মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

গোবিন্দ ধর জন্মদিন সংখ্যা

মুগ্ধতা.কম

২৪ জুলাই, ২০২০ , ১০:০৪ অপরাহ্ণ

গোবিন্দ ধর জন্মদিন সংখ্যা

গোবিন্দ ধর জন্মদিন সংখ্যা

ত্রিপুরার কবি ও সম্পাদক গোবিন্দ ধর ৫০ এ পা রাখবেন আগামী ৩০ জুলাই। এ উপলক্ষে কবির সুহৃদদের অনুরোধে সাজানো হলো বিশেষ জন্মদিন সংখ্যা।

গোবিন্দ ধরের সংক্ষিপ্ত জীবনকথা: রচনা, সম্মাননা ও পুরস্কার

গোবিন্দ ধর

পিতা:  দক্ষিণা রঞ্জন ধর

মাতা: সুষমারাণী ধর

জন্ম: ৩০শে জুলাই ১৯৭১

জন্মস্থান :অফিশটিলা, ধর্মনগর, উত্তর ত্রিপুরা।

স্কুল: রাতাছড়া দ্বাদশশ্রেণি বিদ্যালয়। বর্তমান হাজিবাড়ি দ্বাদশশ্রেণি বিদ্যালয়।

পেশা: শিক্ষকতা।

প্রথম শিক্ষক জীবন:উত্তর রাতাছড়া উচ্চ বুনিয়াদি বিদ্যালয়:১৯৯১।

প্রথম প্রকাশিত রচনা:১৯৯১

প্রথম বই:জলঘর:২০০৭ (কবিতা সংকলন)।

 

ছদ্মনাম:চৈতন্য ফকির

 

সম্পাদিত কাগজ: 

স্রোত, স্রোত.f, স্রোত.কম, কবিতাঘর, কুসুম, বাংলাভাষা, বইবাড়ি, অন্যপাঠ উৎসব সমাচার, ভাষাচর্চা। 

 

প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্তি: ত্রিপুরা রবীন্দ্র পরিষদের, আজীবন সদস্য, স্রোতস্বিনী সাংস্কৃতিক সংস্থার সম্পাদক, মহামায়া নাট্য সংস্থার সম্পাদক

স্রোত পরিবারের সম্পাদক, দোলনার উপদেশক, 

কুসুম এর উপদেশক, কবিতাঘর:উপদেশক, বইবাড়ির কর্ণধার, ত্রিপুরার পুঁথি-পাণ্ডুলিপি গবেষণা কেন্দ্রের সংগ্রাহক, উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন গবেষণা ও চর্চা কেন্দ্র: সংগ্রাহক

বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ কুমারঘাট শাখার সম্পাদক, সৃষ্টিলোক সাংস্কৃতিক সংস্থার সহসভাপতি, ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন গিল্ডের সম্পাদকসহ অসংখ্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত আছেন।

 

কবিতা সংকলন:

———————-

(১) জলঘর

(২) সূর্যসেন লেন

(৩) দ্রোহববীজ পুঁতে রাখি,একা

(৪) মনসুনমাছি

(৫) শ্রীচরণেষু বাবা

(৬) আনোয়ারা নামের মেয়েটি 

(৭) দেওনদীসমগ্র

(৮) আষাঢ়ের দিনলিপি

যৌথ কবিতা সংকলন:

——————————-

(১) মেঘ বৃষ্টি রোদ

(২) গোপন জোছনা

(৩) তামাদি হয়নি যে ভালোবাসা

(৪)কখনো পাহাড় কখনো নদী

(৫) এই সময়ের বত্রিশ জন কবির কবিতা

(৬) আঞ্চলিক ভাষার কবিতা

(৭) শেখড়ের ধ্বনি

(৮) কবিতা :২০০১/২০০২/২০০৩/২০০৯/২০১০

(৯) সমকালীন পনেরজন কবির কবিতা

(১০) ত্রিপুরার আবৃত্তির কবিতা

আবৃত্তির অডিও সিডি:

——————————-

(১) দ্রোহবীজ:২০১৭

(২) আত্মদ্রোহ:২০১৭

(৩) শ্রীচরণেষু:২০১৭

ছড়া সংকলন:

——————–

(১) থইথই ছড়া

(২) তোমার উনিশ আমার একুশ

যৌথ ছড়া সংকলন:

—————————

(১) এই শতাব্দীর ছড়া

প্রবন্ধ ও গবেষণা:

————————

(১) শ্রীহট্টীয় লৌকিক সংস্কৃতি ও শব্দকোষ

(২) আত্মক্ষর

(৩) ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিন

(৪) ত্রিপুরার সাহিত্যকোষ

(৫) ত্রিপুরার লেখক অভিধান

(৬) কুমারঘাটের ইতিবৃত্ত ও তথ্যপুঞ্জী

(৭) কুমারঘাটেরর স্থান নাম

(৮) ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিন শিশুসাহিত্য ও অন্যান্য 

(৯) আলোকিত বিজয় রায়

ছদ্মনামের আড়ালে:

—————————

(১) সময়ের গোল্লাছুট

সম্পাদিত:

—————-

(১) শতবর্ষের আলোকে সমর সেন:ফিরে দেখা

(২) হিমাদ্রি দেব রচনা সমগ্র

(৩) ত্রিপুরার প্রথম কবিতাপত্র জোনাকি সমগ্র

(৪) অনন্য অনিল সরকার

(৫) জননেতা দশরথ দেব:জীবন ও সংগ্রাম

(৬) কথাসাহিত্যিক শ্যামল ভট্টাচার্য

(৭) সমকালীন ত্রিপুরার পাঁচজন কবি সাহিত্যিক

(৮) পীযুষ রাউত উজ্জল উদ্ধার

(৯) বিকাশ জীবন(হাজিরা কামলা থেকে লেখাকর্মী)

(১০) কথাসাহিত্যে শ্যামল বৈদ্য

(১১) বাংলাসাহিত্যের অহংকার কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন 

সম্মান ও পুরস্কার:

————————-

(১) কুমারঘাট নগর পঞ্চায়েত:২০০১

(১) অণির্বান দেশবার্তা:২০১০

(২) উত্তরণ :২০১২

(৩) প্রাণেরকথা:২০১৫

(৪) বিজয়া:২০১৬

(৫) বহ্নিশিখা সম্মান:২০১৭

(৬) কথাশিল্প(পশ্চিমবঙ্গ):২০১৭

(৭) সৃষ্টিলোক:২০১৭

(৮) ক্রিয়েটিভ :২০১২

(৯) ষষ্ট  উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন(আসাম):২০১৬

(১০) বিশ্ব কবিমঞ্চ, আগরতলা শাখা সম্মান:২০১৭

(১১) সমভূমি সাহিত্য সম্মান:২০১৮

(১২) উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মান(পশ্চিমবঙ্গ) :২০১৮

(১৩) শব্দকোষ সাহিত্য সম্মান:২০১৮

(১৪) মণিহার সাহিত্য সম্মান:২০১৯

(১৫) উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মান(আসাম):২০১৯

(১৬) আন্তর্জাতিক ভাষাচর্চা সম্মান(আাসাম):২০১৯

(১৭) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সম্মান(আসাম):২০১৯

(১৮) মাতৃভাষা সম্মান স্মারক (উধারবন্দ,আসাম):২০১৯

(১৯) বিশ্বনাথ দে স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার(সুতপা,ঝাড়খণ্ড):২০১৯

(২০) প্রয়াসী সম্মান:২০১৯

স্মারক সম্মাননা সংখ্যা 

(১) ক্রিয়েটিভ :২০১২

গোবিন্দ ধর : নিষ্ঠ আলোকপাত

(২) মনুতট:২০১৮

কবি ও কথাকর্মী গোবিন্দ ধর সম্নাননা সংখ্যা 

(৩)স্রোত রজতজয়ন্তী বর্ষ সংখ্যা :স্রোত ও গোবিন্দ ধর সংখ্যা 

বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়: 

বাংলাদেশের অনেকগুলো কাগজে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে গোবিন্দ  ধরের লেখা প্রকাশিত হয়ে চলেছে। 

বাংলাদেশে সম্মান ও পুরস্কার: 

(১) বিশ্ব কবিমঞ্চ একুশে পদক:২০১৬

(২) কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ স্মৃতি পুরস্কার :২০১৬

(৩) বাংলাদেশ বুকক্লাব সম্মান:২০১৭

(৪) দক্ষিণ এশিয়া সাহিত্য সম্মান :২০১৭

(৫) বজ্রকথা সাহিত্য সম্নান:২০১৭

(৬) চট্রগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র সম্মান:২০১৭

(৭) সাহিত্য একাডেমি ব্রাহ্মণবাড়ি সাহিত্য সম্মান:২০১৭

(৮) কন্ঠসাধন সম্মান:২০১৭

(৯) বরমা বৈশাখী মেলা সম্মান:১৪২৪

(১০) উষসী সাহিত্য -সংস্কৃতি পর্ষদ সম্মান :২০১৮

(১১) সিলেট বইমেলা অতিথি সম্মান :২০১৮

(১২) জয়বাংলা ইয়থ এয়ার্ড:২০১৯

গান:

