মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

ট্র্যাগাস

তাজনিন মেরিন লোপা

৩০ নভেম্বর, ২০২০ , ৭:৪৯ অপরাহ্ণ

তাজনিন মেরিন লোপার গল্প - ট্র্যাগাস(বাস)

পর্ব-১

বাস থেকে নেমে খেয়াল করলাম, সন্ধ্যাটা আরও অন্ধকার হয়ে উঠেছে । বাস স্টপে দাঁড়িয়ে ভাবছি, বাসা কোনদিকটায়। নতুন বাসায় উঠার পর হারিয়ে যাওয়া বাসা খুঁজে না পাওয়া এমন নতুন কিছু না । সানাউল, আমার স্বামী, মজা করে বলে আমি জিওগ্রাফিতে নাকি দুই বছর থেকে এসছি । অবশ্য ওখানেও হারিয়ে যেতাম মনে হয়। একা একা হারালেও কথা ছিল, আজকে আমার তিন বছরের ছেলে প্রাইমে বসে আছে । বেচারা কোন কথা বলছে না। আমি বাস স্টপে নেমে রাস্তা পার হয়ে এই পাড়ে অনেকটা চলে এসেছে। এখন মনে হচ্ছে বাসাটা এদিকে না, বাস স্টপের পাশেই । মোবাইলেও চার্জ নেই । কী যে মুসকিলে পরলাম, সানাউলকেও কল দেয়ার কোন উপায় নেই । দুএকটা বাসার সামনে দাঁড়ালাম, নক করে লোকেশনের জন্য সাহায্য চাওয়া যায় কিনা। নাহ, অস্ট্রেলিয়ার এই ক্যানবেরা শহরে ছয়টার পর চাঁদও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আলো দেয় ।

আধো আলো আধো আঁধারে গুটি গুটি এইদিক সেইদিক হাঁটছি। ঠাণ্ডা বেড়েছে, ছেলেটাকে আমর শালটা দিয়ে জড়িয়ে দিয়েছি । নিজের বোকামির জন্য খুব রাগ হচ্ছে। বাস আসতে দেরি করলো, কিন্তু এর আগের বাসটা ধরতে পারলেই এমন হতো না। কেন ভুলে যাই, আমি তো ‘রাতকানা’! অবশ্য ডাক্তারের ডায়গোনোসিসে না, এটাও সানাউলের বক্তব্য। রেগে যাই, আসলে তো ঘটনা সত্যি। অন্ধকারে না হাঁটতে পারি না সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারি!

হঠাৎ পেছন দিকে মনে হলো একটা ভারী ছায়া। খুব ভয় পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। আমার চেয়ে দুইগুণ লম্বা একজন। এতো কম আলোয় মুখটা ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। তবে জামার রং মনে হচ্ছে সবুজ। গলায় সুন্দর পেনডেন্ট ঝুলছে। চুল বেশ লম্বা । তবুও বুঝতে পারছি না, মানুষ নাকি অন্য কিছু, একজন ভদ্রমহিলা, নাকি ভদ্র পুরুষ। নাকি অভদ্র কেউ! সাথে একটা কুকুর, অদ্ভুত কুকুরটা চুপ করে আছে। মাথা কেমন হাওয়ায় ভাসছে। শরীরটাও ভারশূন্য লাগছে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে সজারুর কাঁটার মতো কাঁটা দিচ্ছে। যাকে বলে ‘গুজ বামস’। এই কথা মনে হতেই. তো ভুত, অস্ট্রেলিয়ার হন্টেড হাউজের কথা মনে হলো। আমি ছেলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। যাতে করে প্রাইমের বেল্ট খুলে ছেলেকে কোলে নিয়ে দৌড় দিতে পারি যেকোন কিছু ঘটার আগে। নিজেকে বলতে থাকলাম, ভুত বলতে কিছু নাই, ভুত বলতে কিছু নাই। এরকম কিছু ঘটার আগেই সে কথা বললো।

-হ্যালো

আমিও হ্যালোই বললাম, কিন্তু নিজের কানে বাজলো ‘গেলো’। কানটাও কি নষ্ট হয়ে গেল?

-আর ইউ ওকে।

-ইয়েস, ইয়েস….এ্যাকচুয়ালি নো..

-ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি, আই লিভ হিয়ার। আই এম জেলেন। দিস ইজ ট্র্যাগাস (পোষা কুকুরকে দেখিয়ে বললো)

আমার ছেলে ট্র্যাগাসকে ‘হ্যালো’ বলতেই সে কুঁই কুঁই করে কাছে গেল। তার পশুপ্রাণি খুব পছন্দ।

উচ্চারণ অস্ট্রেলিয়ার লোকাল না, কিন্তু ভদ্রমহিলা সাদা চামড়ার। চেহারা একটু লম্বাটে কিন্তু রেসলার টাইপের। কোন দেশের হতে পারে ঠিক ধরতে পারছি না। আমি এখনও এথনিসিটি খুব একটা ধরতে পারি না, অনেক টাইপ অংক করতে হয়। অংক কখনও মেলে, কখনও আরও জটিল হয়ে যায়। সে যাক, এইসব চিন্তা মাথায় আসছে, মানে মাথাটা একটু ঠাঁই পাচ্ছে। রাত  বাড়ছে, হারিয়ে যাওয়া বিলম্ব করা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। আল্লাহ ভরসা, ভাবলাম আপাকে বলি আসলে আমি এদিক ওদিক কেন ঘুরছি। বললাম। সে হাসলো। ভাগ্যিস বাসার ঠিকানা মনে ছিল আমার। ৪০, ব্যানেন লেন। সে নাকি খুব কাছেই থাকে। তার উপর ভরসা করে সাথে আসতে বললো। এরমধ্যে আমার ছেলের সাথে তার বেশ ভাব হলো। দুজনের ভাষা আলাদা, কিন্তু উইগেল টাইপ শব্দে দুজনে কথা বলে যাচ্ছে। সে কুইকুককিককল। ছেলে বলে, গিকককররমিউকল। সাথে ট্র্যাগাসও বলে উলফউলফবুভবুভ; কিন্তু খুব নিচু সে আওয়াজ।

খুব সামান্য হেঁটেই বাসার সামনে চলে এলাম। রাস্তাটা পার না হলেই হতো । ধন্যবাদ দিতে দিতে নিজেরই কান ভন ভন করতে লাগলো। জেলেনের বাসা ১০ ব্যানেন লেন বললো। বললো সে খুব গ্ল্যাড ফিল করছে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে পেরে। তাকে আর ট্র্যাগাসকে বাই, গুড নাইট বলতেই সানাউল বারান্দায় এসে লাইট জ্বালিয়েছে। ভাবলাম, আরেকবার বাই, ধন্যবাদ বলি। কিন্তু কই জেলেন আর ট্র্যাগাস হাওয়া! একটা মানুষ এতো তাড়াতাড়ি হাঁটে কী করে, কুকুরটাই বা কই গেল? আমার মাথাটা আবার শূন্য হয়ে গেল। সানাউল আমাদের দেখে নিচে এসেছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে ভিতরে ঢোকার সময় দেখি জেলেন এর ক্যাপটা প্রাইমে রয়ে গেছে। লাল ক্যাপ, মাঝে কালো একটা প্যানথার, প্যানথারের চোখ লাল, কিন্তু মোটেও তা ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে না। ফেরত দিতে ওর বাসায় যেতে হবে একদিন।

কী কী ঘটেছে সব বললাম সানাউলকে। আমার বোকামি নিয়ে কিছু বলালো না। কিন্তু তার দুশ্চিন্তার ছাপ চোখ-মুখ থেকে যেন সরছিল না। আর জেলেনের প্রতি কৃতজ্ঞতায়, লাইট জ্বালানোর পর তার হাওয়া হয়ে যাওয়াটা খুব একটা গুরুত্ব পেল না।

আমার ঘুমাতে যেতে একটু দেরি হলো। ছেলেটা ঘুমিয়ে গেছে আগেই। সানাউল দেখি ঘুমিয়ে গেল আজ। বেশি দিুশ্চিন্তায় সে জেগে থাকতে পারে না। আর আমি উল্টো আমি চোখের পাতা বন্ধ করতে পারি না। আজ যে ভয় পেয়েছি, তাতে মনে হচ্ছে, জিওগ্রাফি দিয়ে চা বানিয়ে খাই প্রতিদিন দুইবেলা। তাতে যদি রাস্তা ভুল হওয়া কমে। আজ জেলেন আমাদের পাশে না দাঁড়ালে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কী করতাম কে জানে। কোন পুলিশের গাড়িও ওই রাস্তায় চোখে পড়ছিল না।

চোখটা একটু বন্ধ হতেই কি একটা আলো যেন লাগলো। চোখ মেলে দেখি ঘরের মধ্যে কি একটা সাদা বেগুনি ফুল ফুটেছে । গাছ এলো কোথা থেকে? কী যে জোছনা সুন্দর আলো, না নীল, না সাদা, এতো অদ্ভুত মায়াময় আলো আমি আগে কখনও দেখিনি। কিন্তু ফুলের উপরে ওইটা কী, জেলেনের ক্যাপ!?

১৭ নভেম্বর ২০২০, শুক্রবার

**চলবে**

 

তাজনিন মেরিন লোপা
Latest posts by তাজনিন মেরিন লোপা (see all)