নতুন করোনা ভাইরাস পুরো পৃথিবীকে ওলোট পালট করে দিলো। মানুষের উপর তার তাণ্ডবলীলা কিন্তু এখনো থামে নি। কেন থামে নি, বলছি।
বছরের শুরুতে চীনের উহানে যখন ভাইরাসটি দেখা দিলো, লোকে ভাবলো – ফ্লু বা ফ্লু জনিত কিছু একটা হয়তো। একটু জ্বর, খানিক কাশি, বড় জোর নিউমোনিয়া, আর কপাল খারাপ থাকলে পটল তুলে স্বর্গবাসী হওয়া।
না, করোনা ভাইরাস এখানেই থেমে থাকে নি। পুরো মেরে ফেলার চেয়ে আধমরা করেছে আরো বেশি।
কোভিড-১৯ রোগের নাম হয়ে SARS-CoV-2 নামের ভাইরাসটি শুধুমাত্র একটি ফ্লু নয়। তারপরে ভাবা হয়েছিল – এটি একটি ফুসফুস জনিত সংক্রমণ। কিছুদিন যেতেই চিকিৎসকরা ভাবলো – এটি শুধুমাত্র ভাইরাসজনিত একটি ইনফেকসাস ডিজিজ।
এতটুকুতে থামলে চলতো। কিন্তু ভাইরাসটি শরীরের এমন এমন অংশে আঘাত করতে শুরু করলো, এমন এমন লক্ষণ প্রকাশ করলো, একেক জনের শরীরে একেক রকম তাণ্ডবের চেহারা রেখে গেলো, কিছু পোস্ট মর্টেম করতে গিয়ে চিকিৎসকরা দেখতে পেলো, কিছু রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার পর তার দেহ রুটিন পরীক্ষা করতে গিয়ে পেলো, কিছু সমস্যা মৃত্যুর আগে জানান দিয়ে গেলো।
প্রতি সপ্তাহে বিশ্বের কোথাও না কোথাও চিকিৎসকরা নতুন নতুন তথ্য, উপাত্ত, রোগীর শরীরে নতুন নতুন উপসর্গ, মৃতের শরীরে ভাইরাসের ইফেক্ট, এসব পাচ্ছিলো। যে কারণে এখনো পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাসের প্রভাবে শরীরে কি কি হতে পারে, তার চূড়ান্ত কোনো তালিকা তৈরী করতে পারে নি। যেটা আছে, তা সাময়িক রূপরেখা, প্রতিনিয়ত আপডেট হচ্ছে। সামনে আরো হবে।
একসময়ে ভাবা হতো – করোনা পেশেন্ট মানে হসপিটালের ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টের কাজ। দিন যেতে সমস্যার হাত-পা ছড়ালো। যুক্ত করা হলো ইনফেকসাস ডিজিজ ডিপার্টমেন্ট। আক্রান্তদের অবস্থা বেশি খারাপের দিকে যেতে থাকলে – যুক্ত হলো ক্রিকটিক্যাল কেয়ার ডিপার্টমেন্ট। মৃত্যুগুলো ফুসফুসজনিত দেখে রেসপিরেটরি এবং ইন্টারনাল মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের স্পেশালিস্টদের কাজের গণ্ডিতে ভাবা হয়েছিল। মজার হলো – দিন যত যেতে থাকলো – দেখলো যে, বেশিরভাগ মৃত্যুগুলো হচ্ছে হৃদপিণ্ডের সমস্যার কারণে। অথচ এতদিন ভাবা হতো ফুসফুসের কারণে মৃত্যু হচ্ছে, ভেন্ট্রিলোটরের চাহিদা আকাশচুম্বি হয়ে গেলো। এখন চিকিৎসকরা রোগের ক্লাসিফিকেশনে কোভিড-১৯ -কে কার্ডিয়াক ক্যাটাগরিতে ফেলবে কিনা দোটানায় পড়ে গেলো।
এমনকি কোথাও কোথাও কিডনীজনিত সমস্যা এতদূর ছাড়িয়ে গেছে, ভেন্ট্রিলেটরের চেয়ে ডায়ালাইসিস মেশিন বেশি দরকার হচ্ছে।
করোনা ভাইরাসটি শরীরের কোথায় তার আঘাত বাকি রেখেছে! হয়তো সামনে আরো নতুন নতুন সমস্যা আসবে, নতুন নতুন উপসর্গ দেখতে পাবে আক্রান্ত রা, সুস্থ হয়ে ওঠার পর নিত্য নতুন সমস্যা নিয়ে হাজির হবে আক্রান্তরা, এসব নিয়েই আজ লিখবো : করোনা ভাইরাস শরীরের কোথায় কোথায় কি করছে, কেন করছে, কিভাবে করছে।
শরীরের উপর থেকে নিচে যে যে অংশগুলো করোনা ভাইরাসের কারণে আক্রান্ত হয়, সংক্ষিপ্ত আকারে তা হলো:
১. মাথা
২. নাক
৩. ঘাড়
৪. ফুসফুস
৫. হৃদপিন্ড
৬. রক্তনালী
