দেবব্রত সিংহর ৩ টি কবিতা
তাহাদের চৈত্র কথা
সে ছিল এক দিনফুরনো চৈত্র বেলা
সে ছিল এক চৈত্র শেষের মেলাতলা
তখনো জ্বলেনি হ্যাজাক
তখনো জ্বলেনি বাতি
গ্রামের শেষে মাঠের মাঝে
মুঠো মুঠো আবিরগোলা
সূযিডোবা আলোয়
সে এক মেলা আমোদী মানুষের মেলাতলা
সে এক উপচে পড়া ভিড়জমানো মেলাতলা
সেই ভিড়ের মাঝে বাঁশিওয়ালার কাছে
সে কিনছিল বাঁশি
বাঁশের তৈরি আড়বাঁশি
সে তেমন কোন বাঁশি বাজিয়ে না
উঠতি বয়সের হুজুগে পড়ে
আউলি বাউলি হাওয়ার দিনে
সন্ধ্যা রাতের উঠানে
তালাই পেতে ফু দেয় বাঁশিতে
দেখতে সে নেহাত মন্দ না
শ্যামলাবরণ
লম্বাগড়ন
টিকালো নাকে কোকড়ানো চুলে
তাকে ভালোই লাগে দেখতে
শুধু দোষের মধ্যে দোষ
সে বড় জেদি ছেলে
নাছোড় জেদে যখন যেটা মনে করে
সেটাই করে ছাড়ে ।
তা সে যাই হোক
বাঁশি কেনার পরে সে গেল চড়কথানে
হাতে ঘোরানো সারি সারি
নাগরদোলার ওখানে
সেখানে তখন সঙ্গিনী দুই মেয়েকে নিয়ে
দাঁড়িয়েছিল একজনা
চৈত্র দিনের দিন ফুরনো আঁধারে
আলতারাঙা শাড়ি পরে
মেলাতলাটা আলো করে দাঁড়িয়েছিল।
চড়কথানের নাগর দোলায় এক খাটিয়ায়
বসার কথা চারজনের
তাই দেখে সে এগিয়ে গেলে যখন
তখন আলতারাঙার সঙ্গিনী দুই মেয়ে
মুখিয়ে উঠলে রে রে করে
তবু নাগরদোলার লোকেরা
তাকে জোর করে দিলে বসিয়ে
তার সমুখে আলতারাঙা
তার চোখে চোখ পড়তেই
সে নামিয়ে নিলে চোখ
তখন বুকের ভিতর রেলগাড়ি
কু ঝিকঝিক রেলগাড়ি
ঠিক তখনই চড়কথানের লোকেরা
চালিয়ে দিলে নাগরদোলা
তখন মাঠের ওদিকে নদীর ধারে
চৈত্র শেষের হাওয়ারা কোথায় ছিল কে জানে
তারা ছুটে এসে উড়িয়ে দিলে
আলতা রাঙার শাড়ির আঁচল
উড়িয়ে দিলে খোঁপায় বাঁধা ঢেউ খেলানো
কালো এলো চুল
এলোমেলো সেই হাওয়ার তোড়ে
শাড়ির আঁচল সামলে নিয়ে
খানিক পরে তারা তিনজনে মেতে উঠলে খেলায়
রুমাল ফেলার খেলায়
খেলার শেষে যখন থামলো নাগরদোলা
তখন তার কি জেদ চাপলো কে জানে
সে আলতারাঙার রুমাল খানা
পকেটে নিলে পুরে।
তারপর তাই নিয়ে সে ঝগড়াঝাটি বিশাল
সেই সঙ্গে হই হট্টগোল চেঁচামেচি
তার হেলদোল নেই কোনো
সে আলতারাঙা কে বললে হেসে,
“এই শুন তুমার নীল রুমাল খানা
আখন থাকে থাকবেক আমার কাছে
আমার কাছেই থাকবেক।”
তাই শুনে ধো ধো করা পলাশের আগুন
