মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

সোমেশ্বরী, তুমিই তো এ নদী

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ

২৮ অক্টোবর, ২০২১ , ২:৫৮ অপরাহ্ণ

সোমেশ্বরী, তুমিই তো এ নদী

যখন কবি জাকির বলল ছাতা নিয়ে যেতে হবে, তখুনি মনে খটকা। মধ্য কার্তিকে, বর্ষা ছাড়াই বর্ষাতি? তার অবশ্য কারণও আছে, গত কয়েকদিন ধরে সারাদেশে টানা বৃষ্টি চলছে। না জানি কী হয়? ভ্রমণ মানেই তো রোমাঞ্চ,নতুন পথ, নতুন জানাশোনা। একঘেয়ে এ জীবন। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা, অফিস, বাসা, আলু, পটল, মাছ কেনা। সাপের মতো খোলস বদলাতেই তো ভ্রমণ । পরিকল্পনা, ট্যুর শিডিউল , ব্যাগ গুছানো শেষ। সব পিছুটান, অভিমান, সন্দেহকে পাশ কাটিয়ে চেপে বসি রাতের বাসে। কিশোরগঞ্জগামী সে বাসের নাম বেস্ট ওয়ান।

হতেই হবে, আমাদের কবি মজনুর ট্যুর প্লান বেস্ট না হয়ে কি পারে? বাস ছাড়ল, ছাড়তে না ছাড়তেই ছড়াকার অপুর শুরু হলো গান। তবে সে গান ভেসে যায় শব্দে। খটরমটর ননএসি বাস যে। বাস চলছে, জানলা দিয়ে শীতল বাতাস। না গরম না শীত। কার্তিক মাসের রাত। ঝকঝকে আকাশে রূপালি থালার মতো চাঁদ আর মিষ্টি ঠাণ্ডা হওয়া। অতি ধীরগতির বেস্ট ওয়ান রাত একটায় এসে পৌঁছলো জাব্বার হোটেল মাঝিড়া, শাজাহানপুর, বগুড়া (জ্বী ঠিকই পড়ছেন জব্বার না, জাব্বার হোটেল)। যা হয় আর কি, মোটামুটি মানের বাস, গিয়ে থামে সেই মোটামুটি মানের হোটেলের সামনে। ভাগাভাগি করে খাবার কিছু পেটে চালান করে আবারও ছুটে চলা।

নিশ্চয়ই নামাজ ঘুম অপেক্ষা উত্তম

রাস্তা তো মসৃণ না, তার উপর অযথা হর্ন ঝিমুতে ঝিমুতে পুরাতন ব্রক্ষপুত্র নদীর তীরে, ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের জয় বাংলা চত্ত্বরের সামনের মসজিদে নামাজের বিরতি। কবি মজনুর আর প্রাবন্ধিক সুমনের নামাজের তাড়া। শীতের বাতাসে শরীরে আর মনে জাগে চনমনে ভাব। সবে জেগে উঠছে লোকালয়, আমাদের কারো কারো চোখে তখনও ঘুম। এরমাঝেও থেমে নেই ছবি তোলা। আধোআলো আধো অন্ধকারে ছবি তোলা চলে মোবাইলে। ময়মনসিংহের জয় বাংলা চত্ত্বরের তুলনায় রংপুরের জয় বাংলা চত্ত্বর বড়ই ম্রিয়মান মনে হয়। তাড়া আসে গাড়ি থেকে,আবারও চড়ে বসা গাড়িতে, সূর্য ততক্ষণে জানানো শুরু করে দিয়েছে  তার দাপট। আজ দিনটা গরম যাবে হয়তো।

