স্মৃতিকথা Archives - মুগ্ধতা.কম

মুগ্ধতা.কম

২৫ জুন, ২০২৩ , ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

“মৃত্যুফুলে সঞ্চিত সঞ্জীবনী মধু, স্মৃতি—মেদুর—আমার তমো: পুষ্প. ..”

ঘুম একটি মেয়ের নাম। একটি নিমজ্জন। একটি গভীর ধ্যানের জগৎ ও আত্মনিমগ্নতার নাম। ঘুম আসলে একটি অপূর্ব সুন্দর ফেলে আসা গাঁয়ের নামও—একটা সময় থেকে একটি শহরেরও নাম! ঘুম যেখানে—যেখানে গ্যাছে, যেখানে—যেখানে যায়, এর সবটুকুই ঘুম। ঘুম একটি অসম্ভব রক্ষণশীল পারিবারিক আবহের অন্তপুরের নামও আবার!

ঘুম একটি আস্ত পুতুলের বাক্স, লাল, নীল কাপড় পেঁচানো। ডালা খুললেই শুকনোগন্ধ, বকুলবকুল; কখনো বেরোয় আস্ত আকন্দের ঝাড়, সাদা—সাদা দুধকষ ঘ্রাণ-ঘ্রাণ থেকে যাওয়া কিছু শুকনোপাতা। বেরোয় ছোট-বড় পাথর—আস্ত রেললাইন—আর সেই রেললাইনে কান পেতে দূর থেকে ছুটে আসা রেলগাড়ীর ঝিকঝিক, গুমগুম—বুকের ভিতরের ধুকপুকানি!

স্কুল ফেরার পথে— রং—বেরঙের এইটুকু-টুকু পাথর কুড়িয়ে—কুড়িয়ে জমিয়ে রাখা রং-বেরঙের স্মৃতির নামও বুঝি. ..

*

ইদানিং ঘুম খুউব বৈশাখী সন্ধ্যেরাত গড়িয়ে—গড়িয়ে অনেক রাত। ঘন কাজলের মতো মেঘে বিদ্যুতের ঝাঁকি আর দুরুদুরু বুক!  ঝড়ো বাতাসে কোন দূরের ভূতুড়ে জলামাঠের দিক থেকে উড়ে আসা বেপথু খড়, উলুখাগড়ার শুকনো আঁশ—ভয়ভয় উত্তরের বাঁশবাগানে বাতাসের শো-শো কান্নার সমবেত কোরাস! আঁশ-শ্যাওড়া আর অশ্বত্থের ডালে—ডালে বড়পাখির ডানা—ঝাপ্টানোর ক্ষীণ শব্দ। খোলা—জানালার ভিজে বাতাসের ধাক্কায় মশারির উড়ে যাওয়া পাল, যেন ছাড়া পেলেই উড়ে যাবে! একটি সিক্তনদীর মনখারাপের একা—একা ধু-ধু  বালিরচর! আর আনমনে হেঁটে যেতে—যেতে শামুকের খোলে কেটে গিয়ে রক্তে ভেসে যাওয়া পা—ইশ! 

এইসব সময়ে ভেসে আসে একেবারেই কানে না-যাওয়া মায়ের দীর্ঘ ডাক. ..  “ঘু—উ—উম খেতে আয়, রাত হচ্ছে—তাড়াতাড়ি. ..

ঘু-উ-উ-ম জানালা থেকে সরে আয় বলছি, বাজ ডাকছে—এক্ষুনি! ঘু-উ-উম ভিজে যাচ্ছিস… মাথায় আবার ব্যথা হবে, ঘু-উ-উ-ম…”

উৎসুক লতার মতো ঘুম কাঁপছে থিরথির, যেন ভীষণ শীত পড়েছে এই মধ্যচৈত্রে—ঝাপটা বৃষ্টিতে ভিজে গেছে ঘুমের মুখ, ঘুমের কিশোরী বেনী আবার ভয়েভয়ে আলনার পাশে ত্রস্ত—চকিত ঘুমের গোল্লাগোল্লা চোখ, কুণ্ডলী বেঁধে থাকা অন্ধকারে- ও মাগো… ! 

একদৌড়ে মা… আর কিছু নেই—কিচ্ছু না— এখন মাকে লাগবে…।

পাশ ফিরতেই মা! কোথায় ছিলে মা, তুমি?  আমার ভীষণ ভয় করছিল!

সেই তুলো—তুলো উম—উম নরোম বুকে পাখির বাচ্চার মতো ঘুম এখন—কী হয়েছে? ওখানে কিছু নেই তো-ও-ও- খালি ভয় পাওয়া —কিচ্ছু নেই! আরে ছা-ড় আমাকে—ছাড়,  এইটুকুতে ভয়, হুম?

