রূপকথা Archives - মুগ্ধতা.কম

আহমেদ অরণ্য

২৫ জুন, ২০২৩ , ৯:৩১ পূর্বাহ্ণ

জাদুর আংটি

অনেক অনেক বছর আগের কথা- কৃষ্ণদেশে বাস করত এক রাজা। তাঁর একটি মাত্র ছেলে ছিল। সেই রাজকুমারের বয়স ছিল প্রায় ১৬ থেকে ১৭ বছর। সে দেখতে খুব সুন্দর, সুদর্শন এবং স্মার্ট ছিল। তার একটি মাত্র শখ ছিল পশু শিকার করা। তাই সে পশু শিকারের নেশায় প্রতিদিন দূর-দূরান্তের বনে যেত। আর পশু শিকারে রাজকুমার ছিল অনেক পারদর্শী।    

একদিন রাজকুমার পশু শিকারের জন্য রাজ্য থেকে বহু দূরের একটা বনে চলে গেল। তার সাথে ছিল না কোনো লোক লস্কর, ছিল শুধু একটি ঘোড়া। সাহসী সেই রাজকুমার একা শিকারে যেতেই ভালোবাসত। সেখানে শিকার খুঁজতে খুঁজতে বনের অনেক গভীরে চলে যায় সে। কারণ তার হাতে সেদিন একটি শিকারও ধরা দেয়নি, তাই সে পাগলের মতো হন্যে হয়ে ছুটছে এবং ক্রমশ এগিয়ে চলছে। চলতে চলতে একসময় সে তার রাজ্যে ফিরে যাবার পথই হারিয়ে ফেলে। তখন দিশেহারা হয়ে যায় রাজকুমার। এখন সে কোন পথ থেকে কোন পথে যাবে? সব যেন গোলমেলে।

যত সময় অতিবাহিত হচ্ছে, আর তার মনে ভয়ের জোয়ার যেন, এক নদী কল্পনা বাসা বাঁধতে শুরু করল। তার মাঝে আবার চারপাশটার অন্ধকার যেন কালো পাখির পালকে ঢেকে রেখেছে। সে আঁধারের মাঝে সাঁতরিয়ে-সাঁতরিয়ে, পথ চলছে.. যেন একজন অন্ধ পথিক। চলতে চলতে হঠাৎ করে পা পিছলে ঘোড়া থেকে পড়ে যায় এবং ক্রমশ গড়িয়ে গড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে চলে যায়। ক্লান্ত, শ্রান্ত রাজকুমার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তার ঘোড়া কোথায় চলে যায় খেয়াল থাকে না।

অনেকটা সময় পরে তার জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফিরেই দেখে তার পাশে এক বুড়ি বসে আছে। বুড়ি থুত্থুড়ে দেখতে, কিন্তু খনখনে গলায় কথা বলে। গলায় জোর আছে।

বুড়ি : এই ছেলে তোমার বাড়ি কোথায়? তোমার পরিচয় কী?

তখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রাজকুমার সেই বুড়িকে সব খুলে বলে।

বুড়ি : তোমার কোনো চিন্তা করতে হবে না কারণ আমি অসহায়কে সাহায্য করি। তাই তোমাকেও করতে পারি।

রাজকুমার : তাহলে আপনার পরিচয় কী? আপনার বাড়িই বা কোথায়? দয়া করে বলবেন কি?

বুড়ি : আমি হলাম জাদুকর। আমার দেশ জাদুর দেশ। আমার মন যখন যেখানে যেতে চায় আমি সেখানেই চলে যেতে পারি। আজ আমি এই বনে স্থান করে নিয়েছি আর তুমি ভাগ্যক্রমে এখানেই এসে পড়েছ, তাই তুমি আজ আমার মেহমান। তোমাকে তো আদর যতœ করতে হবে। তোমাকে তো আমার পক্ষ থেকে কিছু একটা দিতে হবে।

রাজকুমার : আমাকে কি মেরে ফেলবেন?

