মেয়েটির চোখের পাতা যেন কিছুতেই নামছে না, কেমন মেয়ে গো বাবা! এমন ভাবে কেউ অপরিচিত কারো দিকে তাকিয়ে থাকে নাকি? কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। নাহ, ঠিক তেমনভাবে মনেও পড়ছে না যে, কোথায় দেখা হয়েছিল তার সাথে! আজকালকার মেয়েদের স্বভাবেই মনে হয় এমন! আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিকের দিকে ধাবিত হচ্ছে আর ইচ্ছেগুলিকে লালন করছে একা একা। আচ্ছা, সে কি আমাকে চেনে? নাকি এমন ভাবে দেখে দেখে চিনবার চেষ্টা করছে যে, গত জন্মে পাখি হয়ে এসেছিলাম আর সেই পাখির লালনকর্তা ছিল এই মেয়েটি। মাঝে মাঝে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উদাস হচ্ছে, যেন কতো কালের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে সে।
অপরিচিত মানুষের এমন তাকিয়ে থাকা দেখে মাথাটা আরো ভনভন্ করতে থাকে রুদ্রের। রুদ্র, অবসরপ্রাপ্ত পিতার মধ্যবিত্ত পরিবারে মাস্টার্স করা বেকার ছেলে। চাকরি নামে হরিণের কস্তুরি খুঁজতে প্রতিনিয়ত ঢাকা যেতে হয় চিড়িয়াখানার টিকিট হাতে নিয়ে। নিরাশ হয়ে ফিরে আসে, আবার যায়, আবার…।
নিরাপত্তার জন্য বাসের চেয়ে ট্রেনে যাতায়ত করে বেশি, তাছাড়া ভাড়াও কম, এই আর কি। তবে বৃটিশ নিয়মের ভিতর আজো সময়কে বন্দি করে রেখেছে ট্রেন, অর্থাৎ দুই ঘণ্টা থেকে ট্রেনের অপেক্ষা। স্টেশনে ঝুলানো সময়সূচী মতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ছেড়ে যাবে ট্রেন কিন্তু রাত ন’টার কাঁটা ছুঁইছুঁই করছে ট্রেনের খবর নেই রংপুর স্টেশনে। প্লাটফার্মের পিলারের নিচে সানবাঁধানো গোল বেঞ্চে বসে আছে সেই মেয়েটি। এবার সে আরো গভীরভাবে তাকাতে শুরু করেছে। ভালো মতো লক্ষ্য করে দেখার জন্য চোখে চোখ রাখতেই চোখ ফিরিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে যায় মেয়েটি। সেই সুযোগে দূর থেকে ভালো করে দেখে নেয় রুদ্র। নাহ্ তার পাশে তেমন কাউকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যারা আছেন, তারা কেউ আপন বলে মনে হলো না। যে যার মতো যাত্রী হয়ে আপন খেয়ালে অপেক্ষা করছে ট্রেন আসার জন্য। বাদাম বিক্রেতা এসে রুদ্রের গা ঘেঁষে দাঁড়ি বলে-‘স্যার বাদাম খাইমেন?’ ‘না’, সংক্ষিপ্ত উত্তর শুনে সামনের দিকে এগিয়ে যায় বাদাম বিক্রেতা। হঠাৎ করে বসে থাকা মানুষগুলো আড়মোড় ভেঙে উঠে দাঁড়াতে উদ্যাত, মনে হয় ট্রেন আসার খবর হয়েছে। রুদ্র নিজেও মানুষিকভাবে প্রস্তুতি নিতে নিতে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন বাবাজি স্টেশনের প্লটফার্মে। অপেক্ষার প্রহর থেকে মুক্ত যাত্রীরা। গোল বেঞ্চের দিকে এগিয়ে এসে চোখ আটকে যায় রুদ্রের। আর দেখা যাচ্ছে না মেয়েটিকে, মনে হয় বগির দিকে চলে গেছে। যাক বাঁচা গেল।
