সামিয়ার এখনো আঠারো হতে সাত মাস বাকি। মায়ের গভীর স্নেহ ও বাবার দৃঢ় অনুশাসনে বেরড় উঠতে উঠতে সবে সে ভিতরে একটা স্বায়ত্তশাসন বোধ অনুভব করছে। আজ তার একাদশ শ্রেণির প্রমোশন পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। সে অন্য সকল বিষয়ে বেশ ভালো নম্বর পেলেও জীববিজ্ঞানে অকৃতকার্য। ফল পাওয়া মাত্রই সামিয়া একটা ভীষণ দুঃখ বোধ, ভয় এবং অনিশ্চয়তার দ্বিধায় পড়ে যায়।
বাড়ি ফিরতেই তার সেই অনিশ্চয়তা সুনিশ্চিত রূপ নিয়ে প্রকাশ পেতে থাকে। তার বাবা উপজেলা কৃষি অফিসার, তিনি সামিয়ার কাছ থেকে এটা মোটেও আশা করেননি। সে প্রথম গ্রেডের নম্বর পাবে তার বাবা এটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু এটাতো তেমনতো নয়ই বরং সম্পূর্ণ বিপরীত। সামিয়ার বাবা চরম রেগে যান। তার কঠোর রাগের ভাষাগুলো খানিকটা এরকম ছিল, ‘‘এতো টাকা খরচ করছি কীসের জন্য? সমাজে আমার প্রতিপত্তি বলে থাকবে কিছু? তুই বা মুখ দেখাবি কীভাবে? আমার মেয়ে হওয়ার কোনা যোগ্যতাই অর্জন করতে পারিসনি। এর থেকে তো গলা কেটে মরে যাওয়াই ভালো।” এমন আরো কথা বলে খাবার টেবিলে যায় সামিয়ার বাবা। সেদিন সামিয়াকে খেতে ডাকে না পর্যন্ত। খাওয়া শেষে ঘুমতে যায় ওর বাবা,সাথে মাও।
তখন মধ্যরাতের শেষ অংশ। বাহিরে পরিষ্কার মাঝ আকাশে হতে চাঁদটা নুইয়ে পড়েছে খানিক। আর ক্লান্ত শেয়ালের ডাকগুলোও মৃদু হয়ে এসেছে, যেন একদম থমথমে পরিবেশ। আর তখনি সামিয়ার বাবা ঘুম থেকে উঠে কী ভেবে সামিয়ার রুমের দিকে আগান, রুমের দরজা খোলা। ভিতরে গিয়েই দেখেন সামিয়া কিছু একটা লেখা শেষ করে পড়ার টেবিল থেকে উঠছে। উঠেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার দিকে চোখ লাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে। এ চোখ মোটেও ভয়ের নয় বরং ভয় দেখাচ্ছে। সামিয়ার বাবা আস্তে আস্তে এগিয়ে টেবিলের উপরে থাকা কাগজটা হাতে নেয়, তাতে লেখা ” মাফ করো মা,তেমাকে সন্তানের অধিকার থেকে মুক্তি দিলাম, আর বাবা তুমিও। তুমি ও তোমরা সমাজে তোমাদের প্রতিপত্তি দেখলে শুধু, আমায় না।”
পড়া শেষ করা মাত্রই সামিয়ার দিকে তাকায় বাবা, আর ঠিক তক্ষণি-তক্ষণি টেবিলের উপরে থাকা ছুরি দিয়ে তার শ্বাসনালী কেটে ফেলে সামিয়া। মুহূর্তেই ঘটে যায় সব। রক্ত যেন ফিনকি দিয়ে পড়তে থাকে। সামিয়ার উষ্ণ রক্তে মুখমন্ডল ভরে যায় সামিয়ার বাবার। লাল রক্তে ভেসে যায় মেঝে। সামিয়া মৃত্যু যন্ত্রণায় বাবা বাবা বলে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে আগাতে থাকে। আস্তে আস্তে লুটিয়ে পরে মেঝেতে। সে চোখ বন্ধ করতে থাকে। হয়তো বন্ধ করতে করতে সেও ভাবে, দাইমারা তাকে জরায়ুর প্রাচীর ভেঙে আলোতে নিয়ে এসেছিল এবং আবার হয়তো সবাই ধরে তাকে শুইয়ে দেবে অন্ধকারে, আার এতটুকুর নামইতো জীবন। তবে এ জীবনেও সে বাঁচার অধিকার হারাল কেন?
এর মাঝেও তার বাবা আগাতে পারেন না, কী একটা ভীষণ বাধায় তার পা মেঝের সাথে আটকে গেছে। তিনি ভাবেন, এগুলোতো তারই কথা, তারই বিষ। তার চোখে পানি আসে না। তিনি বৃষ্টিতে ভেজার মতো করে ঘামতে থাকেন। এভাবে হঠাৎ মাইকে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সামিয়ার বাবার। ভীষণ ভয় পান তিনি। সব কিছু বুঝে ওঠার পর দ্রুত পায়ে আগান সামিয়ার রুমের দিকে।তখনো বাহিরে আজানের সুর ছাড়া কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। জানালার পাশে এসে কপাট ঠেলে দেখেন সামিয়া ঘুমোচ্ছে। সামিয়ার বাবার কান্নায় ভেঙে পড়েন, পা ভেঙে আসে,মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। ভাবতে থাকেন তবে সত্যিই কি এগুলো স্বপ্ন ছিল? এগুলোর তো সত্যি হওয়ার অভ্যাস আছে রোজ রোজ!