জীবনে কতো অন্ধকার আসে, জানো? সব মাড়িয়ে হাঁটতে হবে।

এইট্টুকুতেই ভয়! সাহস রাখতে শেখো ঘুম… ওইখানে কীইইই ! আ-বা-র? আরে—এটা তো একটা ছায়া! হাতে লণ্ঠন নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দেয়া যে আলনার মাথায় পাইলটের ক্যাপটা রাখা! তক্ষুনি এটাকে ওখান থেকে সরিয়ে আড়ালে রেখে আবারও এবার নাও, এখানে চুপ করে বসো এসে—হ্যাঁ , হাঁ করো, আরে—বড় করে! হ্যাঁ—আরও বড়. ..  কী মেয়ে বাবা! 

আজ স্কুলে কী হলো রে, ঘুম? সেই যে তোর নতুন বন্ধু, কী যেন নাম! হুম. .. চুলের কাটাটা খুঁজে পেয়েছে তো? পায়নি, না? আহারে. .. ওর—তো মা নেই! একদিন নিয়ে আসিস তো তোর সাথে করে. ..।  

ঝাল! কোথায় ঝাল? মিথ্যে কথা ঘুম! আর হ্যাঁ, নিজের হাতে খেতে হবে, নিজে—নিজে খাবে—পারবো না বললে হবে কেন—ভাই তো নিজের হাতে খায়।…একটু পানি খাও, পানি খাও, বিষম খাওয়া কেন আবার!   

হুম হাঁ কর, বাবাও খাইয়ে দেবে না আর এখন বড় হয়েছো—উফ রে…আস্তেএ—এ —হুম—এই তো আর ক’টা, শেষ হয়ে যাবে সোনা, আর একটুখানি তো—আর মাত্র কয়েকবার।

‘তুমি বড় হয়েছো—বাবাও আর খাইয়ে দেবে না, নিজের হাতে খাও’ এসব কী!

কী বলছে মা নিজেও জানে? ওই একটুখানি ভাতই তো, আর আমি মাখতে গিয়ে ছড়ে যায় চারদিকে !  আমি পারবো না আর আব্বা ঠিক মেখে দেবে, খাইয়েও দেবে, তোমাকে লাগবে না. .. আর ওই যে…পাজামার কষিও বেঁধে দেবে, দেখো.  … ইত্যাদি ইত্যাদি। 

পাজামার কষিতে প্রায়ই গিঁট লেগে যায়—খোলা যে কী কষ্ট! তা শুধু ঘুম নিজে জানে। সাঁতার প্রায় শিখে গেছে ভাই , সেদিন আবার উঠোনের গোলাপজাম গাছেও উঠে গেল! প্রচণ্ড অভিমানে, দুঃখে পাইলটের অসম্ভব কিছু কৃতিত্ব’র ওপর রাগে আর ঝালে সেদিন ঘুমের চোখ দিয়ে বড়-বড় ফোটায় পানি পড়ছিল!  মনে—মনে সিদ্ধান্ত হলো, ভাইয়ের সাথে জন্মের আড়ি।

অবশ্য সেটা কাল সকাল পর্যন্ত মনে থাকাও একটা বিষয়! 

বড় হওয়া কাকে বলে? বড় হওয়া তাহলে এই! তাহলে অই—রকম বড় আমার লাগবে না!

*

এর পরেরদিন বিকেলবিকেল আবার খুউব ঘনমেঘ জমেজমে গুড়ুম—গুড়ুম গর্জন! শুরু হলো ঝটকা হাওয়ায় সঙ্গে বৃষ্টির কত্থক। ঝুম বৃষ্টি। চারদিকে জলপ্রপাতের মতো বৃষ্টির শাদা-শাদা দীর্ঘ মুক্তোরমালা কী সুন্দর মাটিতে নামছে! লোকনাথের বান্নী থেকে কেনা মুক্তোরমালাটা এখন কোথায়? আব্বাকে বার—বার করে মা’র নিষেধ — ‘ আবার সেবারের মতো ঘুড্ডি কিনে যেন ঘরে আনা না হয়।

ঘুড্ডি তো এসেইছিল! না এসে উপায় আছে?  আর একটা ছাতা—রঙিন। জীবনের প্রথম ছাতা—এক্কেবারে, নিজের। কী খুশি—কী খুশি! পাইলট হাঁ করে দেখতো আর একটু ধরে দেখতে এলেই ঘুমের দাবড়ানি, অতঃপর পাইলটের ভ্যাংচি। একটা দাঁত পড়লো কিন্তু আর উঠে না, আরেকটা নড়ে—ফোঁকলা—হি হি হি…;

অনেক রাতে বৃষ্টি থেমে গেলে জানালায় চোখ মেলে একদম  উড়ে যাওয়া-মেঘেদের দেশে!

