প্রবন্ধ Archives - মুগ্ধতা.কম

মুগ্ধতা.কম

২৫ জুন, ২০২৩ , ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ইংরেজি কবিতা

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তা আমরা সকলে জানি। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে সংযোজন হয়েছে সনেট ও মহাকাব্যের মতো দুটি সাহিত্য ধারা। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যে তিনি কতটা ব্যর্থ তা আমরা তাঁর বঙ্গভাষা কবিতাটি পড়লেই জানতে পারি। কিন্তু তাঁর ইংরেজি কবিতাগুলি কি আদৌ ইংরেজি কবিতা হয়নি নাকি মধুসূদন native নয় বলে তাঁদের প্রশংসা কুড়োতে ব্যর্থ হয়েছেন। মধুসূদনের আগে ভিন্নভাষার কেউ ইংরেজি ভাষায় কাব্যচর্চা করেছেন, এরকম প্রমাণ মেলে না। মধুসূদনের ইংরেজি ভাষায় বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলো হলো King Porus (১৮৪৩), Captive Ladie (১৮৪৮) এবং কিছু সনেট।

মধুসূদন জমিদারপুত্র হওয়ায় বাল্যকালে বাড়িতেই বিভিন্ন পন্ডিত ব্যক্তির মাধ্যমে তাঁর ইংরেজি সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটে। ধীরে ধীরে এ সাহিত্যের প্রতি অনুরাগের সৃষ্টি হয়। এ অনুরাগ তীব্র আকার ধারণ করে যখন তিনি হিন্দু কলেজে পড়তেন। হিন্দু কলেজে পড়ার সময় তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন কবি রিচার্ডসনকে। রিচার্ডসন চমৎকার ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন। রিচার্ডসন মধুসূদনের ইংরেজি সাহিত্যের অনুরাগকে অন্তরের গহব্বরে গেঁথে দেন। তিনি মেধা মননে, পোশাক পরিচ্ছদে ইংরেজ হওয়ার চেষ্টা করেন। এমনকি বিয়ে করারও স্বপ্ন দেখেন কোনো ইংরেজ কন্যাকে।

১৮৪১ সালে মধুসূদন একটি হাতে লেখা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। যদিও পত্রিকাটি তিন চার মাস চলে, তবে পত্রিকাটি তাঁর শিক্ষক রিচার্ডসনের প্রশংসা কুড়িয়েছিলো। তিনি প্রতিটি সংখ্যা পড়তেন এবং মধুসূদনকে বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। তিনি মধুসূদনের কবিতারও ভাষা, ছন্দ, ভাব সংশোধন করে দিতেন এবং কীভাবে এগুলো আরও উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। মধুসূদন Calcutta Literary Gazette, Literary Gleaner, Bengal Harold,  Oriental Magazine,Comet প্রভৃতি পত্রিকায় ইংরেজি কবিতা পাঠাতেন। তিনি বিলেতের Benteley’s Miscellany, Blackwood’s Magazine, Edinburgh Magazine এ কবিতা পাঠান।

মধুসূদনের প্রথম ইংরেজি কবিতা My Fond Sweet Blue Eyed Maid. রচনাকাল ২৮ মার্চ ১৮৪১। 

When wildly comes the tempest on,

When Patience with a sigh

The dreadful thunder-storm does shun

And leave me lone to die;

I dream— and see my bonny maid;

Sudden smiling in my heart;

Oh! She revives my spirit dead

And bids the tempest part!

যারা ইংরেজি কবিতা বুঝে, তারা বুঝতে পারবে এ কবিতার ভাব ভাষা ও ছন্দ কতটা পরিপক্ব ছিলো। তখন কবি মাত্র সতেরো বছর বয়সের তরুন। এ কবিতায় ব্যবহার করা হয়েছে ababcdcd Ges rhythm: iambic tetrameter with alternative iambic trimeter. 

মধুসূদনের ৬টি স্তবকে লেখা King Porus একটি অন্যতম বর্ণনামূলক ইতিহাস নির্ভর কবিতা। এর ভাব, ভাষা, আবেগ, অলংকার কোনো অংশেই ইংরেজি কবিতা থেকে নিম্নতর নয়।

”Desist–desist! He cried-

Such noble blood should not be shed.”

(স্তবক )

”How should I treat thee?’

Porus replied:

‘Ev’n as a king

In royal pride……..” (স্তবক )

“But where, oh! Where is Porus now?

And where the noble hearts that bled 

For freedom – with the heroic glow.”

