ডিগ্রীতে পড়ি। বয়স কুড়িমতো হইবে। দুরবিন দিয়া খুঁজিয়া সারা মুখে কতক বাদামী পশম দেখিতে পাই। আমার নাকের নিচে, ডানে বামের অনুর্বর অঞ্চলে কিছুই জন্মায় না। নিজেকে বড় নাবালক লাগে। ডিগ্রীতে পড়া ছেলেদের কারো কারো ঝাঁকড়া চুল তাহাতে আবার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে কেতাদুরস্ত ভাব লইয়া প্যান্টের ব্যাকপকেটে ভাঁজকরা রেখা খাতা লইয়া যখন কলেজে আসে, মাঠে ঘোরে, কলেজের পুকুরপাড়ে তাসের আড্ডায় চুল ঝাঁপিয়ে ট্রাম্পকার্ড ছুঁড়ে বিপক্ষকে ঘায়েল করে কিংবা মেয়েদের দলে বসে বাদাম খুলটে ফু দেয়- আমি ছেলে মানুষটা সেইসব ছেলেদের প্রেমে পড়িয়া যাই। ভাবি, আমার ইহজীবনে কিছুই হইবে না। ক্লিনশেভড মুখ আর সাথে তেমন ঝুলপি চুল যদি রাখিতে পারিতাম তবে আমার মতো সুখী মানুষ বুঝি কমই হইত। কিন্তু তেমন করিয়া রাখিতে পারিব না, কারণ বাবা তাহা পছন্দ করিবেন না। তিনি কঠিনধাতের মানুষ। অতিবাস্তববাদী লোক। তিনি নিজে সর্বদা ক্লিন শেভ করিয়া থাকেন। তাই সেটাতে অসুবিধা হইবার কথা নহে। তাই সাবালকত্ব লাভের জন্য সেটার চিন্তা করিতেছি।
দোয়ানী বাজারের আজিজুল আমার বাল্যবন্ধু। ও যখন ক্লাশ নাইনে পড়ে তখন ওর সারামুখে ঘনকালো দৃশ্যমান দাড়ি, মোচ। আমি তখন ইন্টারমিডেয়েট সেকেন্ড ইয়ার। খুব বড়রা বাদ দিয়ে পাড়ায় কোন সিনিয়র জুনিয়র নাই। সবাই ভাইভাই, বন্ধু বা বন্ধুর মতো। কিভাবে যেন তাহার সাথে খুব ঘনিষ্ট হইলাম, জানি না। সেই স্বল্পবয়সেই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতাম। ঠিক সেসময়ই আফসোস করিতাম, আহা, আমার যদি এই মুখখানা হইত! শুধু হাপিত্যেস করিতাম আর ভাবিতাম, কখনো কী আমার তেমন হইবে? ডানহস্তে, বাঁহস্তে নিজের বদনখানি নাড়িচাড়ি আর ভাবি, আমি কি তবে বড় হইবো না?
সেইসবদিনে হকবাজারের বিখ্যাত ভোলা নাপিত যখন বন্ধুর চুল, দাড়ি কাটে আমি অপলক চাহিয়া থাকিতাম। অন্য চেয়ারে বসিয়া মাঝেমধ্যে প্রমানসাইজ আয়নায় আমার নিরসবদনখানি দেখিতাম আর মনে মনে প্রার্থণা করিতাম যেন দ্রুত আমারো তাহার মতো হয়।
কিন্তু যাহা তাহাই! যাহার হয় তাহারই হয়। আমার তাহা নহে।
বন্ধু আমার দু:খ বোঝে। আমি তখন বি, এ ফার্স্ট ইয়ার। আর সে পড়ালেখা বাদ দিয়া বাড়ির সামনে মুদিখানা দিল। বিকাল, সন্ধ্যায় তাহার দোকানে আড্ডা মারি আর তাহার সোনাবদনখানি দেখে দেখে কতশত গল্প করি। কথাচ্ছলে সে-ই একদিন বলিল, “শেভ কর্। দুই-চারিবার ক্ষুর পড়িলে প্রচুর গজাইবে।” কথাখানা একান্তই আমার মনের কথা। তাই মনে ধরিলো। এই না হইলে বন্ধু কিসের! বন্ধুই তো বন্ধুর গোপন কথা, মনের ব্যথা বুঝিবে, স্বাভাবিক।
ভাবলাম, তথাস্তু!