গোবিন্দ ধরের কথায় সুর দিয়েছেন অনেক সুরকার।

অনুবাদ :

তাঁর বিস্তৃত রচনাসম্ভার হিন্দি, ইংরেজি, চাকমা, অসমীয়া, ককবরক, মৈথেয়ী মনিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়া, মগ প্রভৃতি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। 

ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন ও গোবিন্দ ধর

জহর দেবনাথ

মানবসভ্যতার ক্রম বিকাশে আন্দোলন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ  বিষয় এবং একটি অপরিহার্য প্রক্রিয়া। সেই আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বর্তমান আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় উত্তীর্ণ হওয়ার পথে, প্রতিটি ধাপে আন্দোলন আন্দোলন নামক প্রক্রিয়ার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ জীব মানব বা মানব সভ্যতার ক্রম বিকাশের ক্ষেত্রে যে ক’টি প্রক্রিয়া বা উপকরণ উল্লেখ যোগ্য তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে মানবের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি । আহার -বাসস্থান, পোষাক এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এই সব কিছুর মেল বন্ধনই হচ্ছে মানব জাতির কৃষ্টি ও সংস্কৃতি । মানব জাতির ক্রম বিকাশের ধারাবাহিক অতীত এবং বর্তমান কর্মকাণ্ডের লিপিবদ্ধকরণ প্রক্রিয়াই হল সাহিত্য। এই সাহিত্য যেমন অতীতকে মনে রেখে বর্তমান কে পরিচালনা করে, তেমনি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশও করে ।

মানবসভ্যতার কৃষ্টি সংস্কৃতির উল্লেখ যোগ্য উপকরণ সাহিত্য । আর এই সাহিত্যের অন্যতম একটি উল্লেখ যোগ্য ধারা হলো লিটল ম্যাগাজিন ।বাংলা সাহিত্যে লিটল ম্যাগাজিনের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল বঙ্কিম যুগ থেকেই । তখন থেকেই বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন ধারায় আন্দোলনের মাধ্যমে লিটল ম্যাগাজিন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে ।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে গোবিন্দ ধর এবং উনার অন্যতম সৃষ্টি স্রোত লিটল ম্যাগাজিন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিশা । পার্বতী রাজ্য ত্রিপুরার প্রত্যন্ত এক গ্রামে গোবিন্দ ধরের জন্ম হলেও আপন চিন্তা চেতনা এবং সৃষ্টিশীল কাজের মধ্য দিয়ে গোবিন্দ ধর কেবল মাত্র ত্রিপুরা রাজ্য নয়, নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে শ্রী ধরের সাহিত্যপ্রিয়তা আজ সর্ব্বজন বিদিত । আধুনিক বাংলা সাহিত্যের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন কে এক অন্য মাত্রায় রূপায়ণের ক্ষেত্রে স্রোত ম্যাগাজিনের ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কেবল মাত্র ব্যতিক্রমী লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার ক্ষেত্রেই গোবিন্দ ধর নিজের কর্মকান্ড কে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। সত্যি কথা বলতে স্রোতের তো কোন রকম সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে না, সীমাবদ্ধতা হতে পারে না । তাইতো দেখি স্রোত লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের পাশাপাশি সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় বহুমুখী গতিপথ বিস্তার করে একটা বৃহত্ ক্ষেত্র বা স্বপ্ন জগত সৃষ্টি করতে সচেষ্ট । সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বিভিন্ন ধারাকে একত্রিত করে একটি বৃহত্তর স্রোত ধারার সৃষ্টি করতে গোবিন্দ ধর আজ সফল । আর এই সফলতার বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক দিকে দিকে ।গতিময়তার ঐ স্রোত ধারায় আমরাও স্নাত হতে চাই । স্রোত হোক আরো আরো বেগবান, প্রবাহিত আপন ধারায় ।

জহর দেবনাথ: লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক, ত্রিপুরা।

*

বহমান নদীর হৃদয়াকুতির নাম স্রোত

বিকচ চৌধুরী

বহমান নদীর হৃদয়াকুতির নাম স্রোত । গঙ্গা পদ্মা যমুনার বুকে যে আকাংখার  দোলা দেও মনু গোমতীর বুকেও প্রবহমানতার  সেই  সমন আবেগ।

তথাকথিত রাজধানীর  নাগরিক জীবন  থেকে অনেক দূরে বসে তাই আমরা দেখতে পাই সাহিত্য সাধনার এক নির্মল “স্রোত”ধারা নীরবে বয়ে চলেছে উত্তর ত্রিপুরার  ‘বইবাড়ি’  থেকে ।

লিটিল  ম্যাগ  আন্দোলনের মূখ্য  স্রোতধারা  থেকে  প্রকাশনা  শিল্পের  সুকঠিন চ্যালেনজের  মুখেও সমান  উজ্জ্বল  গতিধারার স্বাক্ষ্য রেখেছে স্রোত ।কঠিন  প্রতিযোগিতার মধ্যেও ত্রিপুরা ও  পশ্চিমবঙ্গে বার বার গুণমানে শ্রেষ্টত্ব এর  স্বীকৃতি  গভীর  অধ্যবসায়েরই পরিচাযক।

স্রোত  শুধু  বই ছাপে না  গভীর  মননের  বিষয় ছাপে। প্রজ্ঞার  উণ্মেষের সাধনার মননের  সৃষ্টির  নতুন  দিগন্তের অভিসারী স্রোত মোহনার  পথে  তার যাত্রা অবিরত ।

বিকচ চৌধুরী: মুক্তিযুদ্ধ ও রবীন্দ্র গবেষক, আগরতলা, ত্রিপুরা।

*

কবি গোবিন্দ ধর

মিলনকান্তি দত্ত

গোবিন্দ ধর শুধু কবি নন, একাধারে স্রোত পুস্তক প্রকাশনা, সাময়িকী সম্পাদনা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনসহ বিচিত্রবিধ সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত অতি জীবিত এক দ্রোহবীজ। যা তাঁর স্বখোদিত ভাস্কর্যের মতো প্রস্ফুটিত। তাঁর কবিতা পাঠের সাথে সাথে পাঠক স্বখননের সলিলে ডুবে যাবেন নিজেরই অজান্তে এ বিশ্বাস ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। কবি যেন এক সুদক্ষ শৈল্যবিদের মতো নিজের জীবনকে নিজেই কাঁটাছেড়া করতে করতে বিশুদ্ধ উচ্চারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন জীবনবেদ। আর পাঠক সেই বেদবীজ থেকে খুঁজে পাচ্ছেন যেন নিজেরাই দ্রোহবীজ।

মিলনকান্তি দত্ত: কবি ও প্রাবন্ধিক, পানিসাগর, ত্রিপুরা।

*

উত্তর-পূর্ব লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের সংগ্রাহক গোবিন্দ ধর

আ. জাহিদ রুদ্র

‘এক বইয়ের পাঠক সম্পর্কে সাবধান —হুমায়ুন আজাদ’

লিটল ম্যাগাজিনকে কাল্ট বলবো, নাকি প‍্যাশন? সেই গণতন্ত্র যে কারোর কথা মানেনা, আপোষহীন, স্বতন্ত্রভাবাদর্শে কমার্শিয়াল চিন্তার বিপরীতে এক মুক্তমঞ্চ। লিটল ম্যাগাজিনের লেখাগুলো আমাদের আদর্শ শেখায় না, বরং জীবনকে তুলে ধরে, যা যাপনের অর্থ বুঝায়। লিটল কেন বলি? কারণ এখানে যেসব সম্পাদকেরা কাজ করেন যাঁরা খুঁজে আনেন সেসব লেখক, যাঁদের কেউ চেনে না, সেইসব বিষয় যা নিয়ে কাজ হয়নি। বিজ্ঞাপনের সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে সরে নিজের পকেট খালি করে পত্রিকা চালান লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা। সাহিত্য চর্চার সঙ্গে সঙ্গে দেশের জনজীবনকে ঘনিষ্ঠ ভাবে জানার সুযোগ করে দেয় লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিন এর হাত ধরেই সাহিত্যে আধুনিকতার আবির্ভাব ঘটেছে। সাহিত্যে যত ধরণের আন্দোলন হয়েছে, যে আন্দোলন কে বলা যায় সাহিত্যের প্রাণশক্তি, তা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের মাধ্যমে।