বাতাসে নদীর ঘ্রাণ

ডাঙার মানুষ তবুও জলে স্বস্তি। কিশোরগঞ্জ শহরে গাড়ি পৌঁছল সকাল সাতটায়। ছোট ভাই মানিকের বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হওয়া। এবার শহর ঘুরে ঘুরে এসে ভিড়ি বালিখোলা, করিমগঞ্জের ঘাটে। এরই মাঝে চোখে ঠাঁই করে নিয়েছে কিশোরগঞ্জ শোলাকিয়া ঈদগাহ্ মাঠ, শহীদি মসজিদ। মিডিয়ার ওভার রেটেড শোলাকিয়া ঈদগাহ্ মাঠ বড়ই অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে। আমরা চুঁনোপুটি নেতার জন্যও তোরণ বানাই কিন্তু এখানে নেই কোনো তোরণ এমনকি একটা সাইনবোর্ড পর্যন্তও নাই। ঘাট মানেই ব্যস্ততা। যাওয়া আসার মিলনক্ষেত্র। কেউ কারো মুখের দিকে না তাকিয়েই চলে যাচ্ছে ,ব্যস্ত ভঙ্গিতে।  আমরা যাব মিঠামইন। ডেলু নদীতে উন্মত্ততা না থাকলেও আমাদের  মনে তখন জোয়ার। নৌকা ভাসে ডেলু নদীতে। মাঝি ইউসুফ আর তার সহকর্মী বুলেট পাল ছাড়া নৌকার হাল ধরে শক্ত হাতে। ছোট ছোট ঢেউ কেটে এগিয়ে চলে নৌকা। পাশ দিয়ে একটা বড় ট্রলার গেলে  সেই ছোট ঢেউগুলো বড় হয়ে ভয় ধরানো দুলুনি দিতে থাকে। নৌকার দুলুনিতে আমার রবীন্দ্রনাথের কথা মাথায় আসে। রবীন্দ্রনাথ বিলেতে যাচ্ছেন ব্যারিস্টারি পড়তে জাহাজে করে। জাহাজের দুলুনিতে রবীন্দ্রনাথের প্রাণ যায়-যায় অবস্থা। বমি আর মাথা ঘুরানি। নিজেকে বন্দি করে রাখে কেবিনে। শুধু পানি খেয়ে থাকা। পরে এক বিদেশীর যত্ন-আত্তিতে হালে পানি পাওয়া। তখন আকাশ স্বচ্ছ নীল, গুটি কয়েক চিল ভেসে আছে অলস ভঙ্গিতে। ঝাঁঝালো রোদও কেটে কেটে যায় নদীর বাতাসে। শরীরে সুখজাগানী অনুভূতি। গানে গানে মুখরিত চারপাশ। অপুর কারাওকি স্পিকারে পালা করে চলে গান। সবার তখন মন আঁচড়ে গান তুলে আনা। রোদের তাপ বাড়ে, বাড়ে ক্লান্তি, মনে আর কন্ঠে। কপালে জমে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নদীতে এসে নদীকে আলিঙ্গন না করতে পারা হতভাগা হতে চাই না বলেই ঝাপিয়ে পড়ি ঘোলা নদীর জলে। নদীতে হুটোপুটি আর সাঁতার। শরীরকে শান্ত আর ক্লান্ত করে পাটাতনে পা রেখে চোখ রাখি দূর জনপদের দিকে। নদীর ঘাটে নৌকা ভেড়ে,পা পড়ে এক সম্পূর্ণ অজানা অচেনা মিঠামইনে।

