
ধুলো মেঠোপথ। মিশে যায়, নিজেকে হারায় ইট-কংক্রিটের খাঁচায়।
সুখ নিজস্বতায়। অজান্তেই ধুলোমাখা পথের পানে ফিরে চলে মনোরথ।
শহুরে ডাস্টবিন। খাবারের উচ্ছিষ্ট পেয়ে বায়স ভুলে ক্ষুধার শোক।
ক্ষুধার্ত দু’চোখ। ছলছল চেয়ে থাকে পঁচা খাবারের দিকে প্রতিদিন।
র্পণমোচী বৃক্ষরে বন। সঙ্গোপনে যুবতী বসন্ত লালন করে দশ মাস।
চিরহরিৎ বৃক্ষের আবাস। শীত-শরৎ-বসন্ত সবুজ, কোকিল উচাটন।।
ঝলসানো রোদের ঝাঁজ। প্রহরের তৃষ্ণা মেটায় আলো-আঁধারের দিবাকর।
ফুলে বসা মধুকর। আহত পাখির খসে পড়া পালকে সময়রে কারুকাজ।।
আলো-ছায়ার খেলা। গাছের থেকে ক্রমশ দৈর্ঘ্য বাড়ে গাছরে ছায়ার।
র্পূণতা প্রাপ্ত অহংকার। তুলতুলে কাশফুল ভুলে রিমঝিম র্বষার কলো।।
হারানোর তৃপ্তিতে সুখ। সিন্ধুর ইটে গড়ে ওঠে হৃদয়াঞ্চলে সবুজ তাজমহল।
মহল ভরা আহল। বসন্তের সকালে তবু শীতের শিশির, পরিপূর্ণতার ভুখ।।
কথা শেষ হলে কথা বলতে যাওয়া কষ্টের
কথা তখন নীরবতা হয়
শব্দিত হয়েও শব্দহীন হয়,
কথাগুলো তখন শব্দ হয়েও দুঃখ হয় শব্দের।
কথা শেষ হলে কথা বলতে যাওয়া কষ্টের
কথা তখন চোখের জল হয়
চোখের জল তখন অশ্রু হয়,
অশ্রু তখন উপহাস হয় বা চিরকালীন দুঃখ হয় জীবনের।
কথা শেষ হলে কথা বলতে যাওয়া কষ্টের
কথা তখন হাসি হয়
হাসি তখন সুখ হয়,
সুখ তখন জীবন হয় বা পাথেয় হয় জীবন চলার পথের।
কথা শেষ হলে কথা বলতে যাওয়া কষ্টের
কথা তখন শোষিত হয়
কথা তখন শোষক হয়,
শোষক কথাগুলো মুক্ত হয়, হয়ে যায় আমজনতার।
ছুটে চলেছো । চলো। চেনা পথ! নাকি অচেনা?
ফিরে আসার পথ খোলা? নাকি না ফিরলেও ক্ষতি নেই?
ফিরে আসতেই হবে? নাকি অবিরাম সুখ এ পথ চলাতেই?
এ পথ বৃষ্টির জলে সিক্ত হয় তো?
চাঁদের আলোয় আলোকিত?
পাখির গানে থাকে কি মুখরিত?
কি! আটপৌরে জীবন চলে যেতে এ সবের দরকার কী?