বন্ধু যেহেতু মুদিখানা সামলাইতে ব্যস্ত। তাহার আর আমাকে সঙ্গ দেবার সময় নাই বা অযথা ঘোরাঘুরি তাহার শোভা পায় না। তাহার সাথে প্লান প্রোগ্রাম ঠিক করিলাম বটে, কিন্তু একাই যাইতে হইবে এবং তা-ই সাব্যস্ত করিলাম।
বাড়ি হইতে তিনকিলোমিটার দূরে খানসামা হাট। সেইদিকে যাইবো। শুক্কোরবার আর সোমবার হাটবার। হাট শুরু হয় দুপুরের নামাযবাদ। সেই হাট জমাইয়া তোলার জন্য কাজকারবার শুরু হয় সকালবেলা থেকে। ধোয়ামোছাসহ ইত্যকার কাজ। বাঁশের ফোল্লা ( ব্যাঙ্ক) কেটে লুঙ্গির খোঁটে ত্রিশ টাকা রাখিলাম। আমাদের বাজারের নাপিত চুলদাড়ি শেভ করা পাঁচ, ছয় টাকা নেয়। শুধু দাড়ি শেভ করিতে তিন টাকা লাগিত। কেউ কেউ দুই টাকাও দিয়া থাকেন। নাপিতরাও সেইটাকা কপালে ঠেকাইয়া ক্যাশবাক্সে রাখিতেন। খানসামায় যদি অনেক বেশি চায় বা নেয়, তাই অপদস্ত হইবার ভয়ে ত্রিশ টাকাই লুঙ্গির কোঁচে রাখিলাম। এখানে বলিয়া রাখি, আমাদের ছাত্রাবস্থায় গ্রামাঞ্চলে তখনো ফুলপ্যান্ট পরে ঘোরার চল শুরু হয়নি। শহরে চলে সেটা বেশ। তবে দু’একজন, যারা শহরে পড়িত, হোস্টেলে বা মেসে থাকিত, সেসময় তাহাদের কেউ কেউ গ্রামে আসিলে প্যান্ট পরিয়া বেড়াইত। অবশ্য আরামকে ভুলে সেটা মেয়েদের দেখানো বা উন্নতজাতের ছাত্র হিসেবে নিজেকে তুলিয়া ধরিতে তাহা করিত। কিন্তু আমরা যাহারা নিয়মিত গ্রামে থাকি তাহারা কখনো নয়। এমনকি শহরে সিনেমা দেখিতে যাইতাম লুঙ্গি পরিয়া। অন্য আরেকটা সত্য হইল আমাদের কেহ কেহ লুঙ্গি পরেই কলেজে ক্লাশ করিতো পিছনে বসিয়া।
যাইহোক, বিভিন্ন ঘোরা পথ ব্যবহার করিয়া হাঁটিয়া হাঁটিয়া খানসামা হাটের দিকে যাই আর পিছন ফিরিয়া দেখি কেউ আমাকে দেখিতেছে কি না। চেনাশোনা কাউকে দেখিলে বড়সড় কোন গাছের আড়ালে বা পথের ধারে বাঁশঝাড়ে লুকাইয়া পড়িতাম।
কুড়ি মিনিটের পথকে ঘন্টা বানাইয়া অবশেষে হাটে এসে বিক্ষিপ্তভাবে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করিয়া দেখি তুলে বসিয়া পাশাপাশি দুইজন নাপিত বিরসবদনে বসিয়া আছে খদ্দেরের আশায়। না, তাহাদের নিকট যাইবো না। রাস্তার পাশে চাকচিক্যময় এক নাপিতের দোকানে সুযোগ নিলাম। দোকান ছিল ফাঁকা। সাহস করিয়া চেয়ারে বসিলাম। বলিলাম, চাচা, আমাকে শেভ করিয়া দিন। শরীরখানা একটু নড়াচড়া করিলেই আয়নায় মুখখানা এমনভাবে উঠানামা করিতেছিল মনে হইল যেন আমাকে ব্যঙ্গ করিতেছে। তখন চেয়ারটাকে তপ্ত উনুন মনে হইতেছিল। নাপিত চাচা দ্রুতই সাদা কাপড়ে পেঁচাইয়া মুখে পানি মাখিলে, ক্রীম ঘষে ব্রাশে ফেনা তুলিলে একটা স্বর্গীয় আবেশ ভর করিল। বারবার কৌশল করিয়া চক্ষু ঘুরাইয়া দোকানের বাহিরে দেখি, কেউ আবার দেখিতেছে কিনা। ভেতরে একটা ছটফটানি কাজ করিতেছিল। যাইহোক, নাপিতের নিকট প্রত্যাশিত কাজটা করাইয়া শেষে বিপদে পড়িলাম। এই মুখ নিয়া কেমনে গ্রামে ঢুকিবো? সবাই যে দেখিতে পাইবে। সে আর এক ভীষণ জ্বালা হইলো। বুকে সাহস আনিয়া নাকে হাত দিয়া, কখনো গাল চুলকাইয়া চুলকাইয়া মুখখানা আড়াল করিয়া আগেরমতো করিয়া বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করিলাম। আবার সাবালকত্ব লাভে মনে মনে পুলকিত হইতেছিলাম। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত পুরুষতো হইলাম! মেয়েদের কারো কারো মুখ মনে ভাসে তখন। শরীরটা চনমন করে। সারাবিকাল দিগ্বিদিক ঘোরাঘুরি করিয়া সন্ধ্যার অন্ধকারে বাড়িতে আসিয়া হাত-মুখ ধুইয়া খাবার চাইলাম। মা হারিকেনের আলোতে টের পায় নাই। তারপরও মুখ ঢাকিয়া খাইলাম। পড়িতে বসিলাম। পড়া ভাল্লাগে না। আমার মানিব্যাগের ছোট একটা আয়নায় নিজের সোনাবদন দেখি আর পুলকিত হই। ভাবি, বালিকা মহলে বুক উঁচু করিয়া কথা বলিবার অধিকার পাইলাম।
যাইহোক, সেইসব প্রেমপ্রীতির কথা বা কাহিনি অন্য একদিন বলিব। যে দাড়ি, মোচের জন্য এত কাণ্ড আজ তাহারই জন্য বিরক্ত বোধ করি। দাড়ি, মোচ শেভ করিবার মতো অসহ্য কাজ আর দ্বিতীয়টি নাই।
সুন্দর