রংপুরের খ্যাতিমান ছড়াকার ও গীতিকার একেএম শহীদুর রহমান বিশুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ছড়াসাহিত্য ও সাংগঠনিক দিক থেকে তাঁর অবদান অসামান্য। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক নজরুল মৃধা। সাথে রইল তাঁর একটি অগ্রন্থিত ছড়া।
নজরুল মৃধা
তার বয়স হলেও তিনি ছিলেন স্বাস্থ্য সচেতন একজন মানুষ। মিশতেন তরুণদের সাথে। তরুণদের মত চলাফেরা করতেন পোষাকআশাক থেকে সব ক্ষেত্রেই তিনি তারুণ্য বজায় রাখার চেষ্টা করতো।
করোনাকালেও কবি ও ছড়াকার একেএম শহীদুর রহমান বিশুদা অনেকের খবর নিয়েছেন। ভালমন্দ জিজ্ঞেস করেছেন। করোনার এই ৫ মাসে আমাকে বিশুদা ৪ বার মোবাইলে ফোন করেছেন। প্রতিবারই জিজ্ঞেস করেছেন কেমন আছ। তোমার হার্টের সমস্যা। স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখবা। বাইরের খাবার খাবেনা। জনসমাগম এড়িয়ে চলবে ইত্যাদি। এমন সদউপদেশ দেয়া মানুষটি হঠাৎ করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুর খবর যখন শুনলাম প্রথমে বিশ্বাসই হয়। কারণ তার বয়স হলেও তিনি ছিলেন স্বাস্থ্য সচেতন একজন মানুষ। মিশতেন তরুণদের সাথে। তরুণদের মত চলাফেরা করতেন। পোষাকআশাক থেকে সব ক্ষেত্রেই তিনি তারুণ্য বজায় রাখার চেষ্টা করতো।
এই মানুষটির সাথে প্রথম পরিচয় কবে হয়েছিল তা মনে নেই। ৮০ দশকের মাঝামাঝি কবি বাদল রহমানের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছে এটুকু মনে রয়েছে। এরপর অভিযাত্রিকে তার সাথে দেখা হত। তিনি অভিযাত্রিকের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি সাহিত্য বিশেষ করে ছড়া নিয়ে বেশি আলোচনা করতেন। সেই তখন থেকে তার সাথে মেশা শুরু। শেষ দেখা হল ২০২০ সালের ৯ আগস্টে মাওলানা কেরামত আলী সাহেবের মাজার প্রাঙ্গনে। এখানে আমরা সবাই সরব থাকলেও তিনি ছিলেন নিরব নিথর। নিঃপ্রাণ দেহে খাটে শুয়ে থাকা মানুষকে মনে হয়েছিল মৃত্যুর পরেও তিনি তারুণ্যকে ধরে রেখেছেন। সত্যি এমন সদাহাস্যোজ্জল মানুষকে হারিয়ে রংপুরবাসি একজন গুণি ব্যক্তিকে হারালো। তিনি পল্লীকবি জসিমউদ্দিন,কবি কাজী কাদের নেওয়াজসহ অনেক গুণি মানুষের প্রিয়পাত্র ছিলেন। আমি যে অফিসে কাজ করি সেখানে প্রায়ই আসতেন। নিজের রচিত ছড়ার পাশাপাশি নতুনদের লেখা দিতেন ছাপানোর জন্য। তিনি সব সময় নতুনদের উৎসাহ দিতেন। এটাই ছিল তার স্বভাব। নেশাও বলা চলে।
আমি ছান্দসিক সাহিত্য সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী করতাম। প্রতি শুক্রবার আমাদের সাপ্তাহিক আসর হত। তিনি প্রায়ই আসরে আসতেন। আসরে পঠিত লেখাগুলো নিয়ে তিনিই আলোচনা করতেন। মাঝে মধ্যে আসরে নতুন লেখক নিয়ে আসতেন। তিনি সব সময় সাহিত্যের পাশাপাশি সংগঠনকে কিভাবে এগিয়ে নেয়া যায় এই পরামর্শই দিতেন।