১৯৯৫ সাল থেকে সেই সাহিত্য আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে আছেন আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্যের, যিনি আমাদের কাছে কবি, কথাশ্রমিক, প্রকাশক হিসেবে পরিচিত গোবিন্দ ধর। কিন্তু আজ আম‍রা এই শব্দচাষির অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা করবো— ” উত্তর-পূর্ব লিটলম্যাগ সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের” সংগ্রাহক গোবিন্দ ধর হিসেবে। উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন বইয়ের সাথে অকৃত্রিম ভালোবাসা। সম্ভবত বাবার বই প্রীতি ও পাঠ অভ‍্যাস গবেষক গোবিন্দ ধরকে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে আর পিছপা দিতে হয় নি। ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের তিনি পুরাধা সৈনিক। যার অক্লান্ত পরিশ্রম ও কর্মপ্রতিভার দ্বারা এক মহতী উদ‍্যোগের দ্বারা প্রকাশ পায় ১০ জুন ২০১৮ তারিখে ঊনিশটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের নিয়ে যা ” ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন গিল্ড “। গোবিন্দ ধর শুধু কবি,প্রাবন্ধিক নন তার মধ্যে রয়েছে সাহিত্য গবেষণার দারুণ স্পৃহা। যার ফলস্বরূপ লিটল ম‍্যাগ আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে সাহিত‍্যে সুপ্ত থাকা অনুরাগ সাহিত্য বেলাভূমিতে বহিঃপ্রকাশ করেছেন নিজ হাতে। ত্রিপুরা থেকে শুরু করে গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চল তথা সুদূর বাংলাদেশেও চালিয়ে যাচ্ছেন এই মিলন।

শব্দ শ্রমিক গোবিন্দ ধরের স্রোতস্বিনী সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠনের দিনই অর্থাৎ ১৯৯৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখে এই লিটল ম্যাগ সংগ্রহশালাও গঠিত হয়। তখন এই সংগ্রহশালায় ছিল উনার বাবার জমানো বই। বই-পত্র যা ছিল সব পুরোনো। কয়েকটা সন্দেশ, সোভিয়েত দেশের বই তা দিয়ে লাল ফিতা কেটে যাত্রা শুরু হয় ‘উত্তর পূর্ব লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র। সাহিত্যে শৈল্পিক রুচির খুবই প্রয়োজন। যা যথাযথ বিদ‍্যমান গোবিন্দ ধরের কাছে। উনার বাড়ি রাতাছড়া হলেও সারা ত্রিপুরা বইমেলা থেকে প্রকাশিত প্রায় সব বই কিনে আনতেন। ভালো মন্দ বিচার করে নয়, ত্রিপুরার প্রকাশিত বই এটাই তাঁর লোভ মোহ আর টান টান উত্তেজনা।পাঠক হিসেবে ও যে কতটা প্রগাঢ় ভালোবাসা বই এর প্রতি তা জানতে পারি যখন মেলাতে বসেই পড়তেন নেশার টানে। সংগ্রহ শালার জন্য কি কিনেন নি। পাঁচ টাকা দশটাকা থেকে শুরু করে অন্ধকারে প্রণামের ইচ্ছে হয় সবই কিনলেন বই মেলা থেকে। সন্তোষ রায়ের নদী মাতৃক, স্বরূপের ভিটামিন শুভেন চৌধুরীর বই আদি। ধর্মনগরের সন্তোষ দা’র নয়া পাড়ার ভাড়া বাড়ির প্রযত্ন আড্ডা থেকে আরও বই কিনে আনেন। ২০০৩ সালে সংগ্রহশালা কিছু দিনের জন্য কৈলাসহরের বৌলাপাশায় স্থানান্তরিত হয়। অল্প কিছু দিনের মাঝেই কুমারঘাট বর্তমান হালাইমুড়ায় নিয়ে আসেন। এখন এই বিপুল পরিমাণ বইয়ের সংসার “উদ্দিপ্ত গ্রন্থাগার থেকে সংগ্রহশালা তারপর নাম দিলেন “উত্তর-পূর্ব লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র”।

ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের এক দীর্ঘ ইতিহাস। তা জানতে পারি গোবিন্দ ধর সম্পাদিত ‘ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন’ বইটি পড়ে। গোবিন্দ দা’র এক সাক্ষাৎকারে জানতে পারি রবি, শ্রীভূমি পত্রিকা থেকে শুরু করে ৬০-৭০ দশকের উল্লেখযোগ্য পত্রিকা তথা বর্তমান পর্যন্ত সংগ্রহ করে আসছেন। আরও জানা যায় রবি পত্রিকা কে কেন্দ্র করে ত্রিপুরা সাহিত্য চর্চায় মোড় এসেছিল। বর্তমানে কুমারঘাট লিটল ম্যাগাজিন এর কেন্দ্র। কারণ এখান থেকেই প্রকাশিত হয় স্রোত, কবিতাঘর,দোলনা, সৃষ্টিলোক,মনূতট,সমকাল,বইবাড়ি, জয়িতা স্রোত.f, স্রোত.com,এখন সময়,তুলিকা,বাংলাভাষা, ঊনকোটি, অন‍্যভূমি,অন‍্যপাঠ,পারমিতা, কাব‍্যমুখ,উৎসব সমাচার, শ‍্যামালিমা,প্রয়াসী,। তাঁর অক্লান্ত সাহিত্য শ্রমই তাঁকে পরিচিতির আলোকে সারা বাংলা সাহিত্যের পাঠক গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছে।

ত্রিপুরার কুমারঘাটের শব্দ শ্রমিক গোবিন্দ ধর বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর এই উদ‍্যমশীল মনোভাব আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সোপান। এই শব্দচাষীর বাংলা ভাষার প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা  এই প্রজন্মের অক্সিজেন। তাঁর এই গবেষণাকে লাল সেলাম।

আ. জাহিদ রুদ্র: কবি ও সম্পাদক, করিমগঞ্জ, আসাম।

*

বৈঠা ধরো, এগিয়ে আসছে স্রোত

সুশান্ত নন্দী

যার ভাবনা প্রোথিত হয়ে ওঠে তরুণ তুর্কীদের পাণ্ডুলিপিতে। যে মানুষটির অনুভব নিয়মিত বর্ষিত হয় নবীন শব্দ শিল্পীদের জন্য। যে মানুষটি আগামীর সম্ভাবনা নিয়ে পথ হাঁটেন। যে মানুষটি পরবর্তী প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে একসাথে  পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে চায়। নান্দনিকতার উদ্ভাস গায়ে মেখে কোনও এক কোজাগরী রাতের জোছনা লোকে যে মানুষটি স্বপ্ন দেখেছিল এই সভ্যতার তরুণ সমাজকে সাহিত্যে ভাবনায় এগিয়ে নিয়ে যাবার; তিনি গোবিন্দ ধর। একটি ছোট মফস্বল এলাকা থেকে শুরু করে ক্রমশ বিভিন্ন জেলা এবং নিজের রাজ্য ত্রিপুরার নবীন প্রতিভাদের সাজিয়েছেন সাহিত্য ভাবনায়। সাহিত্য আন্দোলনকে রাজ্যের সীমানার বাইরে নিয়ে গিয়ে অন্যান্য রাজ্যেও প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু তা-ই বা কেন, শব্দ যাত্রী হয়ে পৌঁছে গেছেন প্রবাসেও ।তরুণ সমাজকে সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে নানানভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনিই। এই যে বিরামহীন পথ চলা, সাহিত্য ক্ষেত্রকে প্রসারিত করবার লক্ষ্যে  এবং পরবর্তী প্রজন্মের  হাতে এই সাহিত্যচর্চার দায়ভার অর্পণ করাটাও খুব একটা সহজ কাজ নয়। তবুও অদম্য শক্তিকে সঞ্চারিত করে তিনি ক্রমশ চৈতন্য ফকির হয়ে হেঁটে যাচ্ছেন শব্দের মিছিলে ।  তার এই বোহেমিয়ান জীবন সম্পর্কে ইতিমধ্যেই গ্রন্থিত হয়েছে অনেক পর্ব। এছাড়াও প্রকাশনা জগতেও তিনি ব্যক্তি নয় প্রতিষ্ঠান ।তার প্রকাশনা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যে পৌঁছে গিয়েছে এবং অনেক নতুন লেখকরা ঠাঁই পেয়েছে তার সেই ছত্রছায়ায়। এই উদ্যোগকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। তাই আজ অজস্র মানুষের হৃদয়ে তাকে নিয়ে তৈরি হয় অসংখ্য শব্দকল্প। যার বন্দিশ মুখরিত হয় আমার মতন শব্দ যাত্রীদের বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপট জুড়ে।অনন্ত কাল ধরে এগিয়ে চলুক এই স্রোত। এই শব্দ তরী।দোদুল্যমানতায় ভাসুক সমস্ত নির্মাণ শৈলী।