এক পলকে ছড়িয়ে গেল আলতারাঙার মুখে
আর সঙ্গিনী সেই দুজন মেয়ে
তারা তখনই জ্বলে উঠলে
জ্বলে উঠলে জ্বলন্ত ক্রোধে
তখন মেলা বেড়ানো একদল মারকুটুনে ছেলে
জামার হাতা গুটিয়ে এলো ছুটে
তাই দেখে নাগরদোলার লোকেরা তাদের সামলে দিলে
বললে, “তুমরা যাও যাও
ইখানে কিছু হয় নাই যাও
ইয়ারা সব আমাদে ঘরের ছেলামেইয়া
তুমরা ভিড় কর না যাও।”
তারপর আর কি
তারপর মেলা ফিরতি লোকের সঙ্গে
রাঙাধুলার পথে
বাঁশির সুরে গান ধরলে সে,
‘ তোকে মনে লাগেছে করব বিহা
দাড়ি কাটে লি মাইরি করব বিহা।’
ওদিকে তখন আলতারাঙার সঙ্গিনী দুই মেয়ে
বাড়ি ফিরে সুঁচকে ফাল করে
পাড়া শুদ্ধো যত লোক সবাইকে দিলে তাতিয়ে
বাদ গেল না চৌকিদার বাপও
সে সব বৃত্তান্ত শুনে লাঠি উঁচিয়ে
গর্জে উঠলে রাগে
পাগড়ি বেঁধে খাকি পোশাক পরে
থানায় যাওয়ার তোড়জোড় করলে
ওই ছেলেকে বেঁধে আনার তোড়জোড় করলে।
যার জন্যে এত তোড়জোড়
এত আয়োজন
এত তর্জন
এত গর্জন
সে তখন মাটির কোঠাঘরে দোর দিয়ে
একা একা অন্ধকারে উপুড় হয়ে শুয়ে
তার রাত পাহারা দেওয়া চৌকিদার বাপ
আর সঙ্গে যত পাড়ার লোকজন
আর সঙ্গিনী সেই মুখরা দুই মেয়ে
তারা জানতেই পারলে না কেউ
কেউ পারলে না জানতে
ওই নীল রুমালের সঙ্গে কখন যে
হা ঘরে সেই বাউন্ডুলে ছেলের কাছে
তাদের ফুলপরী মেয়ের
ফুলের মতন মনটাও গেছে খোয়া
সে তারা জানতে পারলে না একজনও।
জানতে পারেনি সে নিজেও
মেলাতে ওই রুমাল নিয়ে কত ঝগড়াঝাটি
কত কথা কাটাকাটি
বাড়ি ফিরে আবার সেই তাকেই
একটিবার
শুধু একটিবার দেখতে চেয়ে
বুকের ভিতরে এত উচাটন
এত হুটোপাটি
কেন হয় এসব
কিসের জন্য হয়
তা কিছুতেই ভেবে পেলেনা সে
অন্ধকারে কোঠাঘরে
এসব কথা ভাবতে ভাবতে
কখন যে বাদল নেমেছে দুচোখে
তাও সে টের পেলে না কিছুই
এক সময় আকাশ-পাতাল ভেবে টেবে
আচমকা তার মনে হল
একেই বোধহয় ভালোবাসা বলে
বোধহয় একেই বলে ভালোবাসা ।
_______________________________
পিতৃতর্পণ
তখন মহানগরীর অতিব্যস্ত ফুটপাতে
খিদে পেটে হাঁটতে হাঁটতে মনে হত
বড় বিনির্বৃত্ত এই সংঘর্ষ
আবার মহানগরী থেকে দূরে বহু দূরে
রাঙ্গামাটির গ্রামে ভাঙ্গা ঘরের উঠানে
দাঁড়ালে মনে হত
বড় দুর্বহ এই দারিদ্র
তার মাঝে তিনি যখন শুধোতেন,
‘ কি রে কোথাও কিছু পেলি?’
