‘দ্বিতীয় পক্ষ আবির হাসান প্রথম পক্ষ হেলেনা আকতারকে অন্যায়ভাবে মারধোর করবে না, যৌতুক দাবী করবে না, সন্তানকে ঠিকমতো ভরণ-পোষণ দিবে ও প্রথম পক্ষ দ্বিতীয় পক্ষ’র যথাযথ ন্যয়সঙ্গত আদেশ-উপদেশ মেনে চলবে এবং উভয় পক্ষ পারস্পারিক সমঝোতার মাধ্যমে সুখে-শান্তিতে বসবাস করিবেন।’ -একটি সংস্থার অফিসে বসে এরকম কিছু শর্তে স্বাক্ষর করে দ্বিতীয়বারের মতো শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন হেলেনা। ওটাকে শ্বশুরবাড়ি না বলে ‘টরচারসেল’ বলাই যুক্তিযুক্ত মনে করেন হেলেনা। কেননা ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত সেখানে চলে শারীরীক-মানষিক নানা নির্যাতন।
হেলেনা আজ শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে- একটি ব্যাটারী চালিত অটোরিক্সায়। সাথে আছে শিশুপুত্র অর্ক, টরচারসেলের প্রধান অর্কের বাবা আবির এবং শ্বশুরবাড়ির আরও কয়েকজন। বছর তিনেক আগে এমনই একটি দিনে প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলো সে। তখন কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব সাথে ছিল। বাবা-মাকে ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বছরের সিনিয়র আবিরের সাথে ঘর বাঁধার হাজারো রঙিন স্বপ্নে বিভোর ছিলো সেই যাত্রা। আর আজ! সেই একই মানুষের সাথে হাজারো দু:স্বপ্ন নিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে।
হেলেনা বাবা-মার একমাত্র সন্তান। ‘সোনার চামুচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া’ যাকে বলে হেলেনার জন্ম ছিলো সেরকম। শিল্পপতি বাবার একমাত্র সুন্দরী মেয়ে হওয়ার কারণে স্কুল জীবন থেকেই ছেলেরা লাইন দিতো হেলেনার পিছনে, কিন্তু হেলেনা সেইসবে পাত্তা না দিয়ে ঠিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলো পড়াশুনা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর, তারই ডিপার্টমেন্টের দু’বছরের সিনিয়র আবিরের প্রস্তাবে আর না করতে পারেনি হেলেনা। হেলেনা যেন আবিরের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। আবির যেন তাকে মোহগ্রস্থ করে রেখেছিলো। আবিরের প্রতিটি কথাই তার কাছে সঠিক বলে মনে হতো, তাইতো মা-বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে করার যে প্রস্তাব দিয়েছিলো আবির, তাতেও না করেনি হেলেনা। অত:পর কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে সাথে নিয়ে কাজী অফিসে এক বছরের প্রেমিক আবিরের সাথে বিয়ের পিড়িতে বসে শিল্পপতি বাবার একমাত্র মেয়ে হেলেনা। বিয়ের পর কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে সাথে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায় হেলেনা। বেশ ভালোই কাটতে থাকে দাম্পত্য জীবনের শুরুর দিনগুলো।
বিয়ের মাসখানেক পর আসল চেহারা বের হয়ে আসে আবিরের। হেলেনা বুঝতে পারে, আবির তাকে ভালোবাসেনি, আবির ভালোবেসেছিলো তার বাবার সম্পদকে। বিভিন্ন ভাবে সে হেলেনাকে বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য বলতে থাকে। কিন্তু হেলেনা কোনভাবেই তাতে রাজি হয়না। একদিন যখন হেলেনা ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য বের হয়, তখন আবির বলে- ‘তোমার আর পড়াশুনা করে কাজ নেই, তুমি বরং ঘরের কাজই দেখাশুনা করো’। হেলেনা মনে করছিলো আবির তার সাথে দুষ্টামি করছে, কিন্তু সত্যি সত্যি যখন হেলেনাকে ভার্সিটিতে যেতে দেয়া হলো না, উল্টো শুনতে হলো, অনেক গালমন্দ, সেইসাথে ভালোবাসার প্রিয় মানুষটিকে সে আবিস্কার করে, একজন ভণ্ড, প্রতারক, অর্থলোভী মানুষ হিসেবে!
এরপর প্রতিদিনই হেলেনাকে চাপ দেয়া হতো-বাবার বাড়ি যেয়ে টাকা পয়সা নিয়ে আসার। কিন্তু হেলেনা কোনভাবেই বাবার বাড়ি যেতে রাজি হতো না। যে বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে, তাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছে, বিয়েরপর জানতে পেরে তার বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছে- তাদের মেয়ে হেলেনা মারা গেছে বলেই তারা জানবে। সেই বাবা-মার কাছে কিভাবে সে যাবে, তাও আবার টাকার জন্য! যার ফলে সে যায় না। এতে করে তার উপর নেমে আসতো নির্মম অত্যাচার।
দিনদিন নির্যাতনের মাত্রা বাড়তেই থাকে। প্রতিদিনই নির্যাতনে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার কথা ভাবে হেলেনা, কিন্তু সেই পথও বন্ধ হয়ে যায় তার। কেননা, ততদিনে হেলেনা ‘কনসেপ’ করে। তার ভুলের কারণে সেতো অনাগত সন্তানকে হত্যা করতে পারেনা!
হেলেনা ভেবেছিলো, বাচ্চা হলে হয়তো নির্যাতন কমতে পারে। কিন্তু না নির্যাতন তো কমেনি বরং বেড়েছে! এখন তার সাথে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে শিশুপুত্র অর্ককেও। হেলেনা ভেবে পায় না, একটি দুধের শিশুকে কিভাবে নির্যতন করতে পারে? এরা কি মানুষ? এইসব মানুষের গল্প হেলেনা কখনও শোনেনি, আবিরের সাথে বিয়ে না হলে-এইসব মানুষের সাথে পরিচয় হওয়া হতো না। সেদিন অর্ক’র জন্য খাবার তৈরি করতে খড়ির চুলা ব্যবহার না করে গ্যাস ব্যবহার করার অপরাধে হেলেনার ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। হেলেনা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। প্রতিবেশীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। এরপর একটি সংস্থার কর্মকর্তদের সহযোগিতায় চিকিৎসা শেষে সুস্থ্য হয়ে ‘কিছু শর্তে স্বাক্ষর করে’ বাড়ি ফেরা। হেলেনা ভেবেছিলো- এবার হয়তো ভালো হবে আবির। সংস্থার আইনজীবী আপা যেভাবে বুঝিয়েছে, হয়তো কাজে আসবে। কিন্তু না; কুকুরের লেজ কোনভাবেই সোজা হয়না। সপ্তাহখানেক ভালো থাকার পর আবার সেই অত্যাচার। হেলেনা নিজের অত্যাচারকে সহ্য করতে পারে, না খেয়ে থাকতে পারে কিন্তু, তার আদরের ধন, বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন অর্ককে কিভাবে না খাইয়ে রাখবে! এরা যে অর্ককেও ঠিকভাবে খেতে দেয় না! এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়, কতদিন বাঁচা যাবে? তাহলে কি সেই পথই এবার বেঁচে নিতে হবে।
‘নির্যাতন সইতে না পেরে শিশুপুত্রকে জবাই করে মায়ের আত্মহত্যা, স্বামী গ্রেফতার’ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় খবর আসে।
এই লেখাটি #মুগ্ধতা_সাহিত্য প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত। প্রতিযোগিতার নিয়ম জানতে ক্লিক করুন এখানে