সুশান্ত নন্দী: কবি ছড়াকার, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ।

*

স্রোত বাংলাভাষার নন্দিত অবলম্বন

তপন বাগচী

স্রোত কেবল সাহিত্য পত্রিকা নয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। স্রোত আজ এক প্রণতির নাম,আপসহীন আন্দোলনের নাম। সীমিত সাধ্যে অন্তহীন সাধ পূরণের নাম স্রোত। ঢাকা-কলকাতার সাহিত্য খবরদারীকে থোড়াই কেয়ার করে এগিয়ে যাওয়ার নাম স্রোত। নতুন লেখা প্রকাশের আন্তরিক দরোজার নাম স্রোত। নতুন চিন্তা প্রকাশের অর্নগল জানালার নাম স্রোত। এই স্রোতের ধারায় এগিয়ে চলেছে ত্রিপুরার সাহিত্য -সংস্কৃতি। এই স্রোতের টানে চলে আসা পলিতে ঊর্বর হয়েছে ত্রিপুরার সৃজনক্ষেত্র। আজকে সৃজন-মননের সোনালী ফসল দৃশ্যমান তার বীজতলা তৈরিতে ২৫ বছর ধরে নীরবে কাজ করেছে স্রোত। স্রোতের সম্পাদক কবি গোবিন্দ ধর আজ সপারিষদ ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

মূদ্রণের আধুনিক সুবিধাবঞ্চিত ত্রিপুরা থেকে একটি দৃষ্টিনন্দন পত্রিকা প্রকাশ যে কতটা চ্যালেঞ্জের তা ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝতে পারেন না।সকল চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে “স্রোত “হয়ে উঠুক বাংলাভাষার নন্দিত অবলম্বন -এই প্রত্যাশা রইলো।

তপন বাগচী: কবি,উপপরিচালক,বাংলা একাডেমি, ঢাকা, বাংলাদেশ। 

*

গোবিন্দ নদী

হারাধন বৈরাগী

কবি গোবিন্দ ধরের সাথে পরিচয় সহসা একটা  লিটলম্যাগ”এই বনভূমি”কে কেন্দ্র করে। ‘রজতজয়ন্তী’সংখ্যা। এই লিটলম্যাগটির জন্ম হয়েছিল কবি সত্যেন্দ্র দেবনাথের হাতে সম্ভবত ১৯৮১তে উত্তর ত্রিপুরাজেলার দেওভ‍্যালির কাঞ্চনপুরে। এই সংখ্যার জন্য কবি বিশ্বজিৎ দেবের হাত ধরে লেখা সংগ্রহ করতে গিয়ে কবি গোবিন্দ ধর ও পদ্মশ্রী মজুমদারের লেখা পাই। যথারীতি ছেপে ম্যাগটি বের হয়।আর সৌজন্য কপি দিতে গিয়ে তাঁর সাথে পরিচয়।স্থানীয় অনেক কাঁচালেখা নিয়েই এই সংখ্যাটি প্রকাশ হয়েছিলো।তিনি সেদিন ম্যাগটি হাতে নিয়ে অনেকগুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, এটির যদি পুরোনো কোন সংখ্যা দিতে পারি  সেটিও তাঁর উদ্দিপ্ত সংগ্রহশালায় রাখবেন।

সেদিন মোটেই বুঝতে পারিনি ইতিপূর্বেই তাঁর লিটলম্যাগ আন্দোলন ও ইমপ্রিন্টছাপাখানার শুভযোগ ঘটেছে রাতাছড়ায়। আর ততদিনে পোড় খেতে খেতে একটি সিঁড়ি তৈরি করে চলেছেন দেওমনু সঙ্গম থেকে মোহনার দিকে। এখানেই তিনি উদ্দিপ্ত সংগ্রহশালা ও প্রকাশনা সংস্থার জন্ম দিয়েছেন।তখন জানতাম না এই মানুষটির ভেতরেই বইছে অহর্নিশি নদীধারা। তাঁর সাথে আমার দ্বিতীয়বার দেখা ২০১৫ এ  গণ্ডাছড়ার জগবন্ধুপাড়ায়। ঘটনাচক্রে ত্রিপুরার আরেক সুকবি অপাংশু দেবনাথ একদিন কবিকে নিয়ে আমার জগবন্ধুর ডেরায় উপস্থিত হোন। তাঁদের এই উপস্থিতি বলতে হয় আমার জীবনে একটি মাইলস্টোন।কবি গোবিন্দ ধরের প্রকাশনা থেকে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ – “হাসমতি ত্রিপুরা “প্রকাশিত হয়। আর বলতে গেলে এই থেকেই আমি তাঁর সাথে জড়িয়ে যাই।

আমার ডেরাতে তাঁরা এক রাত কাটিয়েছিলেন।ডেরার পাশদিয়ে বয়েচলা নদী সাইমাতে তাঁরা স্নান করেছিলেন।আর একে একে তাঁদের ভেতর থেকে উৎসারিত হয়েছিলো সাইমাবন্দনা।তখন বুঝতে পারিনি নদী গোবিন্দজীবনের দ্যোতক-নদী তাঁর  জলজনারী – দেওলানারী-মনোনারী  কিংবা কলিজাখাকি বেগম। বুঝতে পারিনি গোবিন্দ নদীর সন্তান, নদীর উত্তরাধিকার সে- যাঁর ভেতর জারি জুরী করছে জুরী, কলবল করছে মনু,শিৎকার করছে দেও-ডুয়ার্সের ডায়না লাফাচ্ছে বুকের ভেতর-গাড়ো রমনীর পিঠের বাচ্চার মতো হাতছানি দিচ্ছে তিতাস-মাঝে মাঝে উপনিষদ ধার দিচ্ছে রবীন্দ্রের কোপাই।

আমি লক্ষ্য করেছিলাম – তিরতির সাইমা সেদিন তাঁকে অসম্ভব বাঁধনহারা করে তুলেছিলো।সেদিন কবির নদীবন্দনার খণ্ডাংশ  এখানে তুলে ধরছি-‘সাইমার ছলছল জলে যখন  স্বিগ্ধ হচ্ছি,তখন হাসমতি যেন ভেজা শরীরে উপুড় হয়ে জলে কী খুঁজছিল।মনে হলো আমরা যুগযুগ ধরে এরকম দৃশ্যের সাক্ষিছিলাম।আজো হলাম আগামীদিনও হবো।সারাদিনের জুমছাই নিমিশেই ধুয়েমুছে গেলো–।

ইদানিং কবির তিনটি নদীকাব্যগ্রন্থ  অবগাহন করতে গিয়ে বুঝতে পারছি – সেদিন কবি যেন হাসমতি ত্রিপুরা রূপে তাঁর হারানো মাকে খুঁজছিলেন-যিঁনিএকদিন কবিকে মনুর উজানের ধারায় ছেড়ে দিয়ে ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।কেননা আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ” হাসমতি ত্রিপুরা” নামের তিনিই খননকার।সেদিন আমার গোটা কয়েক কবিতা পড়েই  বলেছিলেন – ‘আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থে নাম হোক – ” হাসমতি ত্রিপুরা।” আমার মনে চেরাগ জ্বালিয়ে দিলেন। ততদিনে অনেকজল সাইমা আর দেওনদী দিয়ে বয়েগেছে তাঁর সাথে কখনও আড়ালে কখনও প্রকাশ্যে মুখোমুখি হয়েছি।কিন্তু তাঁর ভেতরের নদীটিকে তখনও অনুধাবন করতে পারিনি। ইদানিং কবিবন্ধু অভীককুমার দে আমাকে একদিন প্রস্তাব দিলেন কবি গোবিন্দ ধরের নদীকাব্যসমূহ সম্পাদনা করতে।কিন্তু শুরুতে আমি শংসয় প্রকাশ করি – কেননা কোন কবির কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করার মতো পড়াশোনা আমার নেই।তবু আমাকে রাজী হতে হলো।মনে মনে ভাবলাম একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি কি হয়।কবির এই পর্যন্ত তিনটি নদীকাব্য। “আনোয়ারা নামের মেয়েটি” “মনুনদী সমগ্র “, ও দেওনদী সমগ্র।শুরুতে তাঁর নদীকাব্যে সাঁতার কাটতে গিয়ে আমি খাবি খেতে থাকি। কবিতা গুলির শরীরের বুনোন সরল হলেও  নদীর মতোই  সর্পিলাকার অসংখ্য বাঁক নিয়ে বহতা । অনেক কাটাছেঁড়া করতে করতে যখন একপাড়ে ভর করি ত অন্যপাড় সরে যায়। কিন্তু আমাকে তো  নদীপথে চলতে গেলে কোন একপার ধরে এগোতেই হবে। তাই একটি তীর ধরেই নদীগুলিকে এক সূতোয় বাঁধার চেষ্টা করে চলেছি। একটা সূতোয় বাঁধতে গিয়ে দেখি কবি গোবিন্দের  নদীর খলবল যেন ক্ষীন হলেও শুনতে পাচ্ছি। এই ক্ষীন শব্দ শোনতে পারার কারন হয়তো আমি গোবিন্দ নদীর খনন ধরে ঠিকভাবে এগিয়ে যেতে পারিনি। । নিজের মতো করে যতোটুকু খোদিত পথের সন্ধান করেছি তা থেকে বুঝতে পেরেছি কবি  শৈশবের কিছুসময় জুরীনদীর  জারি জুরীতে অবগাহন শেষে বয়:সন্দি ও যৌবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন তাঁর বংশনদী মনুর সাথে। এখানে তাঁর – জলখেলি- বালুস্নান মানঅভিমান-লড়াইসংগ্রাম-গ্রহন বর্জন- পাঠশালা। এখানেই তাঁর জলজ জীবনের উপলব্ধি। পিতার অনুসৃত উজানপথের নির্মানে আত্মখনন-আত্মরতি। উদ্দেশ্য লক্ষ্য ও দর্শন নির্মিতি।তাই তিনি বলতে পারেন-‘মনুখণ্ডে লিখি জলজ মুখ/আমার সকল আত্ম পরিজন লিপি।’ অথবা’—-পূর্বপূরুষ এই মনুতেই তিরতির স্রোত।’ এখানেই কালের কর্কটসন্ধিতে দাঁড়িয়ে কবির স্বপ্নভঙ্গ ও হতাসার সুর শুনতে পাওয়া যায়। তিনি বলেন-‘রাত নামার আগেই তুমি নদী হয়ে বয়ে যেতে/সেই সব দিনগুলো হারিয়ে গেলো বহুদিন।