ট্রেনে উঠে নিজ সিটে কার যেন হাতব্যাগ লক্ষ্য করে রুদ্র। কোনো নারীর ব্যাগ নিশ্চয়ই। পাশের সিটে বসে মাথা নিচু করে মোবাইল ফোনে কারো সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে এক সুন্দরী মেয়ে। ‘ব্যাগ কার’, বাতাসে কথা ছুড়ে দিয়ে টিকিট হাতে রুদ্র আবার সিট নাম্বার মিলিয়ে নিশ্চিত হয়- এই সিটই হয়। কোনো সাড়া না পেয়ে আবার বলে- ‘ব্যাগ কার, এই সিটটা আমার’। মোবাইলের ভিতর থেকে আস্তে করে মাথা তুলতে তুলতে মেয়েটি বলে- ‘সরি, এটা আমার ব্যাগ’। ব্যাগটি নিজের আয়ত্বে নিয়ে আবার ডুবে যায় মোবাইল মোহনায়। মেয়েটি তার মাথা পুরোটা তুলতেই অবাক হয়ে যায় রুদ্র। আরে, এ তো সেই মেয়ে! যে আমাকে নিরলস ভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো প্লাটফর্মে। কি যে আবিস্কার করলো আমাথেকে এখনো তো বুঝতে পারিনি। তার উপর পাশের সিটে সিট পড়েছো ট্রেনের। জানিনা আজ কপালে কি আছে। আরো কতো কি যে আবিস্কার করবে আমায় দেখে দেখে। কবি, নাকি চিত্রশিল্পী। আমাকে দেখে দেখে কবিতা লিখবে- নাকি ছবি আঁকবার পাঁয়তারা! আমায় দেখে যদি তার মনে এমন মন-ভাবনা জাগে তাহলে অনায়াসে সে পাগল, নয়তো এই লাইনে নতুন এসেছে। কারণ, তার আবিস্কারের জন্য মনে হয় আমার মতো বেকার বালক যথেষ্ট নই। সিগন্যালম্যানের সবুজ পতাকার ইশারায় ট্রেন ছেড়ে দিলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। লোহার চাকাগুলো রেল লাইনের উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে ঘুরতে শুরু করে। একটু একটু করে গতি বাড়ে, গতি বাড়তে বাড়তে দ্রুত চলতে থাকে ট্রেন।
‘হ্যালো বাবা। হ্যাঁ, বাবা তুমি আমাকে শুনতে পাচ্ছো না? বাবা এইমাত্র ট্রেন ছেড়েছে, আমি আসছি বাবা, না তেমন কোনো সমস্যা নেই, তুমি কোনো চিন্তা করবে না। রাখছি বাবা, ট্রেন থেকে নেমে তোমাকে ফোন দেবো।’ মেয়েটি তার বাবার সাথেই ফোনে কথা বলেছে বলে মনে করে রুদ্র। ছুটে চলা ট্রেনের সাথে সাথে ছুটছে গাছপালা খাল-বিল, ফসলি জমি। যেন ট্রেনের সাথে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে সব কিছুকে। ট্রেনের ভিতরে যার যার মতো আসনে বসে যাত্রীরা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত, কেউ পত্রিকা মেলে নিজেকে আড়াল করে নিজ মনে পত্রিকা পড়ে যাচ্ছে, আবার কেউ ঝিমোচ্ছে অভ্যাসের বসবর্তী হয়ে। কারো কোলের সন্তানকে আঁচলের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে দুগ্ধপান করাচ্ছেন মা।
কাকে যেন ভালোবেসে প্রায়শ্চিত্বের অন্ধকার গিলে খাচ্ছে চাঁদ। সম্ভবত আজ পূর্ণিমা। রুদ্রর পাশে বসে থাকা মেয়েটিও জানালা দিয়ে চাঁদের আলোয় বিচ্ছুরিত প্রকৃতির চলমান সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত। তার ছেড়ে দেওয়া রেশমী দীঘল চুলগুলো বাতাসের ঝাপটায় নৃত্য করতে করতে রুদ্রর শরীর স্পর্শ করে। কথনো কখনো বেওয়ারিশ বাতাসে ওড়না উড়ে এসে ছুঁয়ে যায় মুখাবয়ব। রুদ্র এক প্রকার বিরক্ত বোধ করে। মেয়েটি জানালার বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে, রুদ্রের দিকে আড় চোখে তাকায় বারবার। অন্যমনস্ক রুদ্র বুঝতে পারে তাকেই দেখছে, কিছু বলে না, ধীরে ধীরে চিনবার চেষ্টা করে আবারো। হঠাৎ মেয়েটির হাত ফসকে মোবাইল ফোন পড়ে যায় সিটের নিচে। মোবাইল ফোন তুলতে নিচে ঝুঁকে পড়ে মেয়েটি। সিটের নিচে অস্পষ্ট আলোয় হাতড়াতে থাকে। মোবাইল ফোন খুঁজে না পেয়ে মাথা তোলে মেয়েটি, ইস্কুজমি, আমার মোবাইল ফোন হাত থেকে নিচে পড়ে গেছে, খুঁজে পাচ্ছি না, আপনার কাছে কি টর্চ হবে, অথবা এজাতীয় কিছু?’ মেয়েটির কণ্ঠে বেশ অনুযোগ। রুদ্র কোনো কথা না বলে মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে মেয়েটির মোবাইল ফোন খুঁজে দেয় সিটের নিচ থেকে। ‘ধন্যবাদ’ বলে মোবাইল হাতে নিয়ে মেয়েটি ঝুঁকে পড়ে মোবাইলের স্ক্রীনে। বেশ কিছুক্ষণ পর মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সরাসরি রুদ্রকে প্রশ্ন করে বসে- ‘আপনি আজব মানুষ তো! সেই রংপুর স্টেশনের প্লাটফার্ম থেকে আপনাকে চিনবার চেষ্টা করছি, বারবার তাকাচ্ছিলাম আপনার চোখের দিকে অথচ কিছুতেই আপনার পরিচয় জানাতে আমাকে সাহায্য করছেন না’। হঠাৎ মেয়েটির এমন কথা শুনে হকচকিয়ে ওঠে রুদ্র।‘জ্বী, মানে, আমাকে বলছেন?’
‘জ্বী, আপনাকে বলছি। আপনি ছাড়া আমার পাশে আর কে আছে? দেখছেন না সামনের সিট দুটি খালি।’ চটপট জবাব দিয়ে আগের প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় থাকে মেয়েটি। রুদ্র পুরাই ‘থ’ হয়ে যায়। মেয়ে তো নয় যেন কাঁচালঙ্কা। তার পরও ভদ্রতার খাতিরে পরিচয়টুকু দেবার কথা ভাবে, ‘আমি রুদ্র, রংপুর শহরে থাকি, ঢাকায় যাচ্ছি চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে। আপনি আমাকে চিনবার চেষ্টা করছেন! কেন, বলবেন কি?’
‘কেন আবার, মনে হলো কোথায় যেন দেখেছিলাম, তাই আবিস্কার করার চেষ্টা, এই আর কি। আবার কাকতলীয় ভাবে পাশাপাশি সিটও মিলে গেছে। কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পাচ্ছিনা। মেয়েটির কথা শুনে হতবাক রুদ্র- ‘আপনি বলবেন কি? আপনাকে কোথায় দেখেছিলাম? কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনতে পাচ্ছিনা আর ভাবছিও না, যে কোথায় আমাকে দেখেছেন।’ কারণ আপনার ভাবনা আপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে ভাবতে থাবেন, আমি আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারছি না। রুদ্র একটানা কথাগুলো বলে চাঁদের আলো দেখতে দৃষ্টি নিয়ে নিয়ে যায় জানালার বাইরে।
‘আপনি তো আজব লোক জনাব!
‘কেন? এবার সরাসারি মেয়েটির দিকে তাকায় রুদ্র।
‘কেন আবার, জানতেও চাইলেন না আমি কে, কোথা থেকে এসেছি কোথায় যাবো, কি করি। আপনি জানতে না চাইলেও আমাকে বলতে হবে কারণ, আপনি যেহেতু আপনার পরিচয়টা বলেছেন। ‘আমি নিশীথা, ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ি, বাড়ি ঢাকাতেই, রংপুর এসেছিলাম আপার বাসায় বেড়াতে।’ নিজ থেকে কথাগুলো বলে রুদ্রকে।
মেয়েটির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ব্যাঙ্গ করে রুদ্র বলে- ‘আজ চলে যাচ্ছেন, তাই তো? আর কিছু বলার আছে আপনার?’
‘হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। দেখুন, পাশাপাশি সিটে বসে যেহেতু ঢাকা পর্যন্ত যেতে হবে, সেহেতু মাঝপথে ছোট্ট করে একটা বন্ধুত্ব করাই যায়, কী বলেন? জার্নি বাই ফ্রেন্ডস। তাছাড়া সেই সময়ের মধ্যে যদি আপনাকে চিনে ফেলতে পারি, তাহলে তো আরো ভালো। তাই নয় কী?’