(স্তবক )

মধুসূদন একসময় সনেট লেখারও চেষ্টা করেন। তিনি ইংরেজি সনেটের জনক পেত্রার্কের স্টাইল অনুসরণ করলেও সবসময় তাতে স্থির থাকতে পারেননি, শেক্সপেরিয়ান সনেটের প্যাটার্নও তাঁকে অনুসরণ করতে দেখা যায়। কখনো কখনো কোনোটাই পুরোপুরি অনুসরণ করেননি, নিজস্ব স্টাইলে লেখার চেষ্টা করেছেন। পেত্রার্কান সনেটের রাইম-স্কিম হলো abbaabba cdcdcd ev cdecde| নিখুঁত পেত্রার্কান প্যাটার্নের একটি সনেট নিম্নরূপ:

But oh! I grieve not;—for the azure sky

With all its host of stars that brightly shine,

The green-robed earth with all her flow’rs divine,

The verdant vales and every mountain high,

Those beauteous meads that now do glittering lie

Clad in bright sun-shine,—all, oh! all are mine!

And much there is on which my ear and eye

Can feast luxurious!—why should I repine?

The furious Gale that howls and fiercely blows,

The gentler Breeze that sings with tranquil glee,

The silver Rill that gayly warbling flows,

And e’en the dark and ever-lasting Sea,

All, all these bring oblivion for my woes,

And all these have transcendent charms for me!

Iambic pentameter-এ রচিত এ সনেটটির অন্ত্যমিল-বিন্যাস হলো-abbaabba cdcdcd।

অনুরূপভাবে শেক্সপেরিয়ান প্যাটার্নেও মধুসূদন ইংরেজি সনেট লিখেছেন, যেখানে অন্ত্যমিল-বিন্যাস হলো—ababcdcdefefgg। 

মধুসূদনের ইংরেজি সনেটগুলোতে বিচিত্র বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে। প্রেম, প্রকৃতি, আধ্যাত্মিকতা, হতাশা, দুঃখ প্রভৃতি নানা বিষয় ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর সনেটে। কিন্তু তাঁর সনেট পাঠ করে বোঝা যায় না তাঁর দেশ ও মৃত্তিকা কারণ পরাধীন ভারতকে তাঁর নিজের দেশ মনে হয়নি কখনো। তাঁর হৃদয়জুড়ে ছিলো উন্নত সভ্যতার দেশ ইংল্যান্ড, এবং সেখানে যাওয়ার জন্য তাঁর কি ঐকান্তিক আকুতি! 

মধুসূদনের The Captive Lady রচিত হয় ১৮৪৮ সালের দিকে। তাঁর দ্য ক্যাপটিভ লেডি প্রত্যাশিত উচ্চ প্রশংসালাভে ব্যর্থ হলে তিনি ইংরেজি কবিতা লেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু বেথুন সাহেব মধুসূদনের দ্য ক্যাপটিভ লেডি পাঠ করে তাঁর মৌলিক কাব্যপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মাতৃভাষায় কাব্যচর্চা করার পরামর্শ দেন, যা মধুসূদনের মনকে ঘুরিয়ে দেয় এবং খুলে দেয় তাঁর দৃষ্টির দরোজা। তিনি অনুধাবন করতে পারেন যে, একজন পরাধীন ভারতীয়ের পক্ষে ইংরেজিতে কাব্য রচনা করে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে তাঁকে ‘নিজাগারে’ প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল, যা যথার্থই সুফল বয়ে এনেছিল, নিজের জন্যে তো বটেই, বাংলা ভাষা তথা বাঙালি জাতির জন্যেও। ক্যাপটিভ লেডি-র পর তাঁর যে মৌলিক ইংরেজি রচনা পাওয়া যায়, ‘দি এ্যাংলো-স্যাক্সন এন্ড দ্য হিন্ডু’ প্রবন্ধটি এবং ‘রিজিয়া: ইমপ্রেস অব ইন্ডি’ অসমাপ্ত নাটকটি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

যাহোক কাব্যিক দিক বিবেচনা করলে মধুসূদনের ইংরেজি কবিতাগুলো নিম্নতর নয়। হয়তোবা ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা মধুসূদনকে বাংলায় অনবদ্য করেছিলো। আমাদের সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যে প্রতিনিধিত্ব করছে না সঠিক অনুবাদের কারণে। কিন্তু মধুসূদনের সাহিত্য বোঝার জন্য আমাদের তাঁর ইংরেজি কবিতাগুলোরও চর্চা করা উচিত। অন্তত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ্যক্রমে তাঁর কবিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি।

প্রবন্ধ - মাইকেল মধুসূদন দত্তের ইংরেজি কবিতা - প্রমথ রায়
30 Views