হয়তো একটা জীবন পার করতে
বৃষ্টি অতি প্রয়োজনীয় নয়
পাখির গান না শুনলেও অনায়াসেই জীবন কেটে যায়
চাঁদের আলোয় জ্যোৎস্না স্নানও মৌলিক চাহিদা নয়।
তবুও কিছু থেকে যায়,
শুধু “কিন্তু”-র মাঝেই তা সীমাবদ্ধ নয়।
ভেবে দেখো, এগুলোও মৌলিক চাহিদার সাথে
একই কাতারে দাঁড়ায়।
ভাবো, ভেবে দেখো-
বৃষ্টি কখনই অপবিত্র হতে পারে না
জোছনা কখনই রুক্ষতা আনতে পারে না
পাখির গান কখনই অশালীন হতে পারে না।
নিঃসঙ্গ প্রহর একাকীকতায় মুখরিত হয়
অব্যক্ত কথার কোলাহলে পূর্ণ নীরবতার উঠোন
একাকী চাঁদের ছড়ানো জোছনা নৃত্যে মাতে
বর্গাকার মাঠের চারদিকে উল্লাস করে অদৃশ্য দর্শক।
ভোরের আলোয় আঁধারে হারানো চাঁদকে নিয়ে লেখা গান
পূর্ণতা পায়; সুরভিহীন কালির আঁচড়ে ধূসর সময়।
আদিগন্ত সবুজ প্রান্তর হয়ে যায় হৃদয়
রাখালের বাঁশির সুরে চাপা পড়ে
ক্ষেতের কান্না, কৃষকের দ্বিপ্রহর জীবনের কষ্ট।
সূর্যের তেজ নিস্তেজ হয় কৃষানির লাল শাড়ির ছোঁয়ায়
এক ঝাঁক পাখি ডানা মেলে ফের, ছুটে চলে নীলাকাশে
দ্বিপ্রহর জীবন লাল শাড়ির আঁচলে নিজেকে জড়ায়।
ভ্রমণ পিয়াসী মন
দরিদ্র দেহের ভার
কাঁধে নিয়ে
ছুটে বেড়ায়
সুন্দর বন।
সুরক্ষা বলয়
পদাঘাতে গত
বনের গহীন
আঁধার ঘন
বাঘের থাবায়
মুমূর্ষু জীবন,
ওপারের ছবি
ভাসায় নয়ন
নয়ন
খোঁজে ফেরে
মায়াবী হরিণ।
“হরিণ তৃষ্ণা”
গ্রীষ্মে লুকায়
বর্ষায় সিক্ত
চাতক মন।
সম্পর্ককে ঋতু বলা যায়!
সম্পর্কের রূপ ঋতুর মত করে
পর্যায়ক্রমে আসে, পুনরায়;
গ্রীষ্ম
বর্ষা
শীত
বসন্ত।
শরৎ ও হেমন্তও জীবনে উঁকি মারে।
মহাকাল ঋতুর মধ্য দিয়ে বয়ে যায়।
একটা সম্পর্কই ষড়ঋতু হয়ে যায়।
ভিন্ন ভিন্ন রূপে জীবনকে আগলে রাখে
ভালোবেসে ও ঘৃণায়।
রাগে
অনুরাগে
নিঃস্পৃহতায়
মায়ায়।
অনুমান ও ভুল বুঝাবুঝিও জায়গা পেতে লড়ে।
জীবনটা ঋতুর নানা রঙে হারায়।
সবুজ বনের ফাঁকে হেলে পড়ে
সূর্যরশ্মি
বনসংগীতের সুর ছড়িয়ে পড়ে
এ প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
সান্ধ্যগীতি
বেজে উঠে মর্মর,
প্রকৃতির পটে আঁকা ছবি
প্রাণের স্পন্দন
জীবন্ত হয়ে উঠে
সবুজের আঁচড়।
নদীর বুকে হেলে পড়া চাঁদ
একটা ছবি
সুর তোলা বাঁশি
রাঙিয়ে দেয়
জীবন
সময়
প্রকৃতি
শিল্পের ক্যানভাসে রঙিন আঁচড়।
পাটশাক কুটে বধূ, পুঁইশাক কুটে। বধূ কচু পাতা কুটে আর সজনে পাতা কুটে। শহর থেকে আজ বিষুদবার রাতে, সপ্তাহ বাদে সোয়ামি আসবে বাটে। বধূ রান্ধে শোলকা আর সিদল ভর্তা। আজ বিষুদবার রাতে আসবে বাড়ির কর্তা।