মেয়েটি, অর্থাৎ নিশীথার কথা শুনে রুদ্রের মনে হলো- এতো করে যখন বলছে, তাছাড়া যদি বের করা যায় যে, নিশীথা সত্যিই কারো সাথে আমাকে মিলানো বৃথা চেষ্টা করছে। ‘আচ্ছা নী- মানে…’
‘নিশীথা, আপনি আমার নাম ধরে ডাকতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই। বলুন কি বলতে চাইছেন।’
‘আসলে যদি খোলাখুলি ভাবে বলতেন- কার খোঁজে আমাকে রিমান্ডে নিলেন? কে সেই মহাপুরুষ, কি নাম তার, কোথায় থাকেন, কি করেন, কবে-কোথায় তাকে দেখেছেন, কিভাবে হারিয়ে ফেলেছেন, কথা হয়েছে কি না, কথা হলে- কি ধরনের কথা বলেছেন এবং কেন খুঁজতে চাইছেন তাকে। আচ্ছা, আপনি কি তার প্রেমে পড়েছিলেন?কেন বলুন তো’, প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় নিশীথা। ‘না, বলতে চাইছিলাম আপনার সেই মানুষকে চিনছেন না কেন।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, সেবার চট্টগ্রাম মামার বাসা থেকে ফেরার সময় ট্রেনে আপনার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। কথা হয়েছিল, কতোভাবে আমাকে জেনে নিলেন, বগিতে আলো কম থাকার কারণে ঠিক মতো আপনাকে মনে রাখতে পারিনি, তবে কথা বলার ভঙ্গি, বাড়ি ঠিকানা, বেকার, চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ছুটছেন দিগি¦দিক, আপনার শহরে এলে দেখা করতে বলেছিলেন, আবার ঢাকায় আমার সাথে দেখা করার জন্য কথা দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য বসতঃ সেদিন আপনার নামটা আমার জানা হয়নি, তার আগেই তো ট্রেন লইনচ্যুত হয়ে আমাদের বগিসহ চারটি বগি উল্টে গিয়েছিল, সেই যে হারিয়ে গেলেন আর খোঁজ পেলাম না আপনার। সেই থেকে অনেক অনেক খুঁজেছি আপনাকে। দুর্ঘটনায় আপনার কিছু হলো কিনা তা জানার জন্য। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। আর আজ কাকতলীয় ভাবে পেয়ে গেলম আপনাকে। প্রকৃতির কি এক মায়ার খেলায় হারিয়ে যাবার আড়াই বছর পর আপনাকে পেলাম ষ্টেশনের প্লাটফার্মে। আবার একই ট্রেনে পাশাপাশি যাত্রী হয়ে ঢাকা যাচ্ছি। আপনি যাচ্ছেন চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে আর আমি যাচ্ছি বাসায়, কি অদ্ভুত ব্যাপার তাই না?’ রুদ্রের দিকে না তাকিয়ে খুব সহজ ভাবে ফিরিস্তি দিয়ে গেল নিশীথা, যেন হারিয়ে যাওয়া কতো আপন মানুষকে খুঁজে পেয়েছে। তাকে কিভাবে বোঝাবো যে, তার গল্পের চরিত্রে এই রুদ্র ছিল না। তবুও পরিষ্কার করা দরকার। নিশিথাকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়ে যায় রুদ্র। দেখুন আপনি কোথাও ভুল করছেন হয়তো। সেই ভুল থেকে ভুলভাল বলে যাচ্ছেন, তাও আবার আমাকে নিয়ে। আপনার নাম না জানা সেই মানুষ আসলে আমি নই। আমি তো আপনার সাথে কেন- কোনো নারীর সাথে একই ট্রেনে করে পাশাপাশি বসে যাত্রা করিনি। কখনো ট্রেন দুর্ঘটনায় পরিনি, আর সব চেয়ে বড় কথা হলো, আমার জীবনে আমি কখনো চট্টগ্রাম যাইনি। এবার বুঝতে পেরেছেন?