৭. পাকস্থলী
৮. কিডনি
৯. লিভার
১০. পা
তালিকা দেখে ঘাবড়ে যাবেন না। একসাথে সবগুলোতে সবাই আক্রান্ত হয় না। বিশদ বললে বিরক্ত লাগবে পড়তে, তাই সংক্ষিপ্ত করে বলবো মূলকথাগুলো।
করোনা আক্রান্তদের ১০% মস্তিষ্কের সমস্যায় ভুগতে পারেন।
সমস্যাগুলো :
► মাথা ব্যথা করা
► মাথা ঝিলিক দিয়ে ওঠা
► মস্তিষ্কের ইনফ্লেমেশন
► ফোকাস করার ক্ষমতা কমে যায়
► মাথা ভার ভার লাগতে পারে
► হঠাৎ হঠাৎ কনফিউশান লাগে
► চিন্তা ভাবনা ঘোলাটে লাগতে পারে
সমস্যাগুলোর কিছু কিছু সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও দেখা দিতে পারে।
করোনা ভাইরাস মস্তিষ্ককে কিভাবে আক্রমণ করে, বিজ্ঞানীরা এখনো তা পরিষ্কার জানে না। কিন্তু যে কারণে আক্রমণ করে – তা জানে। সেটি হলো – করোনা ভাইরাস শরীরের সেই সব অংশকে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করে বা সেখানে গিয়ে বসে, যেখানে ACE2 নামের একধরনের রিসেপ্টর প্রোটিন থাকে। ফুসফুসের মতো মস্তিষ্কেও এই ACE2 অনেক বেশি থাকে। ২০০০ সালে ব্লাড প্রেশার কন্ট্রোলের উপায় জানতে গিয়ে Athony Turner এর গবেষক দল এই প্রোটিন রিসেপ্টরটি সম্পর্কে বিশদ জানতে পারে এবং পরবর্তীতে ২০০৩ সালে আরেকদল মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষের আবরণে এদের উপস্থিতি আবিষ্কার করেন।
ঘাড় ব্যথা করতে পারে। আক্রান্ত হবার কিছুদিন পর প্রথমে গলা ব্যথা শুরু হয়। এই গলা ব্যাথার কারণ – গলার একটি গ্লান্ড আক্রান্ত হয় বলে। থাইরয়েড গ্ল্যান্ড। এতে subacute thyroiditis নামের একটি সমস্যা হয়। এটি একটি ইনফ্লেমেশন। মনে রাখবেন – ইনফ্লেমেশন কিন্তু ইনফেকশন নয়। ইনফেকশনের কারণে ইনফ্লেমেশন হয়। ইনফ্লেমেশন হলো ইনফেকশনের কারণে শরীরের একটি পাল্টা প্রতিক্রিয়া। সচরাচর মামস ভাইরাসের কারণে এই subacute thyroiditis সমস্যাটি হয়। সম্প্রতি ইতালিতে খুব অল্প কিছু করোনা আক্রান্তদের মধ্যে এটি দেখা গেছে। এতে আক্রান্ত হলে প্রথমে গলা বেশি ব্যথা করে, গলার সামনের অংশ একপাশে ফুলে যায়, ঘাড়ের পেশিগুলো ব্যাথা করতে শুরু করে। থাইরয়েডের অন্য কোনো কমপ্লিকেশনের দিকে না গেলে কয়েকদিন পর ব্যথা চলে যায়।
ফুসফুসে কি হয়, সবাই জানে এতদিনে । আগের আর্টিক্যালগুলোতে এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি বলে নতুন করে কিছু বলতে চাইছি না। ফুসফুসে আক্রমণের তিনটি স্তর। প্রথম স্তরে নাক, মুখ দিয়ে ভাইরাসটি শরীরে ঢুকে গলায় বাসা বাঁধে। শুরু হয় হালকা গলা ব্যথা। দ্বিতীয় স্তরে কদিন পর ফুসফুসের গিয়ে বসে। সেখানে মস্তিষ্কের মতো ACE2 প্রচুর থাকে। ফুসফুসের ভিতরের কোষগুলো মিউকাস নামের একটি উপাদান বের করে, যার কাজ হলো ফুসফুসকে ধুলোবালি, জীবাণু এসব থেকে পরিষ্কার রাখা। ফুসফুসে এপিথেলিয়াল ধরনের কোষে সিলিয়া নামক এক ধরণের গঠন থাকে, এদের কাজ হলো – ফুসফুসের কোষের উপর জীবাণু, ধুলাবালু, পরাগরেণু, বাহিরের কোনো কিছুকেই বসতে না দেয়া। ব্যাঙের ছাতার মতো দুলে দুলে জীবাণুদের সরিয়ে দেয় সিলিয়া এবং মিউকাস তখন সেগুলোকে ধুয়ে ফুসফুসের বাহিরে ঠেলে দেয়। আমরা ঠিক এই কারণে যখন কাশি দিয়ে এক দলা কফ ফেলি, এই