বুড়ি : না। তোমাকে শত বছর বাঁচতে হবে। তুমি রাজার কুমার। তুমি দেশ এবং মানুষের সুখ দুঃখের ভাগিদার হবে, আমার এই বিশ্বাস। কারণ, তোমার কোমল মুখ আমাকে তাই বলে দেয়। তাই তোমাকে আমি একটি বিশেষ উপহার দিতে চাই, তা হলো আমার পক্ষ থেকে এই ছোট্ট উপহার একটি আংটি।

রাজকুমার : আমি এই আংটি দিয়ে কী করব, আমাদের তো এইগুলোর অভাব নেই।

বুড়ি : এই আংটি সাধারণ কোনো আংটি না, এই আংটি ‘জাদুর আংটি’। একে তুমি যা বলবে, সে তাই করে দেবে। এমনকি তুমি যদি তোমার বেশ পাল্টাতে চাও তাও পারবে। তবে সাবধান, কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে এই আংটি ব্যবহার করা যাবে না। তাতে তুমি ক্ষতির মধ্যে পড়ে যাবে।

এই বলে, বুড়ি উধাও হয়ে গেল। আর অনেকক্ষণ পর একটা আওয়াজ, বিদায় রাজকুমার, বিদায়।

রাজার ছেলে জাদুর আংটি পেয়ে বেজায় খুশি। যেন তার খুশির আর অন্ত নেই। জাদুর আংটি হাতে পেয়ে তার মত পাল্টে যায়। সে ভাবে, চাইলেই যদি নিজের রাজ্যে ফেরা যায়, তাহলে আগে দুনিয়াটা দেখে নিই। পরে আবার ফিরে আসা যাবে। তাই নিজ রাজ্যে যাবার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে বাইরের কোনো অজানা গন্তব্যে রওয়ানা করে সে। এই ভাবে সে ঘুরতে ঘুরতে অরণ্যপুর নামে অন্য এক রাজার দেশে চলে যায়। জাদুর আংটির সাহায্যে সে ওই অরণ্যপুরের রাজার সকল খবর নিয়ে নেয়। সেই রাজার সাত কন্যা। ছয় কন্যা বিবাহিত। তাদের বিয়ে হয়েছিল প্রতিবেশী ছয়টি রাজ্যের রাজপুত্রদের সাথে। আরেক কন্যা এখনও অবিবাহিত। তাদের সাত কন্যার মাঝে বড় ছয় কন্যা অনেক অহংকারী আর ছোট কন্যা অনেক ভদ্র সুন্দরী ও সুদর্শন। তার মনটাও ছিল অনেক সুন্দর। গরিবদেরকেও অনেক ভালোবাসত সে। কৃষ্ণদেশের রাজকুমার ছোট রাজকন্যাকে ভালোবেসে ফেলল। দিন যায়, রাত যায় রাজকুমার সেই অরণ্যপুর ছেড়ে আর কোথাও যায় না। কিন্তু ছোট রাজকন্যাকে মনের কথাটি সে বলতেও পারে না। অবশেষে রাজকন্যার মন পাবার জন্য সে জাদুর আংটির সাহায্যে এক রোগা পাগল সাজে। রাজপ্রাসাদের পাশে পুকুর ঘাটে, রাস্তার মাঝে শুয়ে থাকে সেই পাগল। সে জানে, রাজার সাত কন্যা এই পথে প্রত্যেক দিন নাইতে যায়।

প্রতিদিনের মতো, আজকেও তারা আসছে। তারা দেখে, কে যেন শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখে একটি পাগল। তখন ছয় কন্যা তাকে লাথি মেরে তার দেহের উপর দিয়ে চলে যায়। কিন্তু ছোট কন্যা তার শরীরে হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে চলে যায়। এতে বড় ছয় কন্যা অনেক ক্ষেপে যায়। অনেক বকে তাকে ।

গোসল শেষ করে যাবার সময় বড় ছয় কন্যা পাগলবেশি রাজকুমারকে আবার লাথি মেরে চলে যায়। এবং আগের মতো ছোট কন্যা তাকে হাত দিয়ে সরিয়ে-পার হয়ে চলে যায়। তা দেখে বড় ছয় কন্যা আবারো ক্ষেপে যায় এবং ছোট রাজকন্যাকে উদ্দেশ্য করে বড় ছয় কন্যা বলে, এর পরে যদি এই সব ফকির পাগল গরিবদের সাথে এমন বেশি মায়াদয়া দেখাস, তা হলে বাবাকে বলব যেন ওই সব লোকের সাথে তোকে চিরস্থায়ী করে রাখে।