দেখুন আমার কোনো ভুল হচ্ছে না, ভুল আপনি করছেন রুদ্র, যে স্মৃতি আড়াই বছর থেকে বয়ে নিয়ে চলছি তা কেমন করে ভুল হয়। তাছাড়া আমি তো আপনার কাছে অধিকার নিয়ে আসিনি যে, আপনার সেই দিনের কথা মতো আমাকে গ্রহণ করতেই হবে। আপনি বলেছিলেন সম্পর্ক করা যায় কিনা, আমি ভবতে চেয়েছি, ক্যাম্পাসে দেখা করতে চেয়েও দেখা করেননি। ট্রেন দুর্ঘটনার পর আপনাকে না দেখে ভেবেছিলাম…। তারপর অপেক্ষা করেছি, এই বুঝি পিছন থেকে কেউ নিশীথা বলে ডাক দিয়ে বলবে- আমি সেই, ট্রেনে পরিচয় হয়েছিল! কিন্ত না, আজ আপনি সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে বসলেন! যাক, আপনাকে দেখলাম, আপনি বেঁচে আছেন, ভালো আছেন তাতেই আমি তৃপ্ত’। বলেই দু’হতে মুখ লুকিয়ে ফোঁপতে থাকে নিশীথা।
রুদ্র এবার বাকরুদ্ধ। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে যায় তার। হাসবে না কাঁদবে তারও হিসাব ঠিক মিলাতে পারে না। ‘নিশীথা, আপনি শান্ত হোন প্লীজ, আমি কথা দিচ্ছি ঢাকায় আমার চাকরিটা হয়ে গেলে নাম না জানা আপনার সেই লোকটিকে খুঁজে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। আমাকে নিয়ে অযথা ভুল ভাবনায় নিজেকে আর জড়াবেন না। আমি অত্যন্ত নিরীহ এবং অবসরপ্রাপ্ত বাবার বেকার ছেলে।’
কথাগুলো বলে জনালার বাইরে ছুড়ে দেয় আপন দৃষ্টি। চাঁদ ঢলতে শুরু করেছে তার ঝলকিত আলো বিলিয়ে দিয়ে। আগের মতো আলো আর দেখা যাচ্ছে না, বাইরের রূপ সৌন্দর্য ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে আসছে, বনভূমিতে নেমে আসতে চাইছে অন্ধকারের থাবা, ভোর হয়ে আসার পাঁয়তারা চালায় নির্ঘুম রাত। হালকা বাতাস ঢুকছে জানালা ভেদ করে, সেই বাতাস থেকে একটু একটু ঠাণ্ডা বোধ হতে থাকে রুদ্রের, তাই জানালা বন্ধ করে দিয়ে নিশীথার দিকে তাকায়, এখনো ঠিক আগের মতো দু’হাতে মুখ ঢেকে সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। আমার কথায় মনে হয় বেশি কষ্ট পেয়েছে মেয়েটি। হঠাৎ নিশীথার মোবাইল থেকে রিংটোন বেজে উঠে, তড়িঘড়ি করে সাইটব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে রিসিভ করে, জড়ানো কণ্ঠে কথা বলার ধরণ শুনে মনে হলো, তার বাবা ফোন করেছে। হয়তো কোথায় আছে তার কুশলাদি জানার জন্যই ফোন করে থাকতে পারে। তবে পথ যে আর বেশি নেই জানালা খুলে বাইরে দেখে তার বাবাকে জানান দেওয়ার মাধ্যমে বুঝতে কষ্টহলো না। নিশীথা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ছুটে চলা ট্রেনের ভিতর ডালিম ফোটা ভোরের কুশমিত আলো ফেলেছে নতুন সূর্য। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনের গতি একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে। আবারও হুইসেল। দীর্ঘ যাত্রা শেষ করে কমলাপুর রেল ষ্টেশনে প্রবেশ করে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি। ততক্ষণে আড়মোড় ভেঙেছে অনেক যাত্রী। নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে নিশীথা। তার চোখ দুটি ফুলে উঠেছে, হয়তো রাত জেগে ট্রেনে জার্নি করার কারণে হতে পারে হয়তো, নয়তো ভুলের ভারে কেঁদেছে কিছু সময়।