/ হারানো দিনের কাছে গিয়ে দেখি তুমি আর তুমি নও।

তুমি কেমন মুঠিয়ে যাওয়া মায়াশরীর।/

নদী খোঁজতে গিয়ে পাইনি জল।জলের গল্প বলে চলে আসি।/নদীতো নদীই ছিলো জলের কলকল।

তুমি কোথায় নদী ফেলে  মনোরম জলেরপ্রবাহ।'(নদীর কাছে নদী নেই)। ‘আবারও

তিনি  “জলকন্যা” অনুগল্পে বলেন-‘জল জল চারিধারে জল।মাঝে একটি পাথর।এই পাথর ভেদ করে গাছপালা সবুজ।আর এই সবুজে ডুবে যাচ্ছে প্রাচীন সূর্য। এমন সময় ঘটনাটি ঘটলো।কি এমন ঘটনা? অপূর্ব দেখলো সবুজ ঘেরা এই দ্বীপ থেকে আলো টিকরে পড়ছে। পড়ন্ত সূর্যের  আলো ছাপিয়ে লাল আলো। ভালোভাবে দেখলে একটি সদ্য বয়সন্ধি পেরোনো মেয়ের অবয়ব বুঝা যায়।ব্রহ্মপুত্রের স্টীমার ধরে অবয়ব আবিস্কারে বেরিয়ে পড়লো তখনই অপূর্ব।যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়।ধীরে ধীরে সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার গ্রাস করে।লাল আলোর অবয়ব জলে মিশে এখন আর দৃশ্য নয়।লাল কালো কালো লাল জল শুধু জল তরঙ্গ।অপূর্বের মনেও জলকন্যার তরঙ্গ বইছে।এক বুক তৃষ্ণা ব্রহ্মপুত্রের স্রোতের মতো অপূর্বের মনে টেউ তুলে জলকন্যা।

অবশেষে দেখি কবির ফের মূলজ সন্ধানের উপলব্ধি।তাই কবি নুতন করে আত্মশক্তি লাভে উজীয়ে চলেন  মনুসঙ্গম থেকে তাঁর বংশের পূর্বজ দেওনদীর স্রোত ধরে- তাঁর মূলজের সন্ধানে।জ্ন্ম যাঁর কর্কটসন্ধিতে আর এই কর্কটসন্ধিতে দাঁড়িয়েই তিনি নদীর উজানধরে এগিয়ে চলেন এর হেতু ও  নিরসন কল্পে।তিনি বলেন-‘তিনপুরুষ বামপথ ধরে/হাঁটতে হাঁটতে /বাবার গায়ে/বামপন্থী

পতাকা সেঁটে আছে/আমিও বাবার/দেখানো পথে মুক্তি খুঁজি

আর বাম আর্দশে বড় হই/বামপথ মানে আমার কাছে/

বাবার দেখানো আলোর সড়ক।’কিংবা-তিনি বলেন-‘ বাম পথ /ঠিক গন্তব্যে নিয়ে যাবে/এই আপ্তবাক্য/ বাবা শিখিয়েছেন, আমাকে।(শ্রীচরণেষু বাবা)।

এই পর্বে তিনি নিজের জীবনকে কাঁটাছেড়ার মাধ্যমে উজীয়ে চলার লড়াই- সংগ্রামের হাতিয়ার পেয়ে যান শব্দ-শব্দবাণ। । তিনি হয়ে ওঠেন শব্দশ্রমিক।একজন শব্দকর।এ যাবৎ  শব্দকর শব্দে যারা হীনমন্যতায় ভোগেন -যারা এযাবত গোপন করে চলেছেন তাদের বংশানুক্রমিক পদবি।গোবিন্দ তাঁদের হীনমন্যতার বিরোদ্ধে এক প্রতিকী প্রতিবাদ।তিনি শব্দকর শব্দের এক গর্বিত পরিভাষা।

একটা সময় ক্লান্ত হয়ে এসেছিলেন দেওনদীর কূলে খানিকটা ঝিরিয়ে নিতে। এখান থেকে তিনি সর্বশক্তিতে  ব্রেন্ডবাজিয়ে  উজীয়ে চলেন যেন টাইমমেসিনে – মূলজের সন্ধানে-যেখানে গিয়ে তিনি মেরামত করবেন তাঁর উত্তরাধিকার-মানুষের উত্তরাধিকার।তাঁর বিশ্বাস – ‘তোর্সাই যখন ডায়না তখন তার আরো ক্ষ্যাপামিতে/পাথর সব গড়িয়ে নিয়ে নামে গহীন গাঙে’/—–এতো যে লাফায় ডায়না যায় জলপাইগুড়ি?/

জল আর জল শরীরের প্রাণ পাথর তার আত্মা।/

ডায়নার বর্ষাসুন্দরী পাথর খাবলে ধরে শরীরী ক্ষুধায়/

উজানের জলঘর থেকে মাখে চায়ের সবুজ।’ /(ডায়না নদী)। কিংবা শেকড় পুরানো গাছ আমি/নাগরীলিপি ভুলে গেছি কবেই।’

অবশেষে এখান থেকে কবি যেন বুঝতে পারেন একজন দার্শনিকের মতো। এজীবন দু:খময় দু:খের কারন আছে। কর্মের অভিমুখ পাল্টে দু:খের  বিনাশ সম্ভব।আসবে মানবমুক্তি। যেখানে দেশ থাকবে না- থাকবে না, না-রঙের মানুষ।  তাঁর নদী গুলো অবগাহন করতে করতে বুঝেছি এরা গোবিন্দ থেকে আলাদা নয়। এই ছড়া নালা খাল নদী তার অন্তরে নিরন্তর প্রবাহিত।এরা গোবিন্দজীবনের দ্যোতক ও অবিভাজ্য।তাই তিনি বলেন-‘আমার অন্তরে এক নদী সে জুরী/শরীর ও মনে মনু /রাতাছড়া /আনোয়ারা /মনের জলে দীর্ঘ খলবল করে দেও।/আমিই নদীমাতৃক/হৃদয়ের গহীনে বাজে জলোচ্ছ্বাস একতারা।’ (নদীমাতৃক ) কিংবা-‘মনুর সাথে ছোটবেলা/উথালপাতাল সেও।’ (কথাভূমি-মনুসমগ্র) অথবা ‘আমার বিগ্রহে দেওমনু জল কলকল প্রবাহিত। ‘(দেওখণ্ড)