পরের দিন আবার তারা গোসল করতে যাবে, যেতে দেখে ওই পাগল সেদিনও পথে শুয়ে আছে।

ছয় কন্যার বড়জন : শোন ছোটো, এবার তোর শেষ সুযোগ। যদি তাকে (ওই পাগলকে) তুই লাথি না মারিস তাহলে, সরাসরি বাবার কাছে নালিশ।

ছয় কন্যা প্রতিদিনের ন্যায় আজও তাকে লাথি মেরে চলে যায়। (কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, ছোট রাজকন্যা খুব দয়াবতী।) সে আজও পাগলটাকে হাত দিয়ে সরিয়ে চলে যায়।

তার ছয় বোন গুঁই সাপের মতো রাগে ফোঁপাতে থাকে। তারা তাদের কথা অনুযায়ী রাজাকে সব কথা খুলে বলে। পথের একটা পাগলকে এভাবে সম্মান দেখালে রাজকুমারী হিসেবে তাদের মান থাকে না। বাবা তথা অরণ্যপুরের রাজা সব কথা শুনে রেগেমেগে আগুন। অগ্নিশর্মা রাজা ছোট কন্যাকে ডেকে পাঠালেন।

ছোট কন্যা : জি আব্বাজান?

রাজা: আমি তোমার বড় বোনদের কাছ থেকে যা কিছু শুনেছি, তা কি সত্য?  ছোট কন্যা: হ্যাঁ, বাবা সত্য।

রাজা: কেন, তুমি রাজবাড়ির সম্মান ধুলিস্মাৎ করতে চাও?

ছোট রাজকুমরী: বাবা, আমরাও যেমন মানুষ, গরিবরাও তো তেমন মানুষ। শুধু গরিব, তাই বলে কি আমরা ওদের কে তুচ্ছ মনে করে ফেলে দেবো? এটা কেমন বিচার?

বাবা: কি, আমার উপরে এত বড় কথা? পিতার সম্মানের কথা না ভেবে তুমি ওই ফকিরদের জন্য দরদ দেখাও?

কোথায় কোতয়াল, ধরে আনো রাস্তার বদ্ধ পাগলটাকে। আজ থেকে ধরে নেব, আমার ছোট কন্যা মরে গেছে। আর যে এখন আমার সামনে আছে, তাকে ওই পাগলের সাথে চিরস্থায়ী ভাবে রেখে দেবো।

কোতয়াল : হুজুর তাকে আনা হয়েছে..।

রাজা : এবার এদের বিয়ের ব্যবস্থা করো, আমি তাদের বিয়ে দেবো। আজ থেকে আমার ছোট কন্যা মারা গেছে…

ছোট রাজকন্যার চোখ বেয়ে শুধু ঝর্ণার মতো জল গড়াচ্ছে। নিয়তির খেলা তাকে মেনে নিতেই হবে। আর মনে মনে বলছে, হে সৃষ্টিকর্তা, তুমি কেন আমাকে এই বংশে পাঠিয়েছ, কেন?

অরণ্যপুর রাজার নির্দেশে তাদের বিয়ে দিয়ে থাকার জন্য রাজ্যের এক প্রান্তে একটা ঘর বানিয়ে দেওয়া হলো। মোটামুটি জীবনধারণের জন্য সামগ্রী দেওয়া হলো।

পাগলের সাথে অরণ্যপুর রাজ্যের ছোট রাজকন্যার সংসার শুরু হলো। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে সেই ঘরে উঠল রাজকন্যা। সেই রাত্রে বিছানার এক কোণে বসে কাঁদতে থাকে দুখিনী রাজকন্যা। এদিকে পাগলরূপী কৃষ্ণদেশের রাজপুত্র কন্যার পাশে গিয়ে বসে এবং বলে, আমি তাই চেয়েছিলাম, যে সব ঘটনা এখন ঘটলো। তোমাকে প্রথম দেখায় আমার ভালো লেগেছে, তাই এ পাগলের বেশ। রাজকন্যা তাড়াহুড়া করে ঘুরে দেখে রাজার ছেলের পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে এক অনিন্দ্য সুন্দর সুপুরুষ। একবার তাকালে যেন চোখ ফেরে না।

রাজকন্যা : আমি কি স্বপ্ন দেখছি? আপনি কে?

