মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

সক্রেটিসের শহর থেকে ৩

সুজন   দেবনাথ

২৩ এপ্রিল, ২০২০ , ৪:৫৫ অপরাহ্ণ

সক্রেটিসের শহর থেকে-৩

লেখক সুজন দেবনাথ গ্রিসের এথেন্সে বাংলাদেশ দুতাবাসের কাউন্সেলর। সেখান থেকে মুগ্ধতা ডট কমের জন্য লিখেছেন তিনি।


গতকাল গ্রিসের এক প্রফেসরের সাথে কথা হচ্ছিল। বিষয় – গ্রিস কিভাবে করোনা ঠেকাতে সফল হচ্ছে। প্রফেসর সাহেব মজা করে বললেন, ‘আমরা তো হাজার বছর ধরে মহামারি চিনি। আমরা জানি কি করতে হয়’। কথাটা মিথ্যা না। গ্রিক সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি বই – হোমারের ‘ইলিয়াদ’ আর সফোক্লিসের ‘রাজা ইডিপাস’ দুটোই শুরু হয়েছে মহামারি দিয়ে। তাই গ্রিকরা পিচ্চিকাল থেকেই জানে – মহামারি কত খারাপ জিনিস।

» কিন্তু গ্রিকরা হাজার বছর ধরে মহামারির কথা জানলেও, করোনার কথা কি জানে? করোনা একেবারে নতুন জিনিস। এটা নিয়ে কেউই কিছুই জানে না। তা সত্ত্বেও গ্রিস এখন পর্যন্ত খুবই সফল। ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত গ্রিসে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২২২৪ জন, মারা গেছেন ১০৮ জন। গত দুই দিনে ১৫ জন করে নতুন আক্রান্ত হয়েছে।  যেখানে ইউরোপের ধনী দেশগুলোতে দেড় লাখের উপরে করে আক্রান্ত, সেখানে গ্রিস অবশ্যই অনেক অনেক সফল। তো এবার দেখি – এই সফলতার কারণ কি?

» করোনা মোকাবেলায় গ্রিসের সাধারণ এপ্রোচ অন্যান্য দেশের মতোই। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায় টিভিতে দুইজন লোক আসেন। একজন হলেন – হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা সংক্রামক রোগের প্রফেসর মি. সতিরিস। তিনি খুবই মিষ্টি ভাষায় করোনার আপডেট বলেন। কতজন আক্রান্ত, কতজন মারা গেলো এসব জানান। তারপর ছোট ছোট বাক্যে অনুরোধ করেন, ‘আপনার মা-বাবাকে বাঁচান, দাদা-দাদীকে বাঁচান, প্লিস আমাদের কথা শুনুন’। এটা করুন, ওটা করবেন না এসব।  প্রফেসরের কথা শেষ হলে মাইক্রোফোন নেন সিভিল প্রটেকশান ও ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট এর ডেপুটি মন্ত্রী। তিনি কড়া করে বলেন, ‘অবস্থা খুব খারাপ, আপনারা অবশ্যই ঘরে থাকুন’। এভাবে একজন নরম আর একজন গরমে জনগণকে ব্রিফ করেন। মানুষ ওনাদের কথায় ভরসা পায়। বিশেষ করে প্রফেসর সাহেবের একটা আন্তরিক ও সিনসিয়ার ভঙ্গি আছে, যেটি তাকে খুবই জনপ্রিয় করে তুলেছে। গ্রিসের আলফা টিভির এক জরিপে এই প্রফেসর সতিরিস এখন গ্রিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। মানুষ ওনার কথা শুনছে।

» করোনা পরস্থিতিকে গ্রিক সরকার একেবারে প্রথম থেকেই খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে। টানা ১০ বছর ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে ছিলো গ্রিস। সেই সংকটের প্রথম দিকে অর্থনীতির পণ্ডিতদের কথা সরকার শোনে নি। সেই না শোনার মাসুল পুরো গ্রিক জাতি দশ বছর ধরে দিয়েছে। তখন গ্রিক সরকার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আর আইএমএফ এর সাথে টাকার জন্য প্রায় যুদ্ধ করেছে। তাই তারা বুঝেছে – বিপদে পড়লে বিশেষজ্ঞদের কথা শোনা জরুরি। করোনা পরিস্থিতিতে তারা বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি টিম করেছে। যে টিমের হলেন প্রধান হার্ভার্ড থেকে থেকে পাশ করা মিষ্টভাষী প্রফেসর সতিরিস। তিনিই প্রতিদিন সন্ধ্যায় ব্রিফ করেন।

» গ্রিকরা জানে তারা গরীব। দশ বছর ধরে বাজেট কাটতে কাটতে সব সেক্টরের মতো স্বাস্থ্যখাতও খুবই দুর্বল। তাই তারা প্রথম থেকেই প্রতিরোধের দিকে গিয়েছে। জানুয়ারিতেই এয়ারপোর্টে স্ক্রিনিং শুরু করেছে। চীন থেকে আসা ফ্লাইটগুলোকে পরীক্ষা করা শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে কার্নিভাল অনুষ্ঠান বাতিল করেছে। স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে ১০ মার্চ থেকে। ২৩ মার্চ থেকে লকড-ডাউন। খুব কড়া লকড-ডাউন। বাইরে বের হবার আগে কেন যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে সেটা লিখে একটা নম্বরে SMS করে তারপর বের হতে হবে। বিনা প্রয়োজনে বাইরে ধরলে ১৫০ ইউরো জরিমানা। একটি গাড়িতে ড্রাইভারের সাথে মাত্র একজন, মানে গাড়িতে ২ জনের বেশি চলতে পারবে না। বিনা অনুমতিতে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অফিস খুললে অনেক বড় টাকার জরিমানা। রেস্টুরেন্ট বন্ধ, শুধু হোম ডেলিভারি চালু।