সোনালি বিকেল, স্বপ্ন রাঙা সকাল

হোটেল পাঁচ ফোড়ন এ দুপুরের খাবার তেমন জমেনি। মাছটি বোয়াল ছিল কি ছিল না, তা নিয়ে লেগেছিল দ্বন্দ্ব। আমরা নিশ্চিত মাছটি বেয়াল না, ফলে চিংড়ি দিয়ে সাদা ভাত। বিকালে প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের বাসভবনে ঘুরাঘুরি। রাতে যে হোটেলে খাওয়া হলো তার নাম ‘চাপ সামলাও’। আমাদের অবশ্য কোনও চাপ নাই। নাই ঘরে ফেরার তাড়া। রাত শিশু থেকে তরুণ। আমরা চলে যাই অলওয়েদার রোডে। হাওরকে ঘিরে রাস্তার কাটাকুটি। সে রাস্তায় কবি মজনুর চাঁদকে সাক্ষী রেখে ফেসবুক লাইভ করে। একে একে সবাই সবার কবিতা পড়ি। শেষ হয় সমবেত কণ্ঠের গান দিয়ে। তখন বাতাসে হাওড় থেকে ভেসে আসা ভেজা বাতাসে নাকে লাগে নাম না জানা মিশ্র গন্ধ। আকাশের চাঁদ তখন সবে যুবক। ডালিম ফাটা আলোয় আলোকিত তখন দিগন্তবিস্তৃত হাওড়।

ফিরে যাওয়া শুরুতে

সকাল ঠিক সাতটায় মিঠামইন থেকে ট্রলার ছাড়ল। যাবে বালুখালি ঘাট, কিশোরগঞ্জ। শান্ত নদী, শুধু জেগে উঠেছে নদীর দুধারের লোকজন।  জীবনের তাগিদে জেলেরা মাছ ধরছে ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে। মিঠামইনে কাঠের ব্যবসা মনে হয় ভালো। নদীর দুপাড়ে সার করে রাখা গাছের গুঁড়ি। নদীতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভারী গুঁড়ি। সব  মালামাল বহন নৌকায় করে। মাঝ নদীতে সড়ক পথের ব্যস্ততা। দূর দৃষ্টি সীমার মাঝে নদীর কূল, ট্রলারের ঘটঘট শব্দ, আর পানির শব্দ ছাড়া সব শ্রুতির অতীত। আশেপাশের যাত্রীদের চোখেমুখে নির্লিপ্ততা। নদী কি তবে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে?

রুম নম্বর ২০৭

সিএনজি যখন মেঠোপথ, দুধারে বাঁশ, সারি-সারি গাছ আর বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে YWCA ডরমেটরির সামনে এসে দাঁড়ালো আমরা ততক্ষণে ক্লান্ত। দোতলা লম্বা শশার মতো বিল্ডিং। সিঁড়ি উঠে গেছে মাঝ বরাবর। দোতলার ২০৭ নম্বর রুম। একরুমে মোটে দশজন। পরিস্কার ঝকঝকে তকতকে। সবই ভালো তবে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেনি। সতেরো বার হজ্জ্ব টিমমেটদের খিদমত করা সুমন সবকিছু ম্যানেজ করছিল, খাওয়া-দাওয়া, টাকার হিসাব। ফলে নিশ্চিন্ত যাত্রীর মতো আমার শুধু দুচোখ ভরে উপভোগ করা। হাজং ও গারোদের সাথে বাঙালি মিলেমিশে বসবাস এ এলাকায় নারী ও পুরুষদের শিক্ষার জন্য গড়ে ওঠে বিভিন্ন বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তারমধ্যে মেয়েদের জন্য young women christian Association (YWCA) আর ছেলেদের জন্য Young men christian Association (YMCA). এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ট্রেনিং নিতে আসা এবং পর্যটনে আসা লোকজনদের জন্য তৈরী করে দুটি ডরমেটরি। তার একটিতে আমরা ছিলাম। মূলত ধর্ম প্রচারের জন্য এদেশে এলেও সেবা এবং শিক্ষায় খ্রিষ্টান মিশনারিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারাদেশে। সুন্দর ছিমছাম সকালে দোতলার ছাদের পাশে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠা সেগুনগাছ। কয়েকটা শালিক খুব মারামারি করছে নিজেদের মাঝে। শ্যাওলা ধরা ছাদ চারিদিকে গাছগাছালির ফাঁকে -ফাঁকে কিছু বাড়ি। বোঝা যায় এখনও ব্যবসায়ীদের লোলুপ দৃষ্টি পরে নাই তবে কতদিন থাকবে বলা মুশকিল। পাশের রুমেই একজন উঠেছে এখানে রিসোর্ট করবে। তার কাজ শুরু হয়েছে। তাঁবুরও নাকি ব্যবস্থা থাকবে সেখানে। বুঝি, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। প্রকৃতি ধ্বংস করে কৃত্রিমতায় বুঁদ হচ্ছে মানুষ। ছাদ থেকে আরও পরিস্কার হয় ডরমেটরির সামনের বাগান। স্থলপদ্ম, আরও অনেক নাম না জানা ফুলের গাছ। গাছে বেঁধে দেওয়া অর্কিড। অর্কিডগুলোর ফুল আসলে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর লাগবে। বাগান পেরিয়ে একটি বাঁশের পাটাতনের উপর তৈরি মঞ্চ। উপরে খড়ের ছাদ। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য চমৎকার ব্যবস্থা। নিচ থেকে ডাক আসে, বেরিয়ে যেতে হবে বিজয়পুর চীনা মাটির পাহাড়, জিরো পয়েন্টে আর সোমেশ্বরীর কাছে।