রাজকুমার: না। তুমি যা দেখছ সব সত্য। আমিই সেই পথের পাশের পাগল। যাকে তুমি মানুষ হিসেবে সম্মান করে হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলে। আর আমার ভালোবাসা সার্থক করেছিলে। এসো পাশে বসো, তোমায় সব কথা খুলে বলছি…

রাজার ছেলে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব বলে, তার পেছনের ইতিহাস।

রাজকুমারী তার কথা শুনে আনন্দে দিশেহারা। সে তাকে কীভাবে গ্রহণ করবে, কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না সে। রাজার ছেলে জাদুর আংটির সাহায্যে ভালো ভালো খাবার তৈরি করলো এবং আনন্দের সাথে দুজন খেয়ে নিল। এভাবে খুব সুখে শান্তিতে কেটে গেল তাদের একটি বছর।

এদিকে অরণ্যপুরের রাজা তার উজিরকে ডেকে বললেন, যাও সাত কন্যার সাত জামাইকে দেখে এসো আর এসে আমাকে জানাও কার অবস্থা কেমন।

উজির ছোট কন্যার বাসায় গেলে, গিয়ে দেখে তারা খুব সুখেই আছে।

ছোট রাজকন্যা তাকে দেখে খুব খুশি হলো। অভ্যর্থনা করে ঘরে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো- কী মনে করে এতদিন পরে?

উজির: না মানে, মহারাজের আদেশে আপনাদের দেখতে এসেছিলাম।

ছোট কন্যা অত্যন্ত খুশি হয়ে উজিরকে মেহমানের মতো আপ্যায়ন করল। উজিরও খুশি হয়ে বিদায় নিল। উজির এবার ছয় কন্যাকে দেখতে গেল পাশের ছয়টি রাজ্যে। উজির দেখে তাদের মাঝে অশান্তি। একে অপরের সাথে ঝগড়া লেগেই আছে। এসব দেখে সে চলে এল। রাজদরবারে উপস্থিত হলে রাজা জিজ্ঞেস করলেন- কী ব্যাপার। তাদের অবস্থা কেমন দেখলে উজির?

উজির : না মানে, মহারাজ, অভয় দিলে বলতে পারি।

রাজা: নির্ভয়ে বলো উজির।

উজির: দেখলাম ছোট রাজকুমারী আর তার পাগল জামাই অত্যন্ত সুখে আছেন। জামাইকেও দেখলাম সুস্থ সুন্দর। তাদের ভালোবাসা দেখলে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। এমন সুখী দম্পতি আমি কখনও দেখিনি মহারাজ।

-আর আমার বাকি ছয় মেয়ের সংসার?

-আর ছয় কন্যা ও তার জামাইরা অত্যন্ত অসুখী মহারাজ। মনে হলো, তাদের মধ্যে মনোমালিন্য আর ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। রাজা তাদের খুশি আর অখুশির কথা অত যাচাই করলেন না।

রাজার নির্দেশে কিছুদিন পর সাত জামাই ও কন্যাকে ডেকে পাঠানো হলো। সাত জামাই তাদের স্ত্রীদেরকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে চলে এল।

রাজা ঘোষণা করলেন: আমি আমার সাত জামাইকে পরীক্ষা করবো আর যে জামাই পরীক্ষায় পাশ করবে তাকে আমি আমার রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব দেবো। পরীক্ষাটি  হলো- প্রত্যেক জামাইকে একটি করে ঘোড়া এবং শিকারের সরঞ্জামাদি দেওয়া হবে। যে জামাই বন থেকে সবচেয়ে বড় হরিণটা শিকার করে আনতে পারবে তাকে জয়ী বলে ঘোষণা করা হবে।

বড় ছয় কন্যাদের মাঝে গুঞ্জন শুরু হলো।

তারা বললো: এটা কেমন হবে বাবা? আপনার ছোট জামাইতো পাগল, সে এমনিতেও পারে না অমনিতেও পাবে না। আর আপনার ছয় জামাই তো সকলে সাহসী। তাই বলছিলাম যে ছয় জামাইকে ভাগ করে দিন, তাহলেই তো আপনার ঝামেলা ফুরিয়ে যায়।

ছোট রাজকন্যা: তা কেমন করে হয়? আমার স্বামীও তো সাহসী হতে পারে জয়ীও হতে পারে বাবার শর্তে!

