১৯৪৬-৪৭ সালে সংঘটিত ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন রংপুর দিনাজপুর অঞ্চলে প্রচণ্ড দানা বেঁধে উঠেছিল। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই লিখিত হয়েছে এই উপন্যাস। গল্পের ছলে এই কাহিনী আমাদের নিয়ে যাবে এমন এক অধ্যায়ে যেখানে ধানের জন্য, খাবারের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা অবতীর্ণ হয়েছিলেন এক অসম যুদ্ধে। পর্যায়ক্রমে এতে উঠে আসবে সেই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কমরেড জীতেন দত্ত, মনিকৃষ্ণ সেন, ছয়ের উদ্দিন, দারাজ উদ্দিনসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্র। আসুন ঘুরে দেখি ইতিহাসের এক বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়।
গরমের এ সময়টা বাতাসে মরিচের গুঁড়োর মতো ঝাঁঝ থাকে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতে- মাজতে পিছনের বাঁশবাড়িতে যায় গেন্টু। বাঁশ বাড়িতে যায় কিন্তু হাতে কোন বদনা থাকে না। পানি খরচ করে কখনও পুকুরপাড়ে না হয় ধানক্ষেতে। বাসায় এসে পান্তা খেয়ে গরু আর লাঙ্গল নিয়ে ক্ষেতের দিকে যায় গেন্টু। মধুপুরে এ সময় কৃষকদের ব্যস্ততা থাকে। চাষ শুরু করার কিছুক্ষণ পর গেন্টু দেখে জীতেন দা আইল বাড়ি দিয়ে হেঁটে আসছেন।
উনি এসেই বলেন-দে তোর হালখান, মুই একনা চাষ দেইম। তুই এনা ছায়াত বসি থাক। জীতেন দার আচরণে অবাক হয় না গেন্টু। মানুষটা তো এমনই। সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যান নিমিষে। হাল জীতেনদার হাতে ছেড়ে আইলের উপর খোকশা গাছের ছায়ায় বসে গেন্টু। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনজন পুলিশকে দেখা যায় এদিকেই আসছে। ভয়ে দাঁড়িয়ে যায় গেন্টু। এদিকে জীতেন দা ভ্রুক্ষেপহীন। একমনে হাল চালাচ্ছেন আর কিছুক্ষণ পরপর হেটহেট করছেন। পুলিশের একজন মনে হয় বড়বাবু, জীতেন দা কে বলে, এই জীতেন দত্ত কোথায় থাকে? হাত দিয়ে একটু দূরে বাঁশবনের পাশের গ্রামের দিকে দেখিয়ে দেন। পুলিশের দল ঐদিকে চলে গেলে গেন্টুর হাতে হাল ধরিয়ে জীতেন দা উল্টা দিকে জোরে হাঁটা শুরু করেন। চোখের নিমিষে হাওয়া হয়ে গেলেন কমরেড জীতেন দত্ত।
২
এখানে সকাল হয় পাখি ডাকার সাথে-সাথেই। গ্রামের সব পুরুষ উঠেই মুখে চারটা পান্তা গুঁজে ক্ষেতে চলে যায়। মধুপুরের এই শাহাপাড়ায় বাস প্রায় পঞ্চাশ হিন্দু-মুসলিম পরিবার। মফিজ মিয়া সকালে উঠেই অসুস্থ বোধ করতে থাকে। তীব্র পেটব্যথা। বৌ গ্রামের নগেন ডাক্তারের কাছে যাবার জন্য বলতেই মফিজ বলে- ডাইকবার নাগবার নায়, এনা খই পানি দে। খই পানি খেয়ে উপুর হয়ে বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকে মফিজ। আজ অনেক কাজ। ধান কাটতে হবে। মফিজের দুই ছেলে আলী আর রহমত তৈরি হয়ে ক্ষেতে চলে যায়। উপুর হয়ে হিসাব করে মনে মনে, কতটুকু ধান জুটবে কপালে? এবার ফসল ভালো হয়েছে। ধানক্ষেতে গেলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। ছোট শিশুর মতো কেমন দ্রুত বেড়ে ওঠে ধানগাছ। তারপর সোনালি রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। মফিজের নিজের জমি নাই। চাষ করে টেল্লার জমি। গতবার ফসল ভালো হয় নাই। খরা ছিল। সুদে টাকা নিতে হয়েছে। এবারও যে ফসল ফলবে তার অর্ধেকটাই দিয়ে দিতে হবে জোতদার টেল্লা বর্মণকে। সারাদিন খেটে ফসল ফলিয়ে কপালে জুটে অর্ধেক ফসল। আর জমির মালিক বাড়িতে বসে পায় অর্ধেক ফসল। বুকটা হুহু করে ওঠে মফিজের।
(চলবে)