আহা সোমেশ্বরী!

নৌকা চালক হামজা যখন বলল, চলেন জিরো পয়েন্ট থেকে ঘুরিয়ে আনি। আমরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে। যেতে চেয়েছিলাম সিএনজি করে কিন্তু বিজিবি আটকিয়ে দিলো। কবি হাই হাফিজ ভাইয়ের প্রাণান্ত চেষ্টাও খারিজ হয়ে গেল। পাত্তাই দিলো না আমাদের, ভাবখানা বড় সন্ত্রাসী আমরা। আমাদের কারণে দেশের সার্বভৌমত্বের মহা ক্ষতি হয়ে যাবে অথচ বিজিবিতে সৈন্যপদে চাকরি করে একেকজন পাঁচতলা বাড়ির মালিক হয়ে যায় এক দুই বছরের মাঝেই। নদী সোমেশ্বরী শান্ত। পানি শীতল এবং স্বচ্ছ। পাশের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝর্ণাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতমিলে সোমেশ্বরী নদীর সৃষ্টি। এক সময় নদীটি সিমসাং নামে পরিচিত ছিল। ৬৮৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সিদ্ধপুরুষ অত্রাঞ্চল দখল করে নেওয়ার পর থেকে নদীটি সোমেশ্বরী নামে পরিচিতি পায়। মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার (পূর্ব নাম বঙ বাজার) হয়ে বাংলাদেশের রাণীখং পাহাড়ের কাছ দিয়ে সোমেশ্বরী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। শীত কাছে, এখুনি নদীতে পানি নেই। চর পড়েছে, হেঁটে যাওয়া  যাবে মাঝ নদী পর্যন্ত। নদীতে কয়লা সংগ্রহ করছে স্থানীয় মানুষেরা। এক মণ আটশত টাকা। এ নদীর আর একটি বৈশিষ্ট্য, দুপাড় অনেক উঁচু। নদীতে সীমানা রেখা বেঁধে দিয়েছে লাল পতাকা বাঁধা খুঁটি। মানুষ বাঁধা গেলেও পানি, পাখি, বাতাস মুক্ত। তারা কোনও সীমানা মানে না। হাত দিয়ে শীতল পানি দিয়ে ধুয়ে নিই মুখ, ভিজিয়ে নিই মাথা। পানির অপর নাম জীবন। কয়লা শ্রমিক  রফিকুল বালু খুঁড়ে পানি বিশুদ্ধ পানি নিয়ে আসে। প্রাকৃতিক ফিল্টার, কী দরকার পিওর ইট, ফ্রীজ। একটু খুঁড়লেই বিশুদ্ধ ঠাণ্ডা পানি। জীবনটা জটিল করে তুলেছে মানুষই। জীবন তো সহজ, সরল, শান্ত সোমেশ্বরীর মতোই। এখানে কোলাহল নেই, নেই নষ্ট প্রতিযোগিতা। একটুতেই সুখি হওয়া মানুষগুলোকে হিংসে হয়। উঁচু নদীর পাড়ের ওপারেই লোকালয়, আদিবাসী পল্লী। যেতে নিষেধ করে মাঝি। ওরা নাকি পছন্দ করে না। করবেই বা কেন? আগাগোড়া মেকিতে মোড়া এই আমি শহুরে মানুষ। শরীরজুড়ে শুধু অহংকার, হিংসে আর নষ্ট প্রতিযোগিতায় লিপ্ত প্রতিটি শহুরে মানুষ বড় বেমানান এখানে।