কফে তাই ভাইরাস থাকতে পারে ! অনেক জীবাণুও থাকে। এই জন্যে যেখানে-সেখানে কফ ফেলবেন না। নিজের কফ দিয়ে নিজের সন্তানকেই আক্রান্ত করবেন। এই লেখাটি পড়ার পর আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করবেন – যেখানে-সেখানে কফ ফেলবেন না, কাশি এলে হাত দিয়ে মুখ ঢাকবেন, পকেটে টিসু থাকলে টিসুতে মুখ মুছবেন, সেই টিসু কোনো ডাস্টবিনে ফেলবেন। দৈনন্দিন জীবনে এমন সামান্য পরিচ্ছন্নতাটুকু আপনাকে যেমন ভালো রাখবে, অন্যকেও ভালো রাখবে।
যা বলছিলাম, এই সিলিয়াগুলোর বাহিরে ACE2 বসে থাকে। করোনা ভাইরাসগুলো এই সিলিয়া গুলোর উপর বসে কোষের ভিতর ঢুকে কোষগুলোকে আক্রান্ত করলে সিলিয়াগুলো আর তাদের কাজটি করতে পারে না। তখন বার বার মিউকাস জমে যায় সামান্য বাতাসে ! ফুসফুস চায় তা বের করে ভালোভাবে বাতাস নিতে, আর তাতেই কাশি শুরু হয়। তখন ঘন ঘন আক্রান্ত হন, ঘনঘন কাশতে থাকেন। আরো ক দিন যেতেই শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। তৃতীয় স্তরে শরীর তেড়ে আসে, এন্টিবডি তৈরী করে, সেই এন্টিবডিগুলো ভাইরাসকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করে। ভাইরাস আর এন্টিবডির যুদ্ধ এতো প্রবল হয়ে ওঠে যে cytokines নামের একটি রাসায়নিক উপাদান বেরিয়ে আসে, সে আরো বেশি বেশি এন্টিবডি ডেকে নিয়ে আসে, ঝড়টিকে বলে cytokine storm। এতে ফুসফুসের আলভিওলার প্রকোষ্টগুলো যুদ্ধবিদ্ধস্ত মৃতকোষ, জল, মিউকাস, পুঁজ ইত্যাদিতে ভরে যায়। এই প্রকোষ্টে বাহিরের অক্সিজেন ঢুকে এবং শরীরের কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে যায়। কিন্তু প্রকোষ্টটি মৃত কোষ সহ জল, পুঁজে ভরে যায় বলে বাতাস ঢুকতেও বাধা পায়, আবার বেরও হতে পারে না। নিউমোনিয়া বেড়ে গিয়ে পুরো শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়। তখনই দরকার পড়ে ভেন্ট্রিলেটর মেশিন।
বলে নেই একটি কথা। বেঁচে গেলেও এই ভাইরাস ফুসফুসের এমন এমন ক্ষতি করে যায়, যা থেকে বের হতে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস লাগতে পারে, এমন কি কারো কারো ক্ষেত্রে বাকি জীবন বয়ে বেড়াতে হতে পারে। সুতরাং, আরেকবার চিন্তা করবেন, এই ভাইরাস যতটা সাময়িক খারাপ করে শরীরকে, তারচেয়ে তার ক্ষত বেশি রেখে যায় ভোগাতে।
প্রথমে ভাবা হতো শুধুমাত্র ফুসফুসকে এই ভাইরাস সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করে। কিন্তু সময় গড়াতে বের হয়ে এলো – আক্রান্তদের প্রতি পাঁচজনে একজনের হৃদপিণ্ডে এটি আঘাত হানে। এমনকি সুস্থ দেহ, পূর্ব থেকে হার্টে কোনো সমস্যা নেই, এমনদের; সাথে তরুণ তরুণীদের হার্টকেও এটি আক্রান্ত করতে পারে। হার্টের কারণে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয়
► অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
► হার্ট মাসলের ক্ষতি যা থেকে Myocarditis হতে পারে
► হার্ট এট্যাক বিশেষত Ischemic heart attack হতে পারে
► প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং রক্ত চলাচলে বাধা
► করোনারি হার্ট ডিজিজ হতে পারে ব্লাড ক্লট থেকে
► হার্ট ফেইলিউর
এবং সবশেষে হৃদয় থেমে যেতে পারে।