বড় ছয় বোন তখন টিককারি করে। বলে, দেখনা পাগলের সাথে বিয়ে হয়েও বড় বড় কথা!

রাজা: থামো তোমরা, আমার ফয়সালাই চূড়ান্ত। পরীক্ষাই হবে। সাত জামাই যার যার ঘোড়া নিয়ে বনের পথে রওনা দিলো শিকারের উদ্দেশ্যে।

ছয় কন্যারা পরস্পর বলাবলি করে- অত চিন্তার কী আছে? আমার স্বামীতো হয়েই আছে।

তখন অন্যজন টিপ্পনি কেটে বলে- কখনও তোর স্বামী জয়ী হতে পারবে না। তবে আমাদের মাঝে যেই হোক, আমরা একত্রেই থাকব আর ছোটকে এই রাজ্য ছাড়ার ব্যবস্থা করব।

এদিকে ছোট জামাই বনে গিয়ে জাদুর আংটির সাহায্যে বনের সকল হরিণ এক সাথে শিকার করে একটি ঘরের মাঝে বন্দি করে রাখে। আর সবচেয়ে বড় হরিণটা আলাদা করে রাখে। আর ছয় জামাই তো হরিণ খুঁজতে খুঁজতে প্রায় কাহিল হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ একটা হরিণও পায় না। তারা দেখতে পাচ্ছে যে ছোট জামাই রাজার ছেলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তারা তো তাকে দেখে অবাক।

ছোট জামাই: আমি সব হরিণ শিকার করেছি। চাইলে সকলকে একটি করে দিতে পারি।

ছয় জামাইরা বললো- তোমার কী চাই, টাকা? টাকা আমাদের যত আছে সব তোমাকে দেবো।

ছোট জামাই: না আমার এগুলো চলবে না………আমার একটি শর্ত আছে। যে এই শর্ত মানবে তাকে আমি একটি করে হরিণ দেবো। শর্ত হলো, আমি একটি করে ছুন্নির ছেঁকা দেবো তোমাদের রানে। কি রাজি?

ছয় জামাইয়ের প্রত্যেকে রাজি।

তারা বলে, কিন্তু বন্দি হরিণের মাঝে বড় ছয়টি হরিণ চাই।

ছোট জামাই: হ্যাঁ তাই হবে।

ছয় জনকে ছয়টি ছ্যাঁকা আর ওই ঘরের ছয়টি বড় হরিণ দেওয়া হলো। ছয় জামাই খুব আনন্দিত মনে রাজ্যে চলে আর তাদের কথোপোকথন:

-ছোট জামাইটা না বোকার হদ্দ। আরে ব্যাটা, তুই যত হরিণ ধর কিন্তু লাভ নেই। আব্বাজান বলছে বড় হরিণ আনতে। সে তো একটা ছ্যাঁকার বিনিময়ে আমাদের বড় ছয়টি সমান হরিণ দিয়ে দিলো। বোকা কোথাকার! বলে হো হো করে হাসতে লাগল। তারা প্রায় রাজ্যের কাছাকাছি চলে গেল, তখন ছয় কন্যা তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে এল, ছোট কন্যা পাশে বসা।

ছয় রাজকন্যারা হাসে আর বলে- ছোটো, দেখো তোমার গুণধর স্বামী কোথায় গিয়ে পড়ে আছে। গিয়ে দেখো। ছোট রাজকুমারী তাদের কিছু না বলে আপনমনে হাসে।

তার ছয় বোন তখন হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে আর বলে- পাগলের সাথে থাকতে থাকতে দেখ পাগল হয়ে গেছে।

ছয় রাজকন্যা জামাইদের নিয়ে রাজার কাছে গেল।

রাজা: তোমরা ছয় জন দেখি ছয়টি সমান হরিণ নিয়ে এসেছ।

ছয় কন্যারা বলে: বাবা, বলেছিলাম না পরীক্ষার কোন দরকার নেই। আপনার ছয় জামাইকে রাজ্য ভাগ করে দিন। ছোট কন্যার জন্য আমাদের কষ্ট হয় বাবা। দেখুন গিয়ে ওই পাগলটা কোথায় পড়ে আছে।

