দুই বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ পরলোক গমণ করেছেন গতকাল। তাঁকে স্মরণ করেছেন ফেরদৌস রহমান পলাশ।
তাঁর লেখা অসংখ্য বইয়ের মাঝে প্রথম পড়ি, ‘হলুদ বসন্ত’। সময়টা ১৯৯৩ হবে। তরুণ বয়স, মনে যতো না প্রেম তারচেয়েও বেশি বিরহ। ‘হলুদ বসন্ত’ সেটা আরও চাগিয়ে দিলো। তরুণদের প্রেমিক হতে শেখা তো সেই ‘হলুদ বসন্ত’ থেকেই। এরপর ‘একটু উষ্ণতার জন্য’। তারপর আর থেমে থাকা হয়নি, মাধুকরী, অভিলাষ, বাবলি, কোয়েলের কাছে, সবিনয় নিবেদন, সুখের কাছে, ওয়াইকিকি, সম, অববাহিকা, ঋজুদার সাথে রহস্য সন্ধানে গিয়েছি কতবার! প্রকৃতি আর বুদ্ধদেব গুহ যেন মিলেমিশে একাকার এক নাম। ছিলেন গায়ক,ছবি আঁকতেন, লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, রহস্যোপন্যাস, পত্রোপন্যাস, ছোটদের জন্যেও লিখেছেন, তাঁর শিকার কাহিনী তাঁকে নিয়ে গেছে এক অন্যরকম উচ্চতায়।
সেই বুদ্ধদেব গুহের ছেলেবেলা কিন্তু কেটেছিল এই রংপুরে। ১৯৩৬ সালে ২৯ জুন জন্ম কলকাতায় হলেও ছেলেবেলা কেটেছে রংপুরে। মফস্বল শহরে বলেই হয়তো, তখন শহরজুড়ে ছিল বড়বড় গাছ, জঙ্গল, বাড়ির পাশে শ্যামাসুন্দরী খাল, বাঁশঝাড়। রাতে শিয়ালের হুক্কাহুয়া আর ইঁট বিছানো রাস্তায় টমটম গাড়ি। সন্ধ্যা হয়ে এলে দূর গাঁ থেকে যেসব কিশোর দুধ বেচতে আসতো, তারা দুধ বিক্রি করে ফিরে যেত। যাওয়ার সময় শূন্যহাঁড়িতে বোল বাজিয়ে গান গেয়ে বাড়ি ফিরতো। আলোআঁধারি, বৃটিশ তাড়াও আন্দোলন, কাকা সুনীল গুহ ছিলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন কর্মী।
কাকার রাজনীতির কারণে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো, বাড়ির সামনে গোয়েন্দার পাহারা -উপন্যাসিক হতে কি সাহায্য করেছিলো? ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছিলেন রংপুরেই। রংপুরের জিলা স্কুলে। বুদ্ধদেব গুহের বিখ্যাত ‘ঋভু ‘ উপন্যাসে বদরগঞ্জ রেল – স্টেশনের নাম আছে। ‘ঋভু’ বুদ্ধদেব গুহের আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণমূলক উপন্যাস। উপন্যাসে ভারত বিভাগ পূর্ব রংপুরের বহু কথা লেখা রয়েছে। সেই সুবাদে ট্রেনের কামরায় বসে বহুবার রংপুরে এসেছেন এবং আসামের ধুবড়ি গিয়েছেন পিসির বাড়িতে। উপন্যাসে লিখেছেন এভাবে, ” ঋভুরা যখন রংপুরে আসতো তখন শুধু পোড়াদহ আর পার্বতীপুর জংশনে এলেই ঋভু বুঝতো যে রংপুরের কাছাকাছি এলো। পার্বতীপুরে গাড়ি বদল করতে হতো। সেখান থেকে মিটারগেজ লাইন চলে গেছে বদরগঞ্জ, রংপুর, ভূতছড়া, কাউনিয়া, তিস্তা, গীতালদহ, গোলকগঞ্জ এবং মোটরঝাড়। পথে পড়তো লালমনিরহাট জংশন।
মোটরঝাড়ে নেমেই গোরুরগাড়িতে চড়ে ঋভুরা তাঁর পিসেমশাইয়ের বাড়ি তামাহাট পৌঁছত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে কলকাতা উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বাবা ঋষিকেশ গুহ তাঁর পরিবারসহ বুদ্ধদেব গুহকে পাঠিয়ে দেন রংপুরে। তাও প্রায় সেটা ১৯৪৩-৪৪ সালের কথা। বুদ্ধদেব গুহের ঠাকুরদারা ছিলেন ফরিদপুরের লক্ষীপুরের জমিদার। পদ্মার ভাঙনে জমিদারবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেলে তাঁর ঠাকুরদা চলে আসেন রংপুরে।
তাঁর বাবা ঋষিকেশ গুহ পড়াশুনা করেছেন রংপুরের কৈলাশরঞ্জন ও কারমাইকেল কলেজে, এরপর চাকরিসূত্রে তিনি চলে যান কলকাতায়। ওনার বাসাটা খুঁজে পাওয়াটা ছিলো আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। রংপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানা জীবন্ত এনসাইক্লিওপেডিয়া শাহ্ রিয়াদ আনোয়ার শুভ ভাইয়ের সাহায্য নিয়ে জানতে পারি এখন ধাপ সিটি কাঁচাবাজার যেখানে অর্থাৎ বর্তমানে নিরাময় ক্লিনিকের পাশেই ছিল তাদের পৈতৃক ভিটা। সেখানে এখনও একটা কাঠগোলাপের গাছ আছে। গাছটি সেই আমল থেকেই আছে এবং ওনাদেরই লাগানো গাছ। সে সময় তাদের বাড়িতে ছিল অনেক জাতের গোলাপ গাছ। লোকজন তাদের বাড়িটিকে জানতো গোলাপবাড়ি বলে। রংপুর থেকে চলে যাবার পর আর কখনই আসা হয়নি রংপুরে কিন্তু বিভিন্ন ইন্টারভিউ এ উনি রংপুরের কথা বলেছেন। রংপুরের আইনজীবী জগলুল হকের সাথে পত্রালাপও ছিল ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। রংপুরে ছেলাবেলা কাটানোই তাঁকে পরবর্তী জীবনে লিখতে প্রেরণা দিয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন একাধিক ইন্টারভিউয়ে।
বুদ্ধদেব গুহ পেশায় ছিলেন চ্যাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, ছিলেন সৌখিন শিকারী। ঘুরে বেড়িয়েছিলেন বনে-জঙ্গলে। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘জঙ্গল মহল’ তবে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল ‘হলুদ বসন্ত’, যার জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। স্ত্রী ঋতু গুহ ছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী। নিজেও গাইতেন টপ্পা গান। অনায়াসে বলতেন, আমি তো জঙ্গলেরই লোক, আমি বন্য। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো তিনিও বলতেন, “ভরপুর জীবনকে উপভোগ করো, অনুশোচনার কোন স্থান নেই জীবনে,যেটুকু প্রাপ্তি,সেটুকুই তৃপ্তি”। কোভিড আক্রান্ত হয়ে গতবছর এপ্রিলে ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। টানা ৩৩ দিন ছিলেন হাসপাতালে তবে এবার আর হাসপাতাল থেকে ফেরা হলো না। ২৯ আগষ্ট,২০২১ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর প্রিয় বুদ্ধদেব গুহ।