ভাইরাসটি তিনভাবে হার্টকে আক্রান্ত করে।
► সরাসরি হার্টের কোষে ঢুকে
► ফুসফুসের মাধ্যমে
► Cytokine Storm এর কারণে
ফুসফুস এবং ব্রেইনের মতো হার্টের কোষের আবরণে ACE2 প্রোটিন রিসেপ্টর থাকে প্রচুর। তাই ভাইরাসগুলো তাদের স্পাইক প্রোটিন দিয়ে হার্টের কোষে গিয়ে সহজে বসতে পারে। সাথে রক্তনালির ক্ষতি করে রক্তচলাচলে বাধা দেয়, রক্তনালী সরু করে ফেলে, এতে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
ফুসফুসে বাতাস ঠিকমতো পরিবর্তন না হতে পারলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমান কমে যায়। তাতে হৃদপিণ্ড কম অক্সিজেনের রক্ত পায়। অক্সিজেন কম পেলে হার্টের মাসলগুলো ঠিকমতো পাম্প করতে পারে না, তাতে পুরো রক্ত সরবরাহ হুমকিতে পড়ে। শরীরের সব জায়গায় রক্ত ঠিক মতো যায় না। হার্ট মাসল ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে দেখা গেছে যে, প্রতি চারজনের একজন কিডনি সংক্রান্ত সমস্যার মুখোমুখি হয়। এমনকি সুস্থ হবার পর কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়। কিডনি ডেমেজ থেকে কিডনি ফেইলিউর, কিডনির ফিল্টারিং ক্ষমতা কমে যাওয়া, কিডনি অনেকাংশে অকোজো হয়ে যাওয়া, এমনসব সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। সমস্যার তীব্রতায় ডায়ালাইসিসের দরকার হয়ে পড়ছে অনেক রোগীর।
হার্টের মতো কিডনিতেও অনেক ACE2 থাকে বলে কিডনির কোষ নেফ্রনের ভেতর ঢুকে কোষ মেরে ফেলে কিডনিকে অকোজো করতে পারে। ফুসফুসের অক্সিজেন সরবরাহের ক্ষমতা কমে গেলে কিডনিতেও অক্সিজেনহীন রক্তের কারণে কিডনির কাজগুলো ঠিক মতো হয় না আর। রক্তে জমাট বাধলে বিশেষ করে কিডনির ক্ষুদ্র রক্তনালীগুলোতে এমন রক্ত জমাট বেঁধে কিডনির ফিল্টারিং কমিয়ে দেয়। তাতে শরীরের বর্জ্য ঠিকমতো বের হতে না পেরে শরীর নিজেই বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
শুরুতে ধরা হতো রেসপিরেটরি ফেইলিউরে বেশি মারা যেত করোনা আক্রান্তদের। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে রক্ত জমাট বেঁধে। এই সমস্যাটি চিকিৎসকদের ভাবিয়ে তুলেছে। ICU তে রাখা এক তৃতীয়াংশ রোগী এই ব্লাড ক্লটের শিকার হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। বিশেষ করে মাইক্রো ক্লট, যা মূলত হার্ট, কিডনি, ফুসফুসের খুব ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র রক্তনালীগুলোতে কোনো এক অজানা কারণে রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে। এতে লোকাল এরিয়াতে ক্লগ তৈরী হচ্ছে। লোকাল ফাংশন ব্যাহত হচ্ছে। আস্তে আস্তে চেইন হয়ে অর্গেনকেই আক্রান্ত করছে । মাইক্রো ক্লট কেন হচ্ছে জানে না চিকিৎসকরা। কিন্তু রক্তনালিতে কি করে এমন জমাট বাঁধছে, তা জানে।