বধূ চোখে কাজল মাখে, বধূ পায়ে আলতা মাখে। মনের যত প্রেম শাড়ির আঁচলে মেখে, দাওয়ায় দাঁড়িয়ে পথ পানে চেয়ে থাকে। আজ বিষুদবার রাতে আসছে বাড়ির কর্তা। বধূ রান্ধি রাখছে শোলকা আর সিদল ভর্তা।
অমাবস্যাতেও বিষুদবারের রাতে, বধূর ঘরে জোনাক জ্বলে উঠে।
কন্যা চুলায় মুড়ি ভাজে, কন্যা চুলায় খই ভাজে। কন্যা ঢেঁকিতে চিড়া বানে, কন্যা জানে সুখের মানে। কন্যা চিড়ায় মাখে খেজুর গুড়, মুখের গানের মনমাতানো সুর। সে সুর ছড়ায় সদ্য তোলা আমন ধানের মাঠে, আমন ধানের মাঠের সুখ আটকে আছে খেয়াঘাটে।
তিস্তা নদী পিছে ফেলে আমন ধানের মাঠ পেরিয়ে কন্যার বাপের বাড়ি, সেই বাড়ির চারিদিকে আম-জাম আর কাঁঠাল গাছের সারি। পূব উঠানের কোণের দিকে একটা বটের গাছ, সেই গাছের ছায়ায় মন জুড়াতে কন্যার জাগে আশ। চিড়া, মুড়ি, খইয়ের ঘ্রাণে কন্যার মুখে হাসি, বটের তলায় কে যে বাজায় সম্মোহনী বাঁশি!
অগ্রহায়ণের সাঁঝের বেলায় বাপের বাড়ির উঠান, কোণ জুড়ে গল্প-হাসি আর মায়ার টান। চিড়া-মুড়ি-খইয়ের ঘ্রাণে মুখর সবার মুখ, এ সুখের রেশে ভরবে ফের আমন ধানের মাঠের বুক।
বাপের বাড়ির কাইনচায় তালগাছে বাবুই পাখির বাসা, সেই বাসাতে ঘর বেঁধেছে কন্যার মনের স্বপ্ন-আশা।
বধূ বাসে মাটি ভালো, বধূর হাতের ছোঁয়ায় আলো। কাইনচা বাড়ির মাচা ভরা ঝিঙে-শশার ফুল, বধূর ছোঁয়ার মায়ার প্রেমে বাঁধা ধুন্দুল। সকাল-বিকাল মৌসুমি হাওয়ায় ফুলেরা দোল খায়, মাচার সে রূপ মন কেড়ে নেয় ডাকে ইশারায়।
বধূর হাতে বেলি রূপার চুড়ি, বধূর সাথে ঝিঙে তোলে খুড়ি। দুপুর বেলার রোদে ঝিমিয়ে পড়ে পাতা, লতাটাকে শক্ত করে আগলে রাখে বাতা। পাতার ঘুম ভাঙায় চুড়ির রিনিঝিনি সুর, চুড়ির সুরে দুলে উঠে যৈবতী বাহুর কেয়ূর।
রাতের বেলা চাঁদের আলো মাচায় ঢলে পড়ে, এক পৃথিবী ভালোবাসা মাচায় বসত করে।
মাঝ নিশীথের গহিন বেলায় জোছনা পড়ে ঢলে, জোছনা আসে, জোছনা নামে তিস্তা নদীর জলে। তিস্তা নদীর পশ্চিম তীরে বন্ধু বাঁধছে ঘর, সুখের চাষ করে বন্ধু সাথে বন্ধুর বর। বীজ বোনা শেষ হয়েছে এখন অপেক্ষা করে, ফসল তুলবে বন্ধু ঘরে মৌসুমি হাওয়ার পরে।