আসলে এরা তাঁর শ্বাস প্রশ্বাস আশ্বাস । এদেরকে আলাদা করলে গোবিন্দকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাকে আমরা মহাপরিনির্বানে পাঠিয়ে দেবো। কবি নিজেও তা চান না। তিনি মানুষের মাঝে মানুষকে নিয়েই বাঁচতে চান।পৃথিবীর সকল নদীধারাকে  এক সূতোয়  বাঁধতে মানুষকে সাথে চান। তাঁর বিশ্বাস মানববন্ধনের মধ্যেই সৃষ্টি হবে সাগর সঙ্গমে সফেন উত্তাল। মন্তনের ফলে উঠে আসবে অমৃত ও গরল। আর গরল পান করে তিনিই হবেন নীলকন্ঠ।তাই তিনি বলতে পারেন-‘জলের তোড়ের কাছে আনন্দ ভাসিয়ে /সকল বিষন্নতার গল্প বলি জলীয় ভাষায়।’ কিংবা – ‘এসো, দেওনদী মুখোমুখি বসি/ জল আয়নায় দেখি সমগ্র দু:খাকাশ।’তাঁর স্বপ্ন ও আরাধনা মানুষের না- দেশ।যেখানে থাকবে – না রঙের মানুষ।কারন তাঁর বিশ্বাস -‘সবপথ নদীতেই এসে মিশে যায়।/নদীই সাক্ষী থাকে প্রকৃত প্রেমের। ‘অথবা ‘সকল নদীই আসলে/জল বিয়োগ করতে করতে /সাগরে মিশে যায়।’ কিংবা-‘জলের চিত্রে তাদের পূর্ণতা /’ (নদী)

ইদানিং তাঁর পরিব্রাজন ক্রমশ বাঁক নিয়ে চলেছে নদী থেকে নদী ধারায়-এক নদী থেকে আরেক নদীতে। ।তাই তাঁর কন্ঠে শোনা যায় -‘ভ্রমর ও ভ্রমর তুমি ধামাইল সুর তুলে বাঁশি বাজাও।’ (দোপাতার জল)

অবশেষে বুঝেছি তিনি নিজেই এক নদী ।এ কোন সাধারণ নদী নয়।এ নদী মানব নদী। এই নদী-গোবিন্দ নদী। এই নদী তাঁর মনোনদী-যেখানে সফেন সামুদ্রিক উচ্ছাস-উথালপাতাল-ঢেউ ভেঙে ঢেউ এক নুতন। শেষ করছি কবিবন্ধু অভীককম্পাসের অনুভবছোঁয়ায়-“সব ছুটন্ত মানুষ শব্দকে খুঁজে পায় না। যে পায় সে মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারে। এমনই একজন মানুষ কবি ও গবেষক গোবিন্দ ধর। তিনি নিজের আত্মক্ষরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন। সেই ক্ষরণ থেকে একটি নদী, গোবিন্দ নদী; নদীটির স্রোত নদীকে বয়ে গেছে অনেক দূর—

একদিন এই নদীকে ছুঁয়ে দেখেছি। নদীর গতি প্রকৃতি বুঝতে চেষ্টা করেছি। ডুব দিয়েছি গভীরে। দেখেছি, গোবিন্দ নদী কোনও সাধারণ নদী নয়। তাঁর অনেক গভীরতা। অফুরন্ত জল। স্বচ্ছ আয়নার মতোই ভেতর দেখা যায়। ভেতরে অক্ষরেরা বসবাস করে। অক্ষরগুলো নেড়েচেড়ে দেখি আর অবাক হতে থাকি। তিনি কেমন? -কোনকিছুই স্থিতিশীল থাকে না, তাই অপেক্ষা করছিলাম এই নদীর পরিশেষ দেখবো বলে। না, যতদূর সাঁতরে গেছি গোবিন্দ নদী, অবাক হয়েছি—। ”
এই নদীতে এবার কবি বন্ধুর মতো আমিও সাঁতার কাটছি এই পারে উঠছি তো এইপাড় ভাঙছে। ওইপাড়ে উঠছি তো ওইপাড়! ভাঙতে ভাঙতে আমিও যেন কুলহারা মাঝির মতো হারিয়ে যাচ্ছি গোবিন্দ নদীর ঘোরলাগা ডহরে।

হারাধন বৈরাগী: কথাসাহিত্যিক, কাঞ্চনপুর, ত্রিপুরা।

*

লিটল ম্যাগাজিনঃ স্রোত এবং গোবিন্দ

পৃথ্বীশ দত্ত

লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস আদপেই লিটল নয় I এমনকি অনেক লিটল ম্যাগাজিন কলেবরেও লিটল নয় l কিংবা রচনার উৎকর্ষতার দিক থেকেও বহু তথাকথিত বড় বা বাণিজ্যিক পত্রিকার চেয়ে কোনও অংশে তার মূল্য কম নয় l তবু ‘লিটল’ শব্দটি তার জীবনের সাথে প্রণয়-স্পন্দন হয়ে লেগেই রইল l লিটল ম্যাগাজিন ধূমকেতুর মত। অন্ধকার সময়ে তীব্র আলো হয়ে সে জ্বলে ওঠে এবং চমকে দিয়ে বিচ্ছুরিত করে লেলিহান আভা l যাপিত জীবনের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং অনালোকিত রহস্যকে নব আলোকে সে উদ্ভাসিত করে l অনুশাসনের বিরুদ্ধে সে চোখ রাঙিয়ে, বুক উচিয়ে দৃপ্ত গতিতে এগিয়ে চলে l যা কখনো কখনো আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়, আমাদের ভাবায়, নতুন আস্বাদ এনে দেয় l লিটলের এমনই মহিমা l তবে ইদানিং কালের অনেক লিটল ম্যাগাজিনই এতটা বেপরোয়া বিদ্রোহী নয় l সে একপ্রকার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না l দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা দিয়ে শুরু করে মূল বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করার চেষ্টা করবো l

#

১৮৪০ (সম্ভবত) খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত রালফ ওয়াল্ডো ও মার্গারেট ফুলার সম্পাদিত ‘দি ডায়াল’ প্রথম লিটল ম্যাগাজিন বলে জানা যায় l ‘Savoy’ (সেভয়) নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় ইংল্যাণ্ড থেকে l যা মূলত ভিক্টোরিয়ান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে উদারপন্থী ও সাম্যবাদী লেখকদের অন্যতম প্ল্যাটফর্ম হিসাবে পরিচিতি লাভ করে l কিন্তু ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে চিকাগো থেকে প্রকাশিত  ‘Poetry : A Magazine of Verse’ (পয়েট্রি: এ ম্যাগাজিন অফ্ ভার্স) এক নতুন অধ্যায় সূচিত করে তার আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে l সম্পাদক ছিলেন হেরিয়েট মনরো এবং এজরা পাউণ্ড l অনতিবিলম্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠে ম্যাগাজিনটি l নতুন লেখকদের জন্য উদার ভাবে ছেড়ে দেওয়া হয় পৃষ্ঠা l বাংলা সাহিত্যঙ্গনে তখনো লিটল ম্যাগাজিনের আবির্ভাব তেমন উল্লেখযোগ্য ভাবে ঘটে নি l যদিও সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’ এর অনেক আগে থেকেই প্রকাশিত হয়ে আসছে l তবে সেটাকে অন্তত লিটল ম্যাগাজিন বলা চলে না l প্রাচ্যের সাহিত্যের প্রতি আমাদের দেশের শিক্ষিত মহল এবং সাহিত্যিকগণ পরিচিত ও আকৃষ্ট হতে থাকেন l পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশেও প্রথা ভেঙে নতুনধারার সৃজন তাড়নায় প্রকাশিত হতে থাকে লিটল ম্যাগাজিন l কিন্তু কী সেই লিটল ম্যাগাজিন ? সেই উত্তর ১৯৫৩ সালে এসে সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু দিয়ে গেলেন এই ভাবে –‘এক রকমের পত্রিকা আছে যা আমরা রেলগাড়িতে সময় কাটাবার জন্য কিনি, আর গন্তব্য স্টেশনে নামার সময় ইচ্ছে করে গাড়িতে ফেলে যাই– যদি না কোনো সতর্ক সহযাত্রী সেটি আবার আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বাধিত এবং বিব্রত করেন। আর এক রকমের পত্রিকা আছে যা স্টেশনে পাওয়া যায় না, ফুটপাতে কিনতে হলেও বিস্তর ঘুরতে হয়, কিন্তু যা একবার হাতে এলে আমরা চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখি না, চেয়ে চেয়ে আস্তে আস্তে পড়ি, আর পড়া হয়ে গেলে গরম কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে ন্যাপথলিন-গন্ধী তোরঙ্গে তুলে রাখি- জল, পোকা, আর অপহারকের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য। যেসব পত্রিকা এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত হতে চায়- কৃতিত্ব যেটুকুই হোক, অন্ততপক্ষে নজরটা যাদের উঁচুর দিকে, তাদের জন্য নতুন একটা নাম বেরিয়েছে মার্কিন দেশে; চলতি কালের ইংরেজি বুলিতে এদের বলা হয়ে থাকে লিটল ম্যাগাজিন l