তোমরা জগতের সর্বত্রই যাও,আর বিশ্ব সৃষ্টির কাছে ঘোষণা করো মঙ্গল সমাচার

সাধু যোসেফের ধর্মপল্লীর গেটের ভিতর দিকে লেখা এ বাণী পড়ি আর মনে-মনে আওড়াই। শহরের কোলাহল থেকে দূরে যাকে বলে ঠিক থমাস হারডির উপন্যাস Far from the madding crowd মতো। রাণীখং টিলার ঠিক উপরে একটি গীর্জা। জানা গেলো অনেক আগে এ অঞ্চলে বাস করতো ‘খং রাণী ‘নামে এক রাক্ষস। তাকে হত্যা করে গারো আদিবাসীরা। ফিরে আসে শান্তি। তারপর থেকেই এ অঞ্চলের নাম রাণীখং।পাহাড়ের গা কেটে বানানো হয়েছে ইট-সিমেন্টের পথ। পাহাড়ে নাম না জানা গাছ, পাখির কলোতান। পাশেই বয়ে চলছে সোমেশ্বরী। প্রতিষ্ঠা সময় ১৯১২। রাণীখং এর এই দূর্গম এলাকায় কেনই বা গড়ে উঠলো, জানি না। বিভিন্ন সূত্র মতে, এই স্থানের গারো সম্প্রদায় বিশ্বের প্রথম ক্যাথলিক ধর্মে ধর্মান্তরিত গারো সম্প্রদায়। ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ এডলফ ফ্রান্সিস নামের একজন ফাদার প্রথম একদল গারো নারী-পুরুষকে খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষা দেন। তার মাধ্যমেই এখানে খৃষ্ট ধর্ম প্রচার এবং বিস্তার লাভ করে। প্রবেশমুখেই হাতের ডানে সেন্ট জোসেফের ডিসপেনসারি, প্রতিষ্ঠা কাল ১৯৩৬। এ প্রসঙ্গে না লিখে পারছি না,১৮৪০ সালে বৃহত্তর রংপুর জেলায় কুন্ডি পরগনার জমিদার রায় রাজমোহন চৌধুরীর স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত করা হয় রংপুর ডিসপেনসারী যা পরবর্তীতে পরিচিতি পায় রংপুর সদর হাসপাতাল নামে। ডিসপেনসারি দেখার পর আবারও পা কে কষ্ট দিয়ে উঁচুতে ওঠা। পরপর তিনটা গেট পেরিয়ে ধর্মপল্লী আর গীর্জা। কম করে একশত ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে গির্জার ঘন্টা। হয়তো এখনও বাজানো হয় একশত বছর আগেও ঠিক যেভাবে বাজানো হতো। গির্জার সামনেই জোসেফের ও শিশু যীশু কোলে এক ভাস্কর্য। ক্যাথলিক গির্জা বলেই হয়তো এ গির্জার নিচে, হাতের বামে ধর্মপাল বিশপ হার্থ সহ আরও পাঁচ হাজং আদিবাসীর ভাস্কর্য। করোনাকালীন এ সময়ে তাদেরও পরিয়ে রাখা হয়েছে মাস্ক। মুর্তির পায়ের কাছেই লেখা গারো অঞ্চলে ক্যাথলিক ধর্ম শুরুর ইতিহাস। লোকালয় থেকে দূরে, কোলাহলমুক্ত পরিবেশে মন শান্ত হয়। সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রেমের কাব্যোপন্যাস শবনমের কথায়, মন গঙ্গাফড়িঙের মতো। ক্ষণে সে এদিকে লাফ দেয়, ক্ষণে ওদিকে লাফ দেয়। এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে চায় না। মনকে শান্ত করো। মন শান্ত হলেই মালিক তাঁর ছায়া ফেলবেন। তোমার অগম্য কিছুই থাকবে না’