রুদ্র প্রস্তুতি নিতে নিতে নিশীথা কোনো কথা না বলে কানে ফোন লাগিয়ে হন্ হন্ করে নেমে যায় ট্রেন থেকে। নিশীথার পিছু নিয়ে ষ্টেশনের প্লাটফার্মে নেমে আসে রুদ্র। ততক্ষণে এক বয়ষ্ক ভদ্রলোকের পাশে দাঁড়িয়েছে নিশীথা। রুদ্রকে দেখে রেগে যায়, বলে- আপনি, আপনি একটা স্বার্থপর মানুষ, মানুষকে মূল্যায়ন করতে জানেন না, এতোদিন পর দেখেও আমাকে সারাসরি অস্বীকার করেছেন। আপনি কথা দিয়ে কথা রাখেননি উল্টো আমাকে টেনশনে রেখেছেন আড়াই বছর থেকে। বাবা, এই সেই ছেলে, ট্রেন দুর্ঘটনার পর থেকে যাকে অনেক খুঁজেছি, এই ছেলেকেই খুঁজে দিতে বলেছিলাম তোমাকে। আজ ট্রেনে দেখা হবার পর সে বলছে, সে নাকি আমাকে চেনেই না’। নিশ্চুপ রুদ্রের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, ভদ্রলোকেই নিশীথার বাবা। মেয়ের কথা শুনে ভদ্রলোক মুখ খোলেন। ‘আপনি কে বাবা? কি হয়েছে নিশীথার সাথে, নিশীথা আমারই মেয়ে।’
‘আমি রুদ্র, রংপুর থেকে চাকরির পরীক্ষা দিতে এসেছি, তাকে আমি কখনো দেখিনি কিংবা নাম পর্যন্ত জানতাম না, অথচ কার সাথে যেন বর্ণনায় মিলিয়ে আমাকে জড়ালেন, আমি খুবই বিব্রত বোধ করেছি’।
‘দেখেন বাবা, আমি সব বুঝতে পেরেছি, আপনার সাথে এমন করাটা মোটেও ঠিক হয়নি। মেয়েটা আমার এমন ছিল না, পড়াশুনায় অনেক ভালো ছিল। সেবার ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হবার এক সপ্তাহ পরে, অর্থাৎ দেড় বছর আগে প্রচন্ড জ্বর হয়েছিল, প্রতিদিন নিয়ম মতো ওষুধ খাওয়ার পরও জ্বর কিছুতেই নামছিল না, সপ্তাহ পেরিয়ে দশদিন যায় অথচ জ্বর কমানোর কোনো নাম নেই, বড় ডাক্তার দেখিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করার পর টাইফয়েড ধরা পরে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
বাবার কথাগুলো শুনে নিশীথা চুপসে যেতে থাকে ঘঁষা খাওয়া বেলুনের মতো। রুদ্র মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে বলে- ‘তারপর’। ‘তারপর সব শেষ। তারপর, মাথায় আঘাত হানে টাইফয়েড। সেই থেকে মাথা এলোমোলো। যখন মনে যা আসে তাই বলে, তখন তাই করে। তবে সব কিছুই গুছিয়ে বলতে পারে- করতে পারে,। যেখানে যাবে সেখানকার গল্পই সে তৈরি করে বলতে পারে। অপরিচিত কারো বুঝবার উপায় নেই যে, সে এমন রোগ বহন করে চলছে দীর্ঘদিন থেকে। আর এই এলোমেলো মাঝে মাঝে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। অল্প কিছু দিনের জন্য আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়, কিন্তু তখন আগের কোনো কিছু মনে করতে পারেনা। অনেক চিকিৎসা করানোর পরও কোনো কাজ হয়নি। পথে আপনাকে এমন বিভ্রান্ত করার জন্য সত্যি আমি লজ্জিত। ওর হয়ে আপনার কাছে জোড়হাতে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’
চোখ বেয়ে জল নেমে আসতে চাইছে ভদ্রলোক- অর্থাৎ নিশীথার বাবার। ‘না, না ঠিক আছে, ক্ষমা চাওয়ার কি আছে। তাছাড়া সবই যখন জানলাম, তখন দুঃখিত হওয়া ছাড়া আমারই বা আর কি করার আছে।’
বাবা পারলে পাগল মেয়েটাকে ক্ষমা করে দিবেন।’ বলে নিশীথার হাত ধরে প্লাটফার্মের বাইরে বড় রাস্তার দিকে পা বাড়ায় দু’জনে। তাদের দিকে অপলক তাকিয়ে চলে যাওয়া দেখে রুদ্র। দেখতে দেখতে এক সময় রাজধানীর হাজরো মানুষের ভীরে মিলিয়ে যায় তারা।।