মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

অপরাধী

অঙ্কনা জাহান

২৫ জুন, ২০২৩ , ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

eid - গল্প - অপরাধী - অঙ্কনা জাহান

-দোস্ত, জানিস মানুষ কখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়?

-কখন? কবিরের প্রশ্নে পাল্টা  প্রশ্ন করে তমাল।

সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে একটু বেশি সময় নিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে কবির। উদাস ভঙ্গিতে বলে, যখন দুনিয়াটা তার কাছে বিষাক্ত আর তিতা লাগে।

তমালের সরল প্রশ্ন, কীভাবে?

শুষ্ক হাসে কবির। তমালের পিঠ চাপড়ে সবলে, দোস্ত তোর মতো মানুষের জন্যই এই দুনিয়াটা। এই দুনিয়া মূলত বোকাদেরই পছন্দ করে। আর বোকারাই দুনিয়াতে সবচেয়ে সুখী হয়।

আবারও সিগারেটে টান দেয় কবির। তমাল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলে, দোস্ত তুই কি আমাকে অপমান করছিস?

-না, সত্যটা বললাম। দেখ, তোকে সবাই কেন পছন্দ করে? কারণ তুই একজন নিপাট ভদ্রলোক। কারো সাতেও না, পাঁচেও না। মানুষকে স্পেস দিতে পছন্দ করিস। তোকে সহজেই বশে আনা যায়। এমন মানুষকে মানুষ পছন্দ করবে না তো কী করবে বল।

-তাই বলে আমি বোকা?

-হয়তো বোকা, নয়তো না। আচ্ছা তোর কি মনে হয়, মাহির কি বোকা ছিল না চতুর?

-কী আজগুবি সব কথাবার্তা বলছিস। পাগল হয়ে গেছিস না কি!

-সত্যি আমার পাগল পাগল লাগছে। মাহিরটা আমাদের ছেড়ে চলে গেল এক পৃথিবী অভিমান নিয়ে। আমরা কিছুই করতে পারলাম না ওর জন্য। কতজনে বলছে কী দরকার ছিল আত্মহত্যা করার। তার বাবা-মা আজ কান্নায় বুক ভাসাচ্ছেন। কিন্তু বেঁচে থাকতে তারা যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মাহিরের চেয়ে তাদের ইগো, জিদ এসবের গুরুত্বই বেশি ছিল। একটু আগে বললাম না, দুনিয়াটা বিষাক্ত হয়ে গেলে মানুষ আত্মহত্যা করে। মাহিরের দুনিয়াটা বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো কেউ ছিল না, তার সাথে দুটো কথা বলার মতো বা তার দুটো কথা শোনার মতো কেউ ছিল না। এই যে তার মানসিক কোনো আশ্রয় ছিল না, এর কারণে তার দুনিয়াটা তিতা হয়ে গিয়েছিল। বিষাক্ত হয়েছিল কখন জানিস?

-কখন?

– যখন আমাদের বন্ধু মহলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি হতো, তার সামনেই তার বাবা-মাকে নিয়ে রসালো আলাপ হতো, তার আত্মীয়-স্বজন তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। আমাদের মহান শিক্ষকগণ তাকে উপহাস করত। তারপরও ছেলেটা বাঁচতে চেয়েছিল রে, আমরা ওকে মেরে ফেললাম। গত পরশু সে যখন আমাকে জড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদল তখন আমি ওকে কোনো শান্ত্বনা দিতে পারিনি। ভেবেছিলাম কেঁদে মনের কষ্ট একটু হালকা করুক, আপনা-আপনি সব ঠিক হয়ে যাবে।  ওর শেষ বলা কথাগুলো আমাকে অনেক দিন ঘুমাতে দেবে না। তার কাছে আমরা সবাই অপরাধী হয়ে রইলাম।

কাতরকণ্ঠে তমাল জিজ্ঞাসা করল, কী বলেছিল মাহির?

মাহির বলেছিল, দোস্ত আমি তো আমার দোষে একা নই। একা থাকার কারণে সবাই আমার সাথে এমনভাবে কথা বলে মনে হয় আমি কোনো মানুষ নই, জন্তু। একা মানুষ বলে আমাকে অফিসে বেশি শ্রম দিতে হবে, বন্ধুদের আড্ডায় অতিরিক্ত সময় দিতে হবে, শরীর ক্লান্ত থাকলে ও রাত করে বাড়ি ফিরতে হবে। কেননা আমার জন্য তো কেউ অপেক্ষা করে নেই ঘরে। কার জন্য তাড়া করে ঘরে ফিরব? “বাসায় গিয়ে তো একাই থাকা লাগবে, এত তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে কী লাভ’ এই কথাটা শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছে। তারা কি জানে, দরজার ওপাশে কেউ একজন না থাকার কী কষ্ট, ঘর থেকে বেরোনোর সময় হাসিমুখে বিদায় দেওয়ার একজন মানুষ না থাকার কী যাতনা, ঘরে ফিরে বোবার মতো থাকা একজন মানুষের হাহাকার? তারা কিছুই জানে না দোস্ত। তারা শুধু দুঃখ দিতে জানে। আমার কাছে দুনিয়াটাই দিন দিন জাহান্নাম হয়ে উঠছে।

চোখ দিয়ে অঝোরে গড়িয়ে পড়া জল মুছে নিয়ে কবির আবার বলে, একা একা বেড়ে ওঠা মাহিরকে আজ অনেকে কাপুরুষ বলছে। ও তো আত্মহত্যা করেনি। আমরা সবাই মিলে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি। আমি নিজেও কতদিন ওকে বলেছি, বাসায় গিয়ে কী করবি একা একা। আমি বুঝতে পারিনি আমাদের হাসি-ঠাট্টা ওর বুকে কাঁটার মতো বিঁধবে। মাহিরকে কবরে নামানোর সময় মনে হয়েছিল আমি ওর সাথে থেকে যাই। ওর সাথে সহমরণে গেলে বুঝি মুক্তি পেতাম। 

কবিরকে জড়িয়ে ধরে তমাল।

-এমন কথা বলিস না, দোস্ত।

কবিরও তমালকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। গত পরশু মাহির যেমন করে কবিরকে জড়িয়ে ধরেছিল।