১৯৪৬-৪৭ সালে সংঘটিত ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন রংপুর দিনাজপুর অঞ্চলে প্রচণ্ড দানা বেঁধে উঠেছিল। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই লিখিত হয়েছে এই উপন্যাস। গল্পের ছলে এই কাহিনী আমাদের নিয়ে যাবে এমন এক অধ্যায়ে যেখানে ধানের জন্য, খাবারের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা অবতীর্ণ হয়েছিলেন এক অসম যুদ্ধে। পর্যায়ক্রমেএতে উঠে আসবে সেই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কমরেড জীতেন দত্ত, মনিকৃষ্ণ সেন, ছয়ের উদ্দিন, দারাজ উদ্দিনসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্র। আসুন ঘুরে দেখি ইতিহাসের এক বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়। প্রকাশিত হবে প্রতি বুুুধবার।
৩
জরুরী আলোচনায় বসেছেন ঠাকুরপ্রসাদ রায় ও তার বন্ধু লোহানীপাড়ার আসিমুল্লাহ মন্ডল, ঠাকুরপ্রসাদের পুত্র তারা রায়, ভাইয়ের ছেলে ব্রক্ষেশ্বর রায় ও বিজয় রায়। জমিদার মহারাজ বাহাদুর সিং এবং তার জোতদারদের অত্যাচার থেকে কীভাবে কৃষকদের রক্ষা করা যায়- এটাই হলো আলোচনার বিষয়। আসিমুল্লাহ নিজে জোতদার তবুও গরীব কৃষকের জন্য তাঁর প্রাণ কাঁদে। দুই বন্ধু মিলে সেদিন সিদ্ধান্ত হয় সমিতি গঠন করে কৃষকদের সংঘবদ্ধ করতে হবে। গড়ে ওঠল বাতাসন(পরগণা) রায়ত সমিতি। সাল ১৯২১। ঠাকুরপ্রসাদ বসে আছেন কাঠের চেয়ারে, পাশেই তাঁর বন্ধু আর বাকি সবাই মাদুরে। একে একে সবাই তাদের পরিকল্পনার কথা বলে যান। প্রত্যেকেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় এখুনি। শুধু মিটিমিটি হাসেন ঠাকুরপ্রসাদ রায়। বন্ধুর হাসি দেখে আসিমুল্লাহ মন্ডল জানতে চান,দোস্ত হাসিস ক্যান?
ঠাকুরপ্রসাদ বলেন, এতো সহজে এতো বছরের দূর্গে আঘাত করা সম্ভব না। সময় নাও। কৃষকদের সাথে মেশো। মনে রাখবা তোমরা ধনীর সন্তান। সহজে কৃষকেরা তোমাদের গ্রহণ করবে না। ভাববে নিশ্চয় কোন মতলব আছে। আস্তে আস্তে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। উলুধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ঘরে কুপি নিয়ে আসে বাসার কাজের ছেলে৷ ঠিক তখনই ঘরে ঢোকেন জীতেন দত্ত। মাঝারি গড়ন, গায়ের রং একসময় ফর্সা ছিল রোদে পুড়ে এখন একটু তামাটে। সারা মুখজুড়ে দাড়ি। পরনে লুঙি আর ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি। জীতেনকে দেখে আসিমুল্লাহ বলে ওঠেন, এই তোমার আসার সময় হলো? তারপর কী খবর বলো?
মৃদুভাষী জীতেন দত্ত মাদুরে বসতে গেলে হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসতে দেন আসিমুল্লাহ। কাঁধের ব্যাগটা পায়ের কাছে রেখে বলেস জোতদারেরা গুপ্তচর লাগিয়েছে। একটা টিকিটিকি দেখলাম পুকুরপাড়ে। চিন্তার ছাপ পড়ে মাদুরে বসা সবার মুখে। শুধু নির্বিকার ঠাকুরপ্রসাদ একমনে তাকিয়ে আছেন কুপির আলোর দিকে। কুপিটা কেমন দপদপ করে জ্বলছে।
৪
ধান কাটতে কাটতে বেলা শেষ। মাঠে জমানো সোনার মতো জ্বলছে ধান। মাঠের এক কোণায় বসে আছে মফিজ। পেটের ব্যথাটা একটু কমেছে। বৌ শুয়ে থাকতে বললো আরও কিছুক্ষণ কিন্তু মন মানে না, মাথায় ঝাঁপি নিয়ে কোঁকড়া হয়ে এসে বসে জমির আইলে। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখে দুছেলেকে। হাতে কাস্তে, নেংটি পরা ঘামে ভেজা সুঠাম দেহ। ছেলেদের জন্য মায়া হয়। এতো কষ্ট করে ফসল ফলিয়ে কী লাভ হলো? সবই তো নিয়ে যাবে জোতদার টেল্লা বর্মণ। লাঠি হাতে পাহারায় টেল্লা বর্মনের লোক, যাতে ধান এদিক সেদিক না হয়। গরুর গাড়ি নিয়ে আসছে জোতদারের লোক। করুণ মুখে ধান গাড়িতে তোলে আলী আর রহমত। গাড়ি রওনা দেয় জোতদারের বাড়ির দিকে। ধপ করে বাপের পাশে বসে পড়ে দুই ভাই। ধুলা উড়িয়ে গাড়ি চলে যায় টেলা বর্মণের বাড়ির দিকে।