পর্ব – ৪
৭
ঠাকুরপ্রসাদ রায় যে বাড়িতে থাকেন তার তিন দিকে গাছ দিয়ে ঘেরা। ভোরে ওঠা অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠে খড়ম পায়ে বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখেন তারপর বাসায় এসে কুয়ার পানি দিয়ে স্নান সেরে নেন। গতকাল থেকে তার মনটা খারাপ। উনি যে আন্দোলন শুরু করতে যাচ্ছেন সেজন্য গান্ধীজির আশীর্বাদ কামনা করে চিঠি লিখেছিলেন। গান্ধীজি এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে মন্তব্য করেছেন-It is sin(এটা পাপ)। ঠাকুরপ্রসাদ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন তাই আজ বন্ধু আসিমুল্লাহর সাথে দেখা করতে চান । সকাল- সকাল রওনা দেন লোহানীপাড়ার দিকে। গরুর গাড়িতে বসে চারপাশ দেখে মনটা জুড়িয়ে যায়। সবুজ ধানগুলো কেমন সোনালি হয়ে উঠছে। হালকা বাতাসে নুয়ে পড়ছে ধানের ছড়াগুলো। এবার বেশ ধান হয়েছে। মনে মনে খুশি হন ঠাকুরপ্রসাদ।
কিছুদুর যাবার পর পথরোধ করে দাঁড়ায় নজরউদ্দিন। সাথে সাত আটজন গুণ্ডা।
-কি রে রাস্তা আটকালি কেন?
-তুই হামার জমিদারের প্যাছত নাগছিস ক্যানে?তোর এত বড় বুকের পাটা!
-আমি কারও পিছে লাগি নাই। আমি শুধু ন্যায্য দাবি আদায়ের কথা বলেছি।
আর কথা বলার সুযোগ পায় না ঠাকুরপ্রসাদ। মাথায় সজোরে লাঠি দিয়ে আঘাত করে নজরউদ্দিন। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ঠাকুর। আরও কিছু এলোপাতাড়ি লাঠির বাড়ি পড়ে শরীরে।গাড়িয়াল ভয়ে কাঁপতে থাকে। গাড়িয়ালকে কী মনে করে আঘাত করে না গুণ্ডা বাহিনী। ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছেন ঠাকুর। বীরদর্পে চলে যায় নজরউদ্দিন। শুধু রাস্তার একটা নেড়ি কুকুর ঘেউঘেউ করে বিরক্তি প্রকাশ করে।
৮
আসিমুল্লাহ মণ্ডল যে বাড়িতে থাকতেন তার ঠিক পাশেই একটা আম বাগান ছিল। সেই আমবাগানে অনেক পাখি আসত। পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকত বাগানটি। প্রতিদিন আসিমুল্লাহ মাছ, ধান, চাউল ছিটিয়ে দিয়ে পাখিগুলিকে খাওয়াতেন। আজও তিনি তার বাগানে পাখিদের খাওয়াচ্ছেন। ঠাকুরপ্রসাদ মারা যাবার পর বাতাসন রায়ত সমিতির হাল ধরেছেন। কৃষকদের সাথে কথা বলেন, তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। স্থানীয় সাঁওতালদের অভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। শেষ বয়সে এসে আসিমুল্লাহ হতাশ না হয়ে সাহস পান। তার দশ ছেলের মধ্য থেকে একজন যোগ্য পুত্র দারাজউদ্দিন কে রেখে যেতে পারবেন ভেবে বুকে বল পান।
আজীবন সংগ্রামী মানুষটা মারা গেলেন রাতেই। পরদিন সকালবেলা সব পাখি উড়ে গেল আম বাগান থেকে। আর কোনোদিনও তারা ফিরে আসেনি খাবারের জন্য। সাঁওতাল পল্লীর সবাই ডুকরে কেঁদে উঠেছিল আপন মানুষকে হারানোর বেদনায়। যাকে তারা বাবা বলে ডাকত সেই মানুষটার বিরহে মেয়েরা কেঁদে বলে উঠল বাবা চলে গেল। এখন কে আমাদের চাল দিবে, গম দিবে, টাকা দিবে। আসিমুল্লাহ মণ্ডলের মৃত্যু এক গর্বিত অধ্যায়ের সমাপ্তিতে শেষ হয়।
৯