তার সাহিত্য প্রীতির একটি উদাহরণ দিতে চাই। ছান্দসিকের আসরে একদিন ইতিহাস লেখক বন্ধু জোবায়ের আলী জুয়েলের সাথে আমার ঝগড়া হয়। সেই থেকে জুয়েলের সাথে আমার কথাবার্তা বন্ধ। এবিষয়টি অনেকে মজার চোখে দেখতো। অনেকে আমাদের ঝগড়া মিটমাট না করে উল্টো উস্কে দিত। হঠাৎ একদিন বিশুদা আমার অফিসে এসে বললেন চলো সুনীলের দোকানে চা খেয়ে আসি। তার কথামত সুনীলের চায়ের দোকানে গিয়ে দেখি সেখানে জোবায়ের আলী জুয়েল বসে আছে। এসময় বিশুদা বললেন অতিতে যা হওয়ার হয়েছে এখন দুজন মিটমাট করে নেও। বিশুদার কথামত আমরা দুজনের আবার এক হলাম।
ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট লেখক আনিসুল হকের সাথে কথা হয়। তিনি প্রথমেই বললেন বিশুদা কেমন আছেন। ঢাকায় অনেক কবি সাহিত্যিকদের সাথে দেখা হলে তারা প্রথমেই জিজ্ঞেস করতেন বিশুদা কেমন আছেন। তিনি এটা অর্জন করেছিলেন। উত্তরাঞ্চলের মানুষ সব সময় অবহেলিত বলে কবি নূরুল ইসলাম কাব্য বিনোদের মত বিশুদাও সাহিত্যাঙ্গনে মূল্যায়িত না হয়ে চলে গেলেন।
১৯৫৮ সালে একেএম শহীদুর রহমান বিশু’র প্রথম ছড়ার বই ‘অর্পণ’ প্রকাশিত হয় সত্তরের দশকের প্রথম দিকে দিনাজপুরে জেলা স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক কবি কাজী কাদের নেওয়াজ ও নাজিমুদ্দিন হলের প্রতিষ্ঠাতা হেমায়েত আলীর আহবানে নওরোজ সাহিত্য আসরে কবিতা পড়তে যেতেন তিনি। রংপুরে তিনিই সাপ্তাহিক সাহিত্য আসরের সূচনা করেছিলেন। ১৯৬২ সালে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রস্থ ‘অপেক্ষা’ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের পান্ডুলিপি দেখে দিয়েছিলেন পল্লীকবি জসিমউদ্দিন এবং ভূমিকা লিখেছিলেন কাজী কাদের নেওয়াজ। ১৯৬৪ সালে চিত্রনায়ক রহমানের ‘মিলন’ ছায়াছবিতে অভিনয় করেন তিনি। ১৯৬৬ সালে তিনি রেডিও পাকিস্তানের রাজশাহী কেন্দ্রের অনুমোদিত গীতিকার হন। ‘৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রংপুর রেডিওতে তাঁর প্রথম ঈদের গান প্রচারিত হয়। রংপুর ও রাজশাহী রেডিওর জন্য তিনি অসংখ্য ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি, আধুনিক, বাউল, ইসলামী, ভাটিয়ালী, ঠুমরি, রাগ প্রধান ও গজলসহ নানা ধরনের গান ও গীতি-নকশা লেখেন। ২০০৩ সাল পর্যন্ত অভিযাত্রিকের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৯০-৯৬ পর্যন্ত দৈনিক যুগের আলোর সাহিত্য পাতার দায়িত্বপালন করেন। সর্বশেষ ‘উত্তরমেঘ’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। সবশেষে বলতে চাই অনন্তলোকে অফুরন্ত ভাল থাকবেন এটাই প্রত্যাশা করছি। সেই সাথে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করবো জীবদ্দশায় যা পারেননি মৃত্যুর পরে একটু হলেও বিশুদাকে মূল্যয়ন করুন।