হঠাৎ কপালে একটা হাত, হলুদের গন্ধমাখা,

মেথি আর বেলীবেলী—ওটা মা! .  .. আয়, সরে আয়, হাওয়া লাগছে—এরপর কাশি বাড়বে, জ্বরটা এখনো  কমেনি ঘুম, আ-য়-য় —। শব্দগুলো খুউব দূর থেকে তরল প্লাবনের মতো ভেসে আসে—ভেসে—ভেসে আসে…;

জেগে থাকা শেষরাতের আকাশে আধোঘুম চাঁদ কিংবা কেবলই ফুটফুট করা ক’টি তারা, আর ইন্দ্রজিতের কুণ্ডল—একান্নবর্তী। বইতে আছে, একে বলে সপ্তর্ষিমণ্ডল।

একটা সংসার যেন। কী সুন্দর মিলেমিশে থাকে ওরা, কেউ কখনো এতোটুকুনও কাছছাড়া হয় না!

হয়তো, এখনো আছে! এদের একজনও কেউ কোনোদিন কাউকে ছেড়ে দূরে চলে যায় না। একটা দীর্ঘশ্বাস নামে ঘুমের বুক ফুঁড়ে।

বিশাল ছাতের কার্ণিশে সকাল—সন্ধ্যায় প্রিয় পায়রার বুকে মুখ গুঁজে ঘুমের শুরুটা! একটু—একটু করে বুঝতে শেখা। বলা যেতে পারে, এক স্বপ্ন—সম্ভবা জননীপৃথিবীকে জন্মের পর থেকে ধীরে—ধীরে জানবার আগ্রহের নামও ‘ঘুম’।

‘ঘুম’ শব্দটি শুনলেই কেমন হাই ওঠে, না? সত্যি তাই। ঘুমঘুম লাগে। হ্যাঁ, একটা আদুরে—আদুরে গোলগাল শ্যামলা মুখের দুইপাশে দুইবেনীর একটি মুখের নাম ঘুম। যার মা এই নাম দিয়েছিলেন তার জন্মাবার পরপরই। দিনরাত সে কেবল ঘুমুতো বলে এই নাম।  বিড়ালছানার মতো। পুতিপুতি চোখগুলো মাঝেমাঝে খুলতো, আবার মা’র কোলে শুয়ে চুকচুক করে দুধে মুখ লাগিয়ে আবার ঘুম!   এতোদিন বাদে চোখের সামনে দিয়ে আস্ত বাতাস কেটে—কেটে একটা ফুলোফুলো কুচি দেয়া গোলাপি ফ্রকের প্রান্ত উড়ে যায়. ..  উড়তেই থাকে, আর অপুর মতো দেখতে একটি দুরন্ত কো—পাইলট ছেলের মুখ! পাইলটই পুরো দস্তুর। ঘুম নামের দূর্গার মতো মেয়েটির সর্বক্ষণের সহায়ক সে এবং দোসর সবখানে!

ঘুমের যত সিক্রেট, এর সব পাইলটের রিজার্ভে। যত অনাসৃষ্টি আর দুরন্তপনায় সমান পটু সে, হলুদরঙা স্যুয়েটার পড়া একটি ফুলোফুলো ফর্সামুখ, ওটা ঘুমের বেশ ক’বছরের পিঠোপিঠি।

ঠিক যেন পথের পাঁচালী। এখন পথে পড়ে আছে। পথেই তো পড়ে থাকে! তাই নয়?

গল্পেরা যেমন পড়ে থাকে বইয়ের পাতায় আর পড়াকালীন স্বপ্নের জগৎ, রেললাইনের মতো এঁকেবেঁকে সমস্তই একটু-একটু করে মুছে যায়, আবার যায়ও না- এক অদ্ভুত দো-টানা।   এখনো শহরের শরীর ফুঁড়ে ধাবমান ট্রেনের হুইসেল কানে গেলেই চমকে উঠে জানালায় দৌড় লাগায় ঘুম, যদিও ওই জানালার থেকে অনেক অনেক দূরে সেই রেলপথ। জ্যাম ঠেলে—ঠেলে, একঘন্টার পথ গিয়ে তারপর প্রযুক্তির আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সির পক্ষপাতে মোড়ানো রেলপথ!