জিতেন্দ্র নাথ দত্তের জন্ম ১৯০৯ সালে খুলনা জেলার ফুলতলা থানার দক্ষিণ ডিহি গ্রামে। জোতদার কেদারনাথের ছোট ছেলে জিতেন দত্ত। জোতদার বাবার সন্তান জীতেন দত্ত হেসেখেলে এন্ট্রান্স পাশ করার পর কোলকাতায় চলে যান। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন সুরেন্দ্র মোহন কলেজে।সেখান থেকে আই এ পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ছাত্ররা তখন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে। তিনিও জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনে। মেধাবী জিতেন রাজনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে পড়ায় ইস্তফা দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ঠাকুর এ্যান্ড কোং নামে কলকুঠি খুলেছেন। জিতেন দত্ত যোগ দেন কবি গুরুর কোম্পানিতে। স্বাধীনচেতা হওয়ায় ম্যানেজারের সাথে বনিবনা না হওয়ায় চাকরি ছেড়ে কোলকাতা শহর ছেড়ে সোজা রংপুর জেলার বদরগঞ্জে। মিঠাপুকুরের নাগেরহাট ও ছড়ানে কলকুঠি স্থাপন করেন। বদরগঞ্জ, শ্যামপুর, নাগেরহাটে আখের ফলন ভালো হতো৷ সেই আখ চলে যেত সেতাবগঞ্জ সুগার মিলে। কিছু অংশ আখ চাষিরা নিজেরা মাড়াই করে বিক্রি করত। আখ কলের এজেন্ট জিতেন দত্ত সেই কল ভাড়া দিত কৃষকদের মাঝে। সেই ভাড়া পরিশোধ করা অনেকসময় কষ্টের হয় কৃষকদের। জিতেন দত্ত চেষ্টা করেন ভাড়া কমানোর কিন্তু ব্যর্থ হন। রাগ করে এজেন্সি ত্যাগ করেন।
নাগেরহাটের যে বাড়িতে জিতেন দত্ত থাকেন সেটাকে কুঁড়েঘর বলাই ভালো। মাটির দেয়াল, উপরে খড়। ঘরের সামনে কুয়া। ভাত চড়িয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন জিতেন দত্ত। পাশে বসা পল্টু। পল্টু পান্নু পালের ছেলে। জিতেন দত্তের খুব ন্যাওটা।
– ও দাদু তুমি কি ঘুমাও?
– ধুর পাগল, রান্না করতে বসে কেউ ঘুমায়? চিন্তা করি।
– দাদু তুমি কিসের এত চিন্তা করো?
– এই তোর, তোর বোন রেবার কথা।
পল্টু তার এই দাদুকে বুঝতে পারে না। গ্রামের সবাই বলে দাদু নাকি সন্ন্যাসী। যাদু জানে। একদিন চুপ করে ঘরে খুঁজে দেখেছে কিন্তু কোনো মানুষের মাথার হাড্ডি পায়নি পল্টু। সে তো জানে যাদুকরের কাছে মাথার হাড্ডি থাকে। তার মানে দাদু যাদুকর না। তবে দাদু কে? পল্টু বুঝে পায় না।
ভাত হয়ে গেলে মাড় ফেলে ভাত থেকে আলু বের করে লবণ আর মরিচ দিয়ে চটকে নেন জীতেন। তারপর মাদুর পেতে পল্টুর সাথে খেয়ে নেন। আজ কুতুবপুর হাটবার। হাটে গিয়ে কিছু লোক দেখলেই বক্তৃতা দেয়া তার স্বভাব। সাধারণ মানুষকে নিজের অধিকার নিয়ে সচেতন করাও এত কষ্টের!
হাঁটে দেখা হয় গেন্টু, আলী, রহমতদের সাথে। শুনতে পায় খগেনের ধান কাটতে হবে। সিদ্ধান্ত হয়, এ ধান জোতদারের বাড়ি যাবে না। খগেনের বাড়িতে যাবে। তৈরি হয় পাহারাদার দল। সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে সবার মুখ এক উজ্জল আভায় জ্বলজ্বল করতে থাকে। সারা জীবন হেরে যাওয়া মানুষগুলো একবার অন্তত জেতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
১০
আজকের সকালটা একটু অন্যরকম। কেমন মেঘলা আকাশ, বাতাস গুম মেরে আছে। একটা অস্থিরতা আকাশে-বাতাসে। খগেন তার ছেলে আর জামাইকে নিয়ে রওনা দেয় ক্ষেতের দিকে। ক্ষেতে পৌঁছে দেখে কৃষক সমিতির লোকজন কমরেড শংকর রায়, নৃপেন ঘোষ লাঠি হাতে আগে থেকেই বসে আছে আইলে। ভগবানের নাম নিয়ে ধান কাটা শুরু করে। হাত লাগায় সমিতির ছেলেরা। দ্রুত কাটা হয়ে যায় ধান। এমন সময় ধর ধর বলে তেড়ে আসে জোতদারের লাঠিয়াল নয়মুদ্দিন ও তার চ্যালাচামুণ্ডারা। শুরু হয় লড়াই। ঠিক তখুনি এক অভূতপূর্ব দূশ্যের অবতারণা হয়। মধুপুরের মহিলারা দা, বটি, হাসুয়া, উরুণ নিয়ে ছুটে আসে। নয়মুদ্দিন দেখে মহিলাদের হাতে মার খাওয়ার সম্ভাবনা, তখন তারা পালিয়ে যায়। ধান গরুর গাড়িতে করে খগেনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ধানের গন্ধে মৌ মৌ করতে থাকে সারা উঠান।