#

১৯১৪ সালে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত  ‘সবুজ পত্র’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম লিটল ম্যাগাজিন বলে অভিহিত করা হয় l তারপর অবিভক্ত বাংলাদেশে প্রথাবিরোধী, মননশীলতার অনন্য রচনাশৈলীর বাহক হিসাবে প্রকাশিত হতে থাকে একের পর এক লিটল ম্যাগাজিন l উল্লেখযোগ্য হল – কল্লোল, কালি ও কলম, পূর্বাশা, পরিচয়, শনিবারের চিঠি প্রভৃতি লিটল ম্যাগাজিনের ভাবধারা ও চিন্তা চেতনায় মূর্ত হয়ে উঠেছিল I ১৯২৭ সালে বুদ্ধদেব বসু এবং অজিত কুমার দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘প্রগতি’ l ১৮৩১ সাল থেকে ১৯১৩ সালের মধ্যে অনেকগুলো বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয় l যেমন – ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’, অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা, প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদার সম্পাদিত ‘মাসিক’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘ভারতী’, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘সাধনা’, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ এবং জলধর সেন ও অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি পত্রিকা অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখে । এই পত্রিকাগুলো অভিনবত্বে উন্নিত হলেও প্রথাবিরোধী মননশীলতার উষ্ণ অস্বাদ ততটা দিতে পারেনি l তথাকথিত নিয়মতান্ত্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলা সাহিত্যে প্রথম প্রভাব ফেলে ১৯১৪ সালে প্রকাশিত ‘সবুজ পত্র’ নামক লিটল ম্যাগাজিন l পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯৩৫ সালে, রবীন্দ্র প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ সতন্ত্র মননালোকে প্রকাশিত হয় ‘কবিতা’ l সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু l তারুণ্যের উন্মাদনায় কিংবা অস্থির সময়ের অগাদ আমন্ত্রণে এবং সৃজনের বেপরোয়া আহ্বানের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় লিটল ম্যাগাজিন l সে চায় স্বাধীনতা ও সাতন্ত্র l চায় চিন্তা-ভাবনার নতুন এক প্রায়োগিক কৌশলকলা l তাই প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার কোমল বিদ্রোহ ও বিদ্রুপ প্রচ্ছন্ন ভাবে লেগে থাকে l

#

আমাদের ত্রিপুরা রাজ্যে লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস তেমন সুপ্রাচীন না হলেও, স্বাধীনোত্তর ভারতের উত্তরপূর্ব কোণের একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থা এবং জীবনানুসঙ্গিক বিবিধ সমস্যার মধ্যে নিমজ্জিত থেকে, এরাজ্য থেকে ষাটের দশকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস অবশ্যই ঐতিহাসিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ l একদল সৃজনোন্মাদ তরুণ আত্মচেতনায় তরঙ্গায়িত হয়ে প্রকাশ করলেন লিটল ম্যাগাজিন – ‘জোনাকি’ l ‘জোনাকি’ ত্রিপুরার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন I সম্পাদনা করেন কবি পীযূষ রাউত l সাহিত্য আড্ডাকে কেন্দ্র করে যেমন ‘জোনাকি’ প্রকাশ, তেমনি ‘জোনাকি’কে আবর্তিত করে গড়ে ওঠে সাহিত্যের তুমুল আড্ডা l তারপর ‘নান্দিমুখ’ এবং আরও অসখ্য লিটল ম্যাগাজিন ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে l

#

এখানে আমার আলোচনার মূল বিষয় বিংশ শতাব্দির প্রায় প্রান্তলগ্নে ত্রিপুরার  গ্রাম থেকে প্রকাশিত একটি লিটল ম্যাগাজিনের উপর আলোকসম্পাত্ করা l ম্যাগাজিনটির নাম – ‘স্রোতস্বিনী’ l পরবর্তী কালে – ‘স্রোত’ l অবিভক্ত উত্তর ত্রিপুরার কৈলাসহর মহকুমার রাতাছড়া গ্রাম থেকে ১৯৯৫ সালে ‘স্রোতস্বিনী’র প্রথম আত্মপ্রকাশ l শত সহস্র সমস্যা, নানা সমালোচনা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, এরকম পরিস্থিতির মধ্যে শুধুমাত্র সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় প্রেম এবং প্রতিকূলতার অর্গল ভেঙে গ্রামের সোদা গন্ধে প্রবাহিত হয় ‘স্রোতস্বিনী’র ধারা l সাহিত্যের প্রতি গোবিন্দ ধরের   অপ্রতিরোদ্ধ মমত্ত্ব এবং তারুণ্যে প্রবল প্রতাপ থেকেই ‘স্রোতস্বিনী’র জন্ম l লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম হৃদয়ের সৃষ্টি সুখের অসুখ থেকেই হয় l এই অসুখ না থাকলে আমরা ‘স্রোতস্বিনী’ পেতাম না, পেতাম না ‘স্রোত’ও l রাতাছড়া গ্রামের একটি ঐতিহাসিক পরিচয় থাকলেও, তা যথেষ্ট নয় l তাই সেই বিষয়ে সাধারনেরা তেমন জ্ঞাতও নন্ l কিন্তু সেই গ্রাম থেকে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে..’ এই অভয় মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে এগিয়ে গেছেন গোবিন্দ ধর l লেখা সংগ্রহ করা, লেখকদের সাথে যোগাযোগ করা এবং সর্বোপরী ম্যাগাজিন ছাপিয়ে বইয়ের আকার দেওয়া, সবই এক দূরহ ব্যাপার ছিল l অন্তত তৎকালীন রাতাছড়া গ্রাম থেকে যথার্থ ভাবে এই সব কাজ সম্পাদন করা মোটেও সহজ ছিল না l একটু ভালো মুদ্রণের জন্য প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে জেলা সদর কৈলাসহরে যেতে হত l সেই সময় তিনি লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করেন l যার নাম ‘উদ্দীপ্ত সংগ্রহশালা’ I ২০০৩ সালে এসে ‘স্রোতস্বিনী’ নামটি পরিবর্তন করে ‘স্রোত’ নামাকরণ করেন l আমি ব্যক্তিগত ভাবে ‘স্রোতস্বিনী’ শেষ পর্বে এবং ‘স্রোত’-এর জন্মলগ্ন থেকে বেশ কিছু বছর প্রত্যক্ষ ভাবে সেই কর্ম যজ্ঞের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম l তখন দেখেছি তার নেশাতুর হৃদয়ের একাগ্রতা l আমাকেও জড়িয়ে ফেলেছিল ‘স্রোতস্বিনী’ ও ‘স্রোত’ l নব্বইয়ের দশকে এরাজ্যের জনপ্রিয় বা প্রতিষ্ঠিত প্রায় সকল লেখকদের লেখা প্রকাশিত হয়েছে l পাশাপাশি সেই সময়ের নবীন লেখকরাও কলম ধরেছেন ‘স্রোতের’ পৃষ্ঠায় l ‘স্রোত’ ছিল সাহিত্যের নানান ধারার ও বিভিন্ন শাখার বিচিত্র রচনার এক নান্দনিক ক্যানভাস l স্রোত ম্যাগাজিনটিকে রূপে ও রসে সাজিয়ে তোলার নেশা ছিল প্রবল l একটি বনেদি গ্রামের গণ্ডী ছাড়িয়ে, জেলা অতিক্রম করে বেগবান ‘স্রোত’ ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের সর্বত্র এবং দেশের নানা প্রান্তে, এমন কি দেশ ছাড়িয়েও l নতুনের অনুসন্ধান করে তাকে আলোয় নিয়ে আসাও ম্যাগাজিনের একটি অনন্য কাজ l সেই দিক থেকে ‘স্রোত’ ভালো নম্বর অবশ্যই আশা করতে পারে l পরবর্তী সময়ে ‘স্রোত’ প্রকাশনী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সেই বিভাগেও উজ্জ্বল সাক্ষ্য রেখে চলেছে l একজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের এও এক উল্লেখযোগ্য সাফল্য l

#

স্রোত ও গোবিন্দ ধর অভিন্ন l কারণ ‘স্রোত’ তার আত্মার সম্পদ l ‘স্রোত’ এখন একটি প্রকাশনাও l ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে ‘স্রোত’ যেমন একটি উল্লেখযোগ্য নাম, তেমন ‘স্রোত’ প্রকাশনাও গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে আলোকিত ও আলোচিত একটি নাম I শুধু ‘স্রোত’ নয়, গোবিন্দ ধর সম্পাদনা করেছেন বা করে চলেছেন – কুসুম, কবিতাঘর, স্রোত.com, উৎসব সমাচার
প্রভৃতি l তারই সহযোগিতায়, পৃষ্ঠপোষকতায় ও পরামর্শে প্রকাশিত হচ্ছে – দোলনা, মনুতট, সৃষ্টিলোক, অন্যভূমি, সমতট, স্পোর্টিং দীপ প্রভৃতি সাময়িকীগুলো l