নিশীথের গহিন বেলায় জোছনা ছড়ায় আলো, ভালোগুলো হয় আরও ভালো – কালোও হয় ভালো। জোছনা আর মনের টানে মন থাকে না ঘরে, শূন্যতা সুখের প্রেমে মিশে অশ্রু হয়ে ঝরে। কষ্ট আরো গাঢ় হয়ে তৃপ্তি ডেকে আনে, বাঁচার সাধ দ্বিগুণ বাড়ে এমন মায়ার টানে।
চাঁদের আলোয় বন্ধুর বাড়ির পথ চিনতে হয় না ভুল, পথের দু’ধারে সারি সারি গাছে ফুটেছে ধুতরা ফুল।
গীত গায় ভাবি, গীত গায় দাদি। মেন্দি মাখে মামি আর মেন্দি মাখে নানি। শ্যাম বরণ কন্যা লাজে মরে যায়, মেন্দি মাখে মায়ে কন্যার গায়।
কন্যার চোখ ভরা মায়া, সেই মায়ার নাই কায়া। চোখের তারায় ভেসে উঠে ফুল বাগানের ছবি, বিয়ান বেলার রোদের ছায়ায় তারই প্রতিচ্ছবি। কন্যার গায়ে জড়িয়ে আজ ছোঁয়ার ভালোবাসা, বিয়ান বেলার রোদ ছড়ায় থোরা থোরা আশা।
কন্যার স্বপ্ন-আশা ও বুকের মায়া চোখের তারায় নাচে, মুখের হাসি চোখের ভাষায় চোখের তারায় হাসে। মেন্দি সব কন্যার গায় খুঁজে পায় সুখ, সুখের জলে শীতল হয় কন্যার দুরুদুরু বুক।
এক পৃথিবী ভালোবাসা দুচোখে নাচে পাশাপাশি, শ্যাম বরণ কন্যা কাল গায়ে জড়াবে লাল বেনারসি।
আমি প্রতিনিয়ত হাঁটছি-
হাঁটতে শেখার পর থেকে হাঁটছি।
আমার হাঁটার প্রতিটি পদতল পড়ে
পিতার রেখে যাওয়া পদতল চিহ্নে।
পিতা আর আমি একই পথের যাত্রী।
হাঁটার পথে, পিতার পদতলের শেষ চিহ্নে
নিজের পদতল রেখে–
উল্লাসে গাই জীবনের জয়গান।
অতঃপর দুরন্ত গতিতে হাঁটতে গিয়ে
পৌঁছাতে দিগন্তের সুন্দর গ্রাম, দৃশ্যমান;
মাঝপথে যাই মূর্ছা —
আর মুদিত নয়নে দেখি,
আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পুত্র আমার
সেই গ্রামে পৌঁছে ব্যস্ত, পেতে নতুন দিগন্তের দিশা।
প্রাতে সূর্যের আলোর ডাকাডাকি
তার মাঝে শুনতে পাই তোমার বাণী,
কর্দমাক্ত পথের উপর যান্ত্রিক সভ্যতার নিপীড়ন
ব্যথার দগ্ধে দগ্ধ মৃত্তিকার ক্রন্দন;
সেখানে পেয়েছি তোমার দেখা
আর ক্রন্দনে মিশে আছে তোমার কথা।
রেল লাইনের পাশের ঝুপড়ি ঘরে
কোন অষ্টাদশী তরুণীর কৃত্রিম প্রেমের অকৃত্রিম আদরে
খুঁজে পেয়েছি তোমার দেখা,
তরুণীর কষ্টে ভরা হৃদয়ে বেঁধেছ বাসা।
আমার না দেখা প্রেমিকার প্রতীক্ষিত নয়নে
তুমি দিয়েছ দেখা গোপনে,
আর ডাস্টবিনে খাবারের জন্যে—
কুকুরের সাথে যুদ্ধরত শিশুদের মাঝে
তোমার পুনর্জন্ম দেখেছি প্রকাশ্যে।
কিন্তু, তোমাকে পাই নি খুঁজে—
এসি রুমের ভিতরের সাহিত্য আসরে।
কিংবা সু-সজ্জিত ঘরের নরম বিছানায়
দেহ এলিয়ে দেয়া আমার বিলাসী সত্ত্বায়;
নজরুল, আমি কখনোই খুঁজে পাইনি তোমায়।