নজরুল মৃধা
কবি ও সাংবাদিক, রংপুর।
মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ্
একদিন রাত দশটার দিকে বিশুদার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছিলাম। বিশুদাকে বললাম, এই আশি ছুঁইছুঁই বয়সেও আপনি আমাদের থেকেও ফিট। কোন গোপন রহস্য আছে? তিনি হাসি দিয়ে বললেন, সাইফুল্লাহ্! জ্বর সর্দি ছাড়া আলহামদুলিল্লাহ আমার জীবনে কোন জটিল রোগ হয়নি। সারাজীবন নিয়ম মেনে চলেছি আর তরকারিতে একদম ঝোল খাইনি।
বিশুদা গোছানো আর পরিপাটি থাকতেন সবসময়। পোশাক আশাক ছিলো রুচিসম্মত। তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। কাগজ দিয়ে খাম বানিয়ে সেখানে ছড়া কবিতা পিনআপ করে রাখতেন। সাহিত্যের কোন আসর অনুষ্ঠানে লিখে আনা কবিতাই পাঠ করতেন। নিজে এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন বলেই সবাইকে বলতেন কবিতা পৃষ্ঠায় লিখে আনতে। হাস্যকর পরিবেশ তৈরি হয় যখন আমাদের তথাকথিত সাহিত্য বোদ্ধারা মঞ্চে কিংবা আসরে কবিতা পাঠ করার আগে আশেপাশের মানুষকে ছবি তোলার হুকুম জারি করে এবং মাউথপিস হাতে নিয়ে মোবাইলে কবিতা বের করতে দীর্ঘ সময় নেয়। তারপর কবিতা পাঠ করে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করে।
এরকম পঁচা পঁচা দৃশ্যগুলো দেখে আফসোস করতেন আমাদের বিশুদা। সাহিত্য নিয়ে তিনি সবসময় কঠোর ছিলেন। কখনো একচুল ছাড় দিতেন না। লেখা ভালো হলে বলতেন, তোমার লেখা ভালো হচ্ছে। চালিয়ে যাও কিংবা তোমার লেখার এই যায়গায় সমস্যা আছে ঠিক করে নিও। কোন আড্ডায় কেউ মোবাইল বের করলে তিনি বিরক্ত হতেন। ফোন পকেটে রাখার অনুরোধ করতেন।
বিশুদা এসব বিষয়ে কঠোর ছিলেন কিন্তু আমরা অনেকেই কঠোর হতে পারি না। ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়ার ভান করে ছেড়ে দেই। এখন বাহ চমৎকার সুন্দর অনবদ্য অসাধারণ এই শব্দগুলোকে রেপ করে সাহিত্যের বিচার করি। আমরা সাহিত্যের মানের চেয়ে শোঅফকে প্রাধান্য দেই। লেখা যেমনই হোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি পোস্ট করতে পারাটাকেই আনন্দ হিসেবে গ্রহণ করি।
আমরা কতদূর এগিয়ে যাবো? এই মোহের জগতে, ভার্চুয়াল জগতে গা ভাসিয়ে কতদিনই বা টিকে থাকবো?
বিশুদা বেঁচে থাকুক আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের চলার পথে। লৌকিকতা আর ভাঁড়ামোর বিদায়ে শুরু হোক সুস্থ সাহিত্য চর্চা।
অর্থ পাচার তথ্য পাচার হচ্ছে পাচার
দেশের লোক।
আমরা নাচার,
আন্ধ চোখ।
পাতি নেতার লম্বা হাত
করছে তারাই বাজি মাৎ
আমজনতা কুপোকাত।
চলছে ভাষণ চলছে শাসন বাড়ছে আসন
দলের লোক
সত্য কথন
বন্ধ চোখ।
দেশের টাকা হচ্ছে লুট
দূর্নীতিবাজ হচ্ছে ফুট
ছি! বুড়ি তোর গোল্লাছুট।