ছোট কন্যা: দাঁড়ান বাবা, রায় এখন নয়। সময় এখনও আছে। আপনার ছোট জামাই এখনই চলে আসবে।

ছয় কন্যা: আর আসবে……। এমন সময়ে দেখা গেল, ছোট জামাই রাজার বেশে বড় একটা হরিণ নিয়ে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

রাজা: এ কি অবস্থা? এই লোকটার তো রাজার মতো শৌর্য-বীর্য দেখা যাচ্ছে। এ কি সেই পাগল জামাইটা? তার মাথায় ঢুকছে না এত বড় হরিণ আর জামাই রাজার বেশে এত গর্বিত ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে কী করে? রাজার অপর ছয় কন্যা ও ছয় জামাইও হাবার মতো চেয়ে আছে তার দিকে। কী করে সম্ভব?

ছোট রাজকুমারী তখন কৃষ্ণদেশের রাজকুমারের হারিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে প্রেমের জন্য তার পাগলবেশ ধারণ করা, তাদের বিয়ে হওয়াসহ বর্তমান পর্যন্ত সব কথা রাজাকে খুলে বলে। রাজা তখন আনন্দে আত্মহারা! এ যে তার বন্ধুর ছেলে। অরণ্যপুর আর কৃষ্ণদেশের সৈন্যরা একসাথে মিলে একসময় ভয়ঙ্কর এক বিদেশি শত্রæ বাহিনীকে পরাস্ত করেছিল। সেই থেকে দুই রাজার গলায় গলায় বন্ধুত্ব। তিনি ছোট জামাইকে বলেন, আমাদের বন্ধুত্ব এক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আমার ছোট মেয়ের তার এক ছেলের সাথে বিয়েও প্রায় ঠিকঠাক হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ শোনা গেলো, তার ছেলে শিকারে গিয়ে আর ফেরেনি। তুমিই যে সেই ছেলে, আবার ঘটনাচক্রে আমার ছোট জামাই হয়ে গেছ, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নি। আজ আমার মতো খুশি বুঝি আর কেউ নেই। তাহলে, তোমাকে আমার উত্তরসূরি হিসেবে এই রাজ্যের সমস্ত দায়িত্ব লিখে দেবো। আর বাকি ছয় জামাইকে তোমার ইচ্ছামতো রাখতে পারো অথবা বেরও করে দিতে পারো। কারণ, তোমার সাথে অনেক দুর্ব্যবহার করেছে তারা।

ছোট জামাই: না মহারাজ, ওরা যত খারাপ হোক, যতই খারাপ ব্যবহার করুক আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম, কারণ তারা তো আপনারই মেয়েদের স্বামী। তা ছাড়াও তাদের জায়গায় বাইরের কেউ হলেও আমি এরকম করতাম।

রাজা: সাবাশ! তুমি আজ প্রমাণ করেছ বেটা, তুমি আমার চেয়েও বড় বিচারক। তুমিই আমার যোগ্য জামাই আর এই রাজ্যের সুযোগ্য রাজা। এদিকে ছয় রাজকন্যা ও ছয় জামাই তখন অনেক লজ্জিত। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে এবং সকলের কাছে ক্ষমা চাইল। বিশেষ করে ছোট কন্যার কাছে।

অরণ্যপুরের রাজা তার বন্ধু কৃষ্ণদেশের রাজাকে তার ছেলের ফিরে আসার কথা আর তার সাথে আবার নতুন করে তার ছোট কন্যার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে দূত পাঠালেন। খবর পেয়ে কৃষ্ণদেশে আনন্দের জোয়ার বইতে লাগল। এরপর একদিন দুই রাজার উপস্থিতিতে অরণ্যপুর প্রাসাদে ধুমধাম করে আবার বিয়ের অনুষ্ঠান হলো। সারা রাজ্যের হাজার হাজার প্রজা সেদিন নিমন্ত্রিত হয়ে ভুরিভোজ সারলো আর নতুন রাজা ও রানির জয়ধ্বনি করতে লাগল। সেই রাত্রে নতুন রাজা ও তার স্ত্রী একসাথে বসে হাসতে হাসতে তাদের কাছে থাকা জাদুর আংটিতে আলতো করে চুমু খেলো।

রূপকথা - জাদুর আংটি - আহমেদ অরণ্য
109 Views