রক্ত নালীর ভিতরের দেহ আক্রান্ত হলে তা যে ইনফেকশন তৈরী করে তাতে রক্তনালীর স্ফিত হওয়া কমে যায়, রক্ত ঠিকমতো চলতে পারে না, তাতে রক্ত তার কণিকাগুলো নিয়ে বসে থেকে আরো পিণ্ড তৈরী করে। সেই পিন্ডে অন্য আরো কিছু প্রোটিন যুক্ত হয়ে জমাট পিণ্ড করে ফেলে । তাতে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কখনো সেই জমাট পিণ্ড কোথাও গিয়ে আটকে যায় ভালো করে । এমন করে কিডনিতে ফিল্টারিং কমিয়ে দেয়, হার্টে করোনারি ব্লক তৈরী করে, ব্রেইনে রক্ত এবং অক্সিজেনের অভাব ঘটিয়ে স্ট্রোক করায়, তাতে ব্রেইনের যে অংশকে আঘাত করেছে স্ট্রোক করে, সে শরীরের যে অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা প্যারালাইসিস করে দিতে পারে। করোনা থেকে সুস্থ হয়ে উঠলেও রক্তের এই জমাট অনেকদিন শরীরে থাকতে পারে।
বিশ ভাগ আক্রান্তের শরীরে ডায়ারিয়া একটি কমন লক্ষণ। এটি আক্রান্ত হবার প্রথম দিকে হয়ে থাকে। কয়েকদিন থেকে চলে যায়। কিন্তু সুস্থ হবার পর পেটের অনেক সমস্যায় অনেকদিন ভুগতে পারেন। ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, কারণ ছাড়াই হঠাৎ হঠাৎ ডায়ারিয়া হতে পারে সুস্থ হয়ে উঠবার কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত। এসবের কারণ হলো করোনা ভাইরাস শুরু থেকেই পাকস্থলী এবং পরবর্তীতে অন্ত্রকে আক্রান্ত করে। পাকস্থলীতেও ACE2 থাকে বলে করোনা ভাইরাস সহজে সেখানে গিয়ে বসে।
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে লিভারের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের তৈরিতে বাধা তৈরী হয়। প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং রক্তের সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে বলে যকৃতের কোষগুলোর ঠিকমতো কাজ করার ক্ষমতা কমে যায়। রাসায়নিক উপাদান গুলো উঠানামা করে। ঐসব উপাদানগুলো শরীরে নতুন কোষ গঠনে সাহায্য করে । ফলে নতুন কোষ তৈরিতেও বাধা পায়। সুস্থ হয়ে উঠলেও লিভার ফাংশনের অনেক কিছুতে ব্যাঘাত থেকে যায় অনেক দিন, এমনকি লিভারের কার্যক্ষমতা আগের চেয়ে হ্রাস পায়। লিভারের এফেক্ট গিয়ে পড়ে খাদ্যপরিপাকে এবং শরীরের পুষ্টি জোগানে।
নাকে ঘ্রান নেবার ক্ষমতা কমে যায়, যা করোনা ভাইরাসের একটি স্বীকৃত লক্ষণ এখন। পায়ের কিছু আঙ্গুল অন্য ধরনের লাল হয়ে যেতে পারে, যাকে বলে Covid Toe। খুব অল্প কিছু আক্রান্তের দেহে এই বিচিত্র লক্ষণটি দেখা গেছে। বাচ্চাদের বুক কিংবা পিঠের ত্বকে ফুসকুড়ি ছেয়ে যেতে পারে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে। এটাকে Kawasaki disease বলে।
এক দমে লেখাটি লিখে ভাবছিলাম, নতুন করোনা ভাইরাস শরীরের আর কোন কোন জায়গা তছনছ করে দিতে বাকি আছে। শরীর ভেঙেচুরে দম ফুরিয়ে দেবার সাথে সাথে ভাগ্যবানরা বেঁচে উঠলেও শরীরের কোথাও কোথাও তার ঝড়ের চিহ্ন রেখে যায় অনেক দিন ধরে।
এখন করোনা আক্রান্ত না হওয়া মানে জীবন লটারি পেয়ে বেঁচে থাকা। সুতরাং, এখনো সময় আছে, সতর্ক হোন, নিজেকে নিরাপদ রাখুন, এবং অন্যকে সচেতন করুন। আপনার সচেতনতার সাথে সাথে অন্যকে সচেতনতা আপনাকেই রক্ষা করবে।
1. Scientific American
2. Johns Hopkins Medicine
3. NHS UK & CDC USA
4. Journal of Virology
5. Nature Reviews Cardiology
6. Oxford Academic Cardiovascular Research
7. Preprint Server for Biology – BioRxiv
ডা. অপূর্ব চৌধুরী
চিকিৎসক এবং লেখক
জন্ম বাংলাদেশ, বসবাস ইংল্যান্ড
গ্রন্থ ৭
উল্লেখযোগ্য বই : অনুকথা, জীবন গদ্য, বৃত্ত