» সকল সরকারী অফিস বন্ধ, শুধু চালু আছে একটা ডিজিটাল গভর্নেন্স পোর্টাল। জরুরি সিদ্ধান্তের জন্য মন্ত্রীদের মোবাইলে ডিজিটাল সিগনেচার দিয়েছে। এই অনলাইন ডিজিটাল পোর্টালে তারা চিকিৎসা ব্যবস্থা যুক্ত করেছে। কে কোথায় আক্রান্ত হচ্ছে, কোথায় কি যন্ত্রপাতি আছে, সেটা ডিজিটাল উপায়ে খুব সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারছে। প্রত্যেকের ট্যাক্স নম্বরের সাথে মেডিকেল সিস্টেম যুক্ত করেছে। তাই ডাক্তারের কাছে না গিয়েও ডাক্তারকে মোবাইলে জানালেই ডাক্তার অনলাইনে প্রেসক্রিপশন আপলোড করে দিতে পারছে। ডাক্তারের ফি ট্যাক্স নম্বর থেকে অটো কেটে যায়। ঔষধের দোকানে ট্যাক্স নম্বর দিলেই দোকানদার অনলাইন প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষধ দিয়ে দিতে পারে, ঔষধের দামও ট্যাক্স নম্বর থেকে যায়। এই অনলাইন ব্যবস্থা চিকিৎসাকে দ্রুত করেছে। দ্রুত খবর পাচ্ছে, দ্রুত কোয়ারেন্টাইন হচ্ছে, প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালে নিতে পারছে। গ্রিক সরকার বলছে, এই অনলাইন প্লাটফর্ম তাদের ডিজিটাল ওডিসি। মহাকবি হোমারের ওডিসিতে যেমন নায়ক ওডিসিয়াস দীর্ঘ কষ্টের পর ইথাকা দ্বীপে ফিরতে পেরেছিল, তেমনি এই ডিজিটাল পথে তারা করোনা মোকাবেলা করবে।

» গ্রিসে সরকার সফল, কারণ মানুষ ঘরে থাকছে। মানুষ কেন মানছে? টানা ১০ বছর অর্থনৈতিক সংকটে তারা দেখেছে, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি না করলে, জীবনে কী ভয়াবহ দুর্যোগ আসতে পারে। বাড়ি, গাড়ি, চাকরি সব কয়েক মাসেই নাই হয়ে যেতে পারে। তাই মানুষও বিশেষজ্ঞদের কথা মন থেকেই মানছে। গ্রিকরা অর্থোডক্স খ্রিস্টান, খুবই গোঁড়া। তাদের প্রধান উৎসব ইস্টার সানডে। তাদের বিশ্বাস এই সানডেতে যিশু পূর্নজন্ম নিয়েছে। খুব ঘটা করে তারা ইস্টার পালন করে। কিন্তু এবছর ইস্টার পালন করছে ঘরোয়াভাবে। সরকারকে সাহায্য করছে এখানকার পাদ্রীরা।চার্চের পাদ্রীরা ঘোষণা দিয়ে মানুষকে চার্চে না আসতে অনুরোধ করছে। মানুষ সে কথা শুনছে।

» করোনা মোকাবিলায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গ্রিক মডেল প্রশংসিত হচ্ছে। তবে এই গ্রিক মডেলের সবচেয়ে বড় দিকটি মানবিকতা। এখানে কোন ডাক্তারকে বাড়ি ছেড়ে দিতে নোটিশ দেয় না তার বাড়িওয়ালা। কোন রোগীকে চিকিৎসার জন্য একের পর এক হাসপাতালে ঘুরতে হয় না। কেউ মারা গেলে তাকে কবর দিতে কেউ বাধা দেয় না। মানবতার হাত ধরে গ্রিসের নতুন ওডিসি সফল হোক, মানুষের ওডিসি সফল হোক। ওডিসিয়াসের মতোই সব বাধা দূর করে পৃথিবী ফিরে যাক আগের দিনগুলোতে।
……………… ………………

এথেন্স, ১৮ এপ্রিল

সুজন দেবনাথ

লেখক ও কূটনীতিক। বর্তমানে এথেন্সে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর। এথেন্সের ক্ল্যাসিকাল সময়ে সক্রেটিস, প্লেটো, হেরোডটাস, সফোক্লিসদের নিয়ে সাহিত্য, থিয়েটার, ইতিহাস, দর্শন, গণতন্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্মকথা বিষয়ে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’। তিনি অব্যয় অনিন্দ্য নামে লেখালেখি শুরু করেন। এই নামে তার কবিতার বই ‘ বই খারাপের উঠোন’ এবং গল্পের বই ‘কীর্তিনাশা’। তার রচনা ও পরিচালনায় ২০১৮ সালে গ্রিসে নির্মিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম ইংরেজি গান ‘ মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে’।

 

সুজন   দেবনাথ
Latest posts by সুজন   দেবনাথ (see all)