#

নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে লিটল ম্যাগাজিনকে চলতে হয় l চলতে চলতে তার তারুণ্যের জ্যোতির্ময় দীপ্তি ছড়িয়ে তার প্রয়াণ ঘটে l সল্পায়ুর মধ্যেও সে সমাজ ও সংস্কৃতির গায় অক্ষয় চিহ্ন রেখে যায় l সেই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু যথার্থ বলেছেন – “মনে হতে পারে আর্থিক কারণেই এসব পত্রিকা দীর্ঘজীবী হতে পারে না, কিন্তু সেটা শুধু আংশিক সত্য। স্বল্পায়ু হওয়াই এদের ধর্ম। বিশেষ কোনো সময়ে, বিশেষ কোনো ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর উদ্যমে, বিশেষ কোনো একটি কাজ নিয়ে এরা আসে, সেটুকু সম্পন্ন করে বিদায় নেয়। সেটাই শোভন, সেটাই যথোচিত।” কিন্তু যেসব লিটল ম্যাগাজিন থামতে জানে না, তিরতিরে প্রাণভ্রমরাকে বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে, তারাই ক্রমশ জৌলুস হারায়, তারুণ্য হারায় এবং হারিয়ে যায় উদ্যম ও উল্লাস l লিটল ম্যাগাজিন প্রবল জোয়ারের মত আচড়ে পড়ে এলোমেলো করে দেয় ভাবনাকে l আবার নতুন করে ভাবতে শেখায় l লিটল ম্যাগাজিন আদপেই লিটল নয় l তাই লিটল ছাড়া জয় বৃথা।

পৃথ্বীশ দত্ত: গল্পকার ও সম্পাদক, ত্রিপুরা।

গোবিন্দ ধরের কবিতা

মৌলভীবাজার 

বাবার বাবা তাঁর বাবার হাত ধরে শ্রীমঙ্গল রোড়ে  হাঁটতে হাঁটতে সারা শহর দেখতেন বৃটিশ পিরিউড।

তখনও নেতাজী রেঙ্গুন যাননি।

গান্ধীজীর টুপিও তখন জনপ্রিয় নয়।

বঙ্গবন্ধুর জয় বাংলা তেমন টেউ হয়ে আসেনি মনুর মুখ অব্দি।

তখনও শ্রীলেট সিলেট হয়নি কিংবা নাগরীলিপিও ধ্বংস হয়নি।

সুতরাং বাবাও জানতেন না ধীরেন দত্ত সংসদে দাঁড়িয়ে বাংলাভাষার জন্য আইন পাশ করাতে হবে।

 

চা গাছের দুপাতায় লেগে থাকা সোনার বাংলা

ধানের সবুজ পাতায় সোনার বাংলা

জলের স্রোতে মাছের সাঁতার সোনার বাংলা।

 

এমন কী ঘটলো

আমার বাবা তাঁর বাবার হাত ধরে সোনার বাংলা ফেলে

চাতলাপুর বর্ডার ক্রস করে হাঁটতে হাঁটতে

ছিঁড়া মানচিত্র বুকে জড়িয়ে চলে গেলেন রাতাছড়ায়?

 

পায়ের ছাপ আর ধুলো ঘাম বিন্দু বিন্দু গায়ে শুকালে

সারাদিন আনন্দাশ্রু টুপটাপ পড়বেই তো

প্রিয়ভূমি শ্রীভূমি সিলেটও দুজেলায় ভাগ হয়ে

মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গল।পুরো শহর শ্রীমঙ্গল মনে হলেও

বাবার ঘাম

তাঁর বাবার ঘাম

তাঁর বাবার বাবার ঘাম

আমার ঘাম হয়ে ঝরলো এই একই পথের ধুলোয়।

 

ঘাম আর ধুলো মেখে শীতলপাটির মতো শুয়ে থাকবো

সদর হাসপাতালের পেছনের দুতলায় একরাত।

*

বিদ্যালয়

বিদ্যালয় আমাদের মেধা বিকাশের হাসপাতাল।

আমার বাবা মা অথবা ইতিহাস সচেতন ঠাকুরদা দেবেন্দ্রনাথ 

বড় রায়টের সময় দেশ ছেড়ে ছেঁড়া মানচিত্র 

বগলে করে চাতলার বর্ডার ক্রস করে 

দুচোখ বরাবর হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন ইন্ডিয়ায়।

ঠাকুরদার স্বপ্নে গড়া বিদ্যালয় মিঁয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে 

দীর্ঘ তিরিশ বছর শিক্ষকতা করে 

দেশভাগ আটকাতে পারেননি। 

ঠাকুমার মুক্তিযুদ্ধের স্পিহা তাও 

ফেলে দিয়ে এলেন ভারতে।

লিগেসিডাটা নেই বলে আমি তাদের তৃতীয় পান্ডব মহাভারত থেকে ছিঁটকে পড়া স্কুল ছুট বালকের মতো বর্ণমালা জানি না।

বিদ্যালয় আমায় অক্ষর কেড়ে নিতে চায়। 

আমি  বাহান্ন হই।

একষট্টি হই।

একাত্তর হই।

সাতচল্লিশ হই।

আমি সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে নিহত স্পাইনবৃক্ষ।

দেশ পাহারাদার সৈনিক।

আমার শরীর শুধু বুলেট খেয়ে শহীদ হতেই জন্ম।বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নিলাম দেশসেবার।

দেশ কোথায় শুধুই নষ্ট ভূগোলের সীমানায় রক্ত ছাড়া?

বংশবৃক্ষের শাখাপ্রশাখা জুড়ে আমিও নদীর দিকে দূরন্ত গতিতে ছুটছি।

*

অক্ষরলিপি

বেঁচে থাকা দরকার 

কিরকম বাঁচি কিরকম বাঁচাই জীবন

কিরকম বাঁচবো বলুন?

 

অণুবীক্ষণ করোনার নিকট পরাজিত মানুষ! 

মানুষের নিকট পরাজিত মানুষ। 

খরা বন্যা পশু প্রকৃতির নিকট পরাজিত

এত এত পরাজয়ের পরেও বাঁচিবার মদে হাবুডুবু 

এই ভালোবাসাবাসীর দেশ হঠাৎ 

খুব গুটিয়ে গেলো।

 

নিজের লালা কফ থুথু শ্বাস সব সতর্কে রেখে

কিরকম প্রিয় মানুষের নিকট

এই মুখ ঘনিষ্ঠ চুম্বন আঁকে?

 

এই মৃত্যুবিশ্ব মানুষের নয় মানুষের নয়।

 

একটি সুন্দর আরো সুন্দর পৃথিবীর নিকট

সকল শিশুরা নিশ্চিত থাকুক

কখনো কি হবে না আর?

 

আমরা তো মানুষ মানুষের নিশ্চয়তা চাই

মানুষের রমণ মিথুন চুম্বন খাদ্য বাস বস্ত্র চাই।

 

সুন্দর পৃথিবীর নিকট রেখে যেতে চাই আগামী বীজপত্রটি।

*

জ্বর

লাফিয়ে বাড়ে জ্বর।জ্বরের ঘোর লাগা 

মাঝ রাতে কড়া নেড়ে কেউ ডেকে চলে

ক্রমাগত গোবিন্দ গোবিন্দ। 

 

সেই ডাকে সাড়া দিয়ে পা চালাই।পা উঠছে

পা নামছে।সে দৌড়ছে।গোবিন্দ দৌড়ছে।

 

এই দৌড় সীমিত। জানি সীমিত। সীমানা ঝুলে আছে। সামনে কাঁটাতার।

সারা পৃথিবী এত শত শত সীমানায় আলাদা।

 

আকাশ টুকরো টুকরো রুটি লাগে। 

জল ভাগ হয়ে বিভাজিত অক্সিজেন। 

 

আমাদের ভূগোল এত রক্তাক্ত আমি

চিৎকার করে উঠি।আমার ঘোর কেটে যায়।

 

জ্বর নামে না।মাঝরাতে এক অলৌকিক আলো

ঝিলিক দিয়ে যায় গুরু মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে।

 

জ্বরের ঘোর থেকে লিখি সরল নিয়মে

একটি সবুজ পৃথিবী। 

*

আর্থাইটিস

শরীরে বিষব্যথা বিষপাখির মতো ঠুকরোয়।

জেতাগাছে কোঠরি গড়ে এরকমই কাঠঠোকরা পাখি।

ঠোঁটের ধারালো কিরিচ চাপাতির মতো গাছটির শরীর

টুকরো টুকরো করে নিজেরই বাসাঘর বানায়।

 

পাখিটি জানে না গাছটির সরল যাপন আকাশ ছোঁয়ার গল্প।

শরীরের বিষব্যথা হজম করেও করেছে সমর্পন বটবৃক্ষ। 

 

সময় সময়ের নিকট কেমন জবুথবু আর্থাইটিস জরাগ্রস্ত।