কোথায় সেই অপুকে নিয়ে দুর্গার কাশেরবন, আর মাঠ-ক্ষেতের আলপথ ছাড়িয়ে মাকে লুকিয়ে রেলপথ দেখতে যাওয়া সেই পাইকপাড়া রেলস্টেশন?

কিচ্ছু নেই। মুছে গিয়েও যেন যায় না একজন সর্বজয়ার মুখ, যেখানে পৃথিবীর যাবতীয় মায়ের মুখ আঁকা। সেই সর্বজয়াদের ঘরের কুলুঙ্গিতে রাখা পিদিমের আলোর মতো, কিংবা বাহারী শৌখিন কাচের লণ্ঠন, যা বিশ্ব-সংসার আগলে রাখে আর সর্বদ্রষ্টা বাবাদের মুখে বরাবর সক্রেটিসের উদাসীনতার মমতা। আশ্চর্য এই পৃথিবীর আনাচ-কানাচ!

কতো কী ধরে রাখে আর কতো কী যে ফেলে দেয় অনায়াসে, কে জানে! একটা সময় সর্বজয়াদের রান্নাচালার ধুঁয়ার শিখা কে-ম-ন সরু আর ফিঁকে হতে হতে চালের ফোঁকর দিয়ে সেই অন্তরীক্ষে উঠে যায়—উঠোনের কাপড় শুকাবার তারে, যেখানটায় কাঠের হ্যাঙ্গারে ঝুলতো রকম—রকম সফেদ, বাহারি পাঞ্জাবি, শৌখিন কাঠের বোতামে বাতাসে দুলতে দুলতে! পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে ঘুম তাদের গায়ে আনমনে নাক ঘষে আতরের গন্ধ শুঁকে, এখনো! .  .. চোখ খোলা রাখতে পারে না ঘুম।

*

এইসব এখন অন্ধকারের চকচকে ফুলগাছ, যা দূর থেকে দেখা যায়। “দ্য লাইটহাউজ”  ঘুমের একান্ত  তম:পুষ্প! 

সুখের ঘ্রাণ দেয়, থেমে গেলে ঘুমকে পথের দিশা দেয়, হেঁটে যাবার তাড়া দেয়—”ঘুম আরেকটু হাঁটতে হবে, থেমো না…।  ওই বুঝি একটা গন্ধ নাকে এলো, জীবনের গন্ধ, ঘুম পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে। 

এখন পুরনো কড়িকাঠ ঝুলে থাকে কালো—কালো বাদুড়ের মতো অন্ধকার! ঝুল জমে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো কাঠের প্রতিটি আসবাব। একটি ঝমঝম, ঝিকঝিক বাড়ি, ঘুমদের বাড়ি! চমকে পাশ ফেরে ঘুম!

কানে বাজে গভীররাতের পরীক্ষার পড়া আর সে-ই বুক ঢিপঢিপ করা কুঁ-কুঁ রাতচরা পাখিটির ডাকতে থাকা! কখনো কানে আসে প্যাঁচার খ্রা-ও-ও — খ্রা-ও-ও — বুক হীম করা ডাক!

*

একদিন কোথাও অসামান্য এইসব চরিত্র/চালচিত্রের কিছুই কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এর প্রতিটি অমূল্য স্মরণ ও স্মৃতি ঘুমের বুকে ডুবে যায়, ডুবে-ডুবে থাকে। মাঝে—মাঝে মনে হয়, যেন পৃথিবীর অনিদ্রাচোখে সে এক চিরঘুম, যখন সে জেগে থেকেও কিছু দেখে না, অর্থাৎ দেখতে পায় না কিন্তু বুকের ভিতরটা ভীষণ ভারি মনে হয়।

তবুও মাঝেমাঝে মনে হয় যেন সে এখন হিসেবের বাইরে চলে গেছে—নিজেই—নিজেকে ফটকের বাইরে রেখে এসেছে বহুকাল আগে। উত্তর, পশ্চিম, পূর্ব, দক্ষিণ কোন গোলার্ধে যে আছে, যা পৃথিবী নিজেও জানে না! একদিকে অনন্তের ছিঁটেফোঁটা খুঁজে বেড়াচ্ছে স্বার্থান্বেষী গুপ্তচর সময়! —আরেকদিকে ঔপনিবেশিক শাসন তুচ্ছ করে, রক্তাক্ত লড়াকু ভুমিকায় সর্বস্ব প্রতিবাদ, যেন সকল ঝড়ের বিরুদ্ধে, ঝাপটার বিরুদ্ধে ঘুমের আকম্প ঘৃণা।