জলের মাঝে কার ছায়া গো

সাপের মতো আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। রাস্তাজুড়ে ছায়ার কাটাকুটি। একটা দুটা শালিক আর দোয়েল ইতিউতি উড়ছে। দুপুরের রোদ জানান দিচ্ছে, শীতের কারণে চলে যাচ্ছি বটে তবে আবার আসব আরও তাপ নিয়ে। বিজয়পুর চীনা মাটির পাহাড়ের অপর পিঠেই নীল পানির পুকুর। বদ্ধ নীল পানিতে দাপাদাপি করছে দুটি শিশু। সেন্টমার্টিন ছাড়া এমন নীল এবারই দেখলাম সোমেশ্বরী নদী আর এই নীল পানির পুকুরে। কেমন করে নীল হলো এ পানি জানা নেই, অগভীর এ পুকুরের নীল হবার পিছনে কোন রাসায়নিক পদার্থ হতে পারে। নামার ইচ্ছে ছিলো না। বদ্ধ পানি মানেই অপরিছন্ন। তারপরও কবি জাকিরের জোরাজুরিতে নামতে হলো। পানিতে নামা মানেই সেই পানি মুখে দিয়ে কুলি করা। গোসল করার পর কবি হাই হাফিজ ভাই জানালেন, পুকুরপার জুড়ে হলুদ মানববিষ্টা। হবেই বা না কেন? পর্যটন  এ এলাকায় নেই কোন ওয়াসরুম। জনগণের  চাপ পেতেই পারে তখন তারা চাপ সামলাবে কীভাবে? পর্যটন করপোরেশন এখন ব্যস্ত বিয়ে, আকিকা, সেমিনার করার জন্য রুম ভাড়া দেয়া নেয়ার জন্য। আমার পরিচিতির গণ্ডি খুবই কম, তবুও জানতে ইচ্ছে করে, কারা এসব করপোরেশনের বড়বাবু। গোসল করার পর আর কিছু করার থাকে না,খাওয়া ছাড়া। এখানে ভারতীয় পণ্যের ছড়াছড়ি। প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে কসমেটিক, চা পাতা,চকলেট,সিগারেট, বিয়ার। রাজস্ব হারাচ্ছে দেশ। প্রশাসন বড়ই কড়া। ভ্রমনকারীকে আটকায়, চোরাকারবারিকে সুযোগ দেয়। এখানে খাওয়ার মতো কিছুই নেই। ক্লান্ত শরীর টেনে নিয়ে যাই আবারও সোমেশ্বরীর তীরে। ঘাটে বসে থাকি অপার হয়ে,ফেরি নৌকার আশায়। একটি মাত্র নৌকা,সারাদিন যাওয়া আসা করে। ঘাটে নৌকা ভিড়ে, উঠে পরি। আবারও তাকাই সোমেশ্বরীর দিকে। জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো-

আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;

বলেছিলোঃ ‘এ নদীর জল

তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল;

সব ক্লান্তি রক্তের থেকে

স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;

এই নদী তুমি।’

নদীর পানি গালে ছুঁয়াই আলতো করে, সোমেশ্বরী  ফিসফিস করে বলে, আবার আসবেন তো বাবু——

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ
Latest posts by ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ (see all)