বিষয়টা এমন নয় যে উনি এলেন, লিখলেন আর জয় করলেন। সে সময় তরুণেরা লুকিয়ে চুরিয়ে শরৎচন্দ্র পড়ে, দেবদাস হতে চেষ্টা করত আমিও আমার সময়ে মায়ের বইয়ের ভাণ্ডার থেকে দেবদাস পড়ে, দেবদাস হবার চেষ্টা করতাম। উদাস হয়ে পাঞ্জাবি পরে হাঁটতাম । কেন জানি সে সময় আমার মনে হতো দেবদাস মানেই পাঞ্জাবি, খোঁচাখোঁচা দাড়ি, আর বাংলা মদ। মদ আর কই পাই, বন্ধুদের সাথে এক বোতল সেভেন আপ গেলাসে ঢেলে ভাগ করে খেতাম। মুখচোখ এমন করে কুঁচকাতাম যেন স্পিরিট গলায় ঢালছি।
শরৎ ছাড়াও ছিলো নীহার রঞ্জন গুপ্তের কিরীটী বাবু, মায়ের বইয়ের ট্রাংকে ছিলো তারাশঙ্করের গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম, মানিক বন্দোপাধ্যায় পতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মানদীর মাঝি আর ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের বই। মজা ছিল নানাবাড়িতে বেড়াতে এসে দস্যু বনহুর, কুয়াশা, তিন গোয়েন্দা পড়া।
আরও পড়ুন
প্রেমের বই পড়ার কারণেই কিনা জানি না একটু ইঁচড়েপেকে গিয়েছিলাম সে বয়সেই। ১৯৯২ সাল, সবে কলেজে উঠেছি হাতে এলো পেপারব্যাকে হুমায়ুন আহমেদের দেবী, এবং তা ছিলো জীবন মামার সংগ্রহের বই। দেবী পড়ে চমকে গিয়েছিলাম একদিনেই দ্বিতীয় খণ্ড নিশীথিনী পড়ে ফেলি। সে সময় বইগুলো কি পরিমান জনপ্রিয় হয়েছিলো, দ্বিতীয় খণ্ড নিশীথিনীতে প্রকাশকের বক্তব্য পড়লে তা বোঝা যায়।
সচরাচর প্রকাশকরা সব সময় মুখ কালো করে থাকে, ভুলেও প্রশংসা করে না। এখন আমার ঠিক মনে নেই কোন প্রকাশনী ছিল, তবে ভদ্রলোক অকুণ্ঠ প্রশংসা করে বলেছিলেন, ধন্যবাদ হুমায়ূন আহমেদকে, একটা সাধারণ প্রকাশনীকে সবার মাঝে পরিচিত করিয়ে দেবার জন্য। তা তিনি পেরেছিলেন বটে শুধু একটি প্রকাশনী না, বাংলাদেশের সমগ্র প্রকাশনী শিল্পকে নাড়িয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রথম বই নন্দিত নরকের ভূমিকায় আহমেদ শরীফের সেই প্রশংসা, এই লেখক অনেক দূর যাবে। তখন লেখক হুমায়ন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তা তিনি জীবদ্দশাতেই অনেকদুর গিয়েছিলেন বটে। বইমেলা মানেই যেন হুমায়ুন আহমেদ। একবার মজা করে বলেছিলাম, স্টলে ঘুরেফিরে বাড়ি যাবার সময় হুমায়ুন আহমেদের বই কিনে বাড়ি ফেরা মানেই বইমেলা।
রংপুরে সে সময় বইয়ের দোকান বলতে ইস্ট বেঙ্গল আর নুশিন লাইব্রেরি। টাকা জমিয়ে বই কেনা হতো এবং তার বেশিরভাগই হুমায়ুন আহমেদ। তাকে কেন্দ্র করেই আমার পাঠক হওয়া হয়তো নয় তবে তাঁর লেখা ভালো লাগত নিশ্চিত। আমার মনে হয় তার উপন্যাসের চেয়ে গল্পগুলো যতদিন যাবে ততই অমরত্বের রঙে রঞ্জিত হবে। এই মহান কথা সাহিত্যিকের প্রয়াণ দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।