তখন তার অসুখিত মুখের দিকে তাকিয়ে
আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে উঠে আসত হাহাকার
বিষয়ভাগ্যে প্রতারিত শীর্ণকায় আত্মভোলা মানুষ
তার দিকে এক পলক তাকালেই মনে হত
নিষ্ঠুর সময় কি নির্মমভাবে তাঁর মুখাবয়বে
বাড়িয়ে চলেছে রেখাচিত্রের নকশা
অকালে অবহেলায় অবজ্ঞায়
নির্দয় দারিদ্র্যের প্রখর উত্তাপে
ঝলসে গেছে তাঁর শিল্পী সত্তার সবটুকু নির্যাস
এসব দেখতে হত
নীরব দর্শকের ভূমিকায়
উচ্চশিক্ষার অক্ষম বেকারত্বকে সঙ্গে নিয়ে
দেখে যেতে হত দিনের পর দিন
অথচ এরকম কথা ছিল না
কত কিছুই তো করার ছিল
এসব ভাবতে ভাবতে লিখেছিলাম লেখাটা
তাঁকে নিয়ে আমার প্রথম লেখা
তাঁকে নিয়ে আমার প্রথম গল্প
একদিন এক বিকেলে আকাশবাণীর
গল্প পাঠের আসরে
আমি পড়েছিলাম সেই গল্প
গ্রামের বাড়িতে মাটির উঠানে রেডিওতে সে গল্প শুনে
চোখের জলে ভেসে গেছিলেন মা
অন্য কিছু না
বাবাকে নিয়ে দুঃখেরা সব কেমন করে
অভিতাপের দহনে দগ্ধ করেছিল ছেলেকে
তা নিয়েই লেখা হয়েছিল সেই দুঃখকথা
তিনি শুনেছিলেন
একাগ্রচিত্তে নিবিষ্টমনে শুনেছিলেন
তারপর আনন্দে উদ্বেল হয়ে বলেছিলেন মাকে
‘আমার কাছে তো কোন টাকা নেই
যদি থাকত টাকা
তাহলে ওকে আমি পুরস্কার দিতাম
একশ টাকার পুরস্কার
আর একটা কথা তোমায় বলে রাখি
কথাটা তুমি শুনে রাখো
আমিও তো লিখতাম একসময়
তবে এমন লেখা লিখতে পারিনি কখনো
তাই কি ঠিক করেছি জানো
ওকে আমার কলমটা দেবো তুলে
ও সেই কলম দিয়ে মানুষের কথা লিখবে
যাদের কথা কেউ কখনো লেখে না
তাদের কথা লিখবে l
____________________________
রামকিঙ্কর
.. .আমি রামকিঙ্কর
আমার বাপের নাম চন্ডীচরণ বেজ
মায়ের নাম সম্পূর্ণা
একবার সুরেন কে লিয়ে কইলকাতায়
এক এগজিবিশনে দেখি আমাকে লিয়ে লেখা হইছে
আমি সাঁওতাল
অনেকেরই এমনি ধারণা
সাঁওতালদের মূর্তি টুর্তি বেশি গড়েছি বলে
বাবুরা বোধহয় ভাবে ইরকম
কইলকাতায় আমার গড়া কোনো মূর্তি নাই
কোনদিন কেউ বলেও নাই কিছু করতে
উখানে যারা আছে বসে
তারা নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত
কাউকে কিছু বলার মতন তাদের ফুরসত কোথায়।
দেখো নাম যশ খ্যাতি অর্থ
কোনোটা নিয়ে কোনোদিন কিছু ভাবি নাই আমি
শান্তিনিকেতনের আগানে বাগানে যেসব মূর্তি গড়েছি
পয়সা নিইনি
পয়সার জন্যে বেচে দিইনি
আমার শিল্প আমার সাধনা
চাহিদা আর যোগানের বাজারি তত্ত্বে
বিশ্বাস করি না আমি
শিল্প
আমার কাছে শিল্পের কোন হেতু নাই
শিল্প একটা খেলা
এই খেলাতে হারজিতটা বড় কথা নয়
খেলাটাই আসল
আজকে যেটা হার কালকে সেটা জিত।
আমি রামকিঙ্কর
গুরুদেবের রাঙামাটির ধুলা ছাড়ে
কোথাও যাই নাই আমি
বিদেশ যাওয়ার ডাক আসেছে বহুতবার
যাই নাই
শান্তিনিকেতনের মাটি ছাড়ে কোথাও যাই নাই
কি হবেক যাইয়ে
ছবি আঁকা
মূর্তি গড়া
সে তো এলেমের কথা হে
তার জন্যে অত দরজায় দরজায়
ভিখ মাগতে হবেক কিসের লাগে
অত দরজায় দরজায়
ভিখ মাগতে হবেক কিসের লাগে।
_________________________________
দেবব্রত সিংহ: পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান কবি। বাঁকুরার আঞ্চলিক ভাষায় ‘তেজ’ কবিতাটি লিখে তিনি বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।