জেগে ওঠা যেমন আছে, আছে নিরাসক্ত পোড়োবাড়ি হয়ে ওঠা। যার দেয়ালে—দেয়ালে আভিজাত্যপূর্ণ গাম্ভীর্য। যাক—গে, এক ফুঁ’য়ে উড়িয়ে দিয়ে বরঞ্চ জাগ্রত মানুষের প্রাপ্যরূপ বিস্মৃত থেকে থেকে অন্ধত্ব, বধিরতাও বেশ ভালো আয়ত্ত করতে হয়েছে সেই ঘুম নামের মুখটিকে নিজে থেকেই! শেষমেষ কক্ষপথচ্যুত ধুমকেতুর মতো সে দ্বিকবিদিক হয়ে সপাটে আছড়ে পড়েছে কোথায় কোন প্ল্যানেটে! পৃথিবী তার একবিন্দু খোঁজ রাখেনি। কন্ট্রোলপ্যানেলের ভূ-উপগ্রহ চিত্রে এবং শেষ নিউজ-বুলেটিনে জানা গেছে এর ধ্বংসাবশেষ থেকেও আর কোনো প্ল্যানেট কিংবা নতুন কোনো অধুনা নগরী হবার আর সম্ভাবনা আপাতত নেই- সেখানে প্রাণের সন্ধানমূলক জল—বাতাসের কোনো আলামত শেষ পর্যন্ত মেলেনি, অর্থাৎ পুরোপুরি ভ্যানিস!

ঘুম বুঝি মৃত্যু! যার মানে ‘নেই হয়ে যাওয়া’ ! যেন জ্বরের ঘোর, ডুবে যেতে—যেতে আশপাশ ভুলে যাওয়া, ভুলতে থাকা প্রিয়গানের সুর, মুখ—মুখোমুখি প্রিয় স্মৃতি বুকের অতলে—গহ্বরে. .. ! সমস্তকিছুই আমার হওয়ার মতো আপন গহব্বরের প্রিয়কিছু ধ্যানের মতো লীনানুভব। এক অপূর্ব প্রাসাদপ্রান্তের মণিময় তোরণ, যা বহু—বহু দূ-র থেকে আকাশপারের ইন্দ্রধনুর মতো জ্বলজ্বল করে, জ্বলে।

*

পৃথিবী তথা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে সমস্ত লেন-দেন যার চুকেবুকে যাওয়া! নিভে যাওয়া ! যেখানে আবার জেগে—ওঠার মতো অনিশ্চিয়তাও আছে। কিছু ঘুম’ এর গল্পের শুরু যেমন নেই, শেষও পাওয়া যায় না। না’ই বা গেল!!! তবুও –

“সবা হতে রাখবো তোমায়

      আড়াল ক’রে

হেন পূজার ঘর কোথা পাই

      আমার ঘরে।

 যদি আমার দিনে রাতে

 যদি আমার সবার সাথে

 দয়া ক’রে দাও ধরা তো

      রাখব ধরে ।”

থেকে থেকেই হরিৎ রঙা লাল সোনার পদ্মসুষমায় কিছু কাতরমেঘ এসে জড়ো হয় পাণ্ডুর গোধূলির বুক ছুঁয়ে ঘুমের দুইচোখে! যতদুর অন্তঃদৃষ্টি প্রসারিত হয়—যেন,  পাথরে—পাথরে প্রজ্বলিত হাজারো সুবাসিত মোমেরশিখা এসে সানুনয় ভঙ্গিতে আজন্ম কুর্ণিশে দাঁড়িয়ে থাকে এই ঘুমের মুখোমুখি!

‘এ জীবন পূণ্য করো, দহন দানে—

        আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’…; 

হ্যাঁ, সেই পরশমণি আজ জীবনের কোণায়—কোণায় বিচ্ছুরিত আলো হয়ে পথ দেখায় ঘুমকে। কিছু অমূল্য স্মৃতি যেন প্রাচীন দেবদারু, নিষ্কম্প সমাহিত, সুন্দরের প্রতিমূর্তি হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। যেন মৃত্যু—ফুলের মাঝে অমৃত, মধু। এইটুকু সঞ্জীবনী বিনীত প্রার্থনার সমতূল্য হয়ে, বিনীত আকিঞ্চনে নত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তেমনি “ঘুম” এর জীবনের পাড়ে—পাড়ে  ঘুমের আজীবনের সজল মেঘমেঘ অন্ধকারে—ঘুম সেটা কখনো টের পায়, কখনো পায় না…!

অদিতি শিমুল

লেখকঃ অদিতি শিমুল

মৃত্যুফুলে সঞ্চিত সঞ্জীবনী মধু, স্মৃতি—মেদুর—আমার তমো পুষ্প - অদিতি শিমুল
36 Views