ঈদের বদলে যাওয়া

ফারহানা আনাম বিথী

১৩ মে, ২০২১ , ১:৪৮ পূর্বাহ্ণ ; 689 Views

ঈদের বদলে যাওয়া - ফারহানা আনাম বিথী

“মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়।” ছোটবেলায় আমার গণিত শিক্ষকের (মকবুল হোসেন) মুখে প্রায়শই শুনতাম প্রবাদটি। বেঁচে থেকে নিজের বদলে যাওয়াতেই কথাটির যথার্থতা বুঝেছি। আমাদের সামাজিক কিংবা ধর্মীয় উৎসব গুলোও বড় জীবন্ত। যুগে যুগে এগুলোও তাই বদলাতে থাকে। নিজেদের জীবনেই ছোট বেলার ঈূ নষ্টালজিক হয়ে যায় বড়বেলায় এসে।

মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদ। উৎসব মানেই আনন্দ আর খুশি। আমরা দেখি একটি পুরো জীবনকালেই ঈদের আনন্দের রূপ পাল্টাতে থাকে বয়সের সাথে সাথে। শিশুকাল থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনকাল।  এভাবে মধ্য বয়স থেকে বৃদ্ধ বয়সে এসে দেখা যায় প্রতিটা বেলায় আনন্দ উদযাপনের ধরণ গুলো ভিন্ন ভিন্ন। কৈশোরে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শীদের বাড়ি বাড়ি যেয়ে ঈদের সেলামী নেয়ার আনন্দটাই অন্যরকম। আবার কে কতো সেলামী পেলো সেটা নিয়েও চলতো প্রতিযোগীতা। যৌবনে এসে বন্ধুদের সাথে ঈদের আড্ডা আর ঘুরে বেড়ানোটাই মূখ্য আনন্দ। মধ্য বয়সে পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটানোতেই যেন সব আনন্দ।  পরিবারের যাঁরা মুরুব্বি থাকেন, যেমন দাদা দাদি, নানা নানি। তাঁদেরকে দেখেছি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে তাদের বিভিন্ন বয়সের ঈদের গল্পগুলো বলেই তারা ঈদের আনন্দ উপভোগ করেন। যেন স্মৃতিচারণেই তাদের ঈদ আনন্দ।

এতো গেলো বিভিন্ন বয়সে ঈদের বদলে যাওয়া।  এছাড়াও কালে কালে বাঙালির জীবনে ঈদে তার রূপ পাল্টে গেছে। বৈশ্বিক আধুনিকতার ছোঁয়া এসে লেগেছে আমাদের উৎসব গুলোতেও। কিংবা আমরা আধুনিক হতে চেয়েছি, কখনো বাঙালি সংস্কৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য গুলোকে ঠিক রেখে। আবার কখনও সংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেলেছি উত্তরোত্তর আধুনিকতায়। তাই তো সত্তরের দশকের ঈদের সাথে আশির দশকের ঈদের যেমন অনেক পার্থক্য তেমনি নব্বই দশকের ঈদের সাথে আজকের ঈদ উদযাপনের ধরণ অনেকটাই আলাদা।

আশি নব্বইয়ের দশকে ইলেকট্রনিক মিডিয়া টেলিভিশনে ঈদ বিনোদনের আকর্ষণীয় বিষয় ছিলো “আনন্দমেলা”। এছাড়া বি টিভির ঈদের নাটক ছিল বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণ। বিটিভিতে আনন্দমেলা, ঈদের নাটক দেখার ছলে পরিবারের সবাই মিলে হৈ হুল্লোড় করার আনন্দটাই ছিলো মূল বিষয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলের অসংখ্য নাটক সহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের ভীড়ে সেই নির্মল আনন্দটা নেই বললেই চলে।

ঐ সময় আরেকটা চল ছিল। সেটা হলো, ঈদের চাঁদ দেখার পর পরই পাড়ায় পাড়ায় ক্যাসেট প্লেয়ারে ফুল ভলিউমে গান বাজানো হতো। ঈদ উপলক্ষ্যে রিলিজ হওয়া জেমস কিংবা আইয়ুব বাচ্চুর এলবাম কিনে নিতো ছেলে পেলেরা। ঈদের দিনও পাড়া মহল্লার মোড়ে মোড়ে সেসব বাজতো সারাদিন।  বর্তমানে ভিনদেশী কিছু ভয়ংকর সংস্কৃতির থাবা পড়েছে আমাদের বিভিন্ন উৎসব গুলোতে। বর্তমানে ঈদের মেলাও আর সেভাবে চোখে পড়ে না।

সেকালে ঈদের পোষাকের সাথে সাথে ঈদ কার্ড কেনার ধুম পড়ে যেতো বন্ধু বান্ধবদের ঈদের শুভেচ্ছা ও দাওয়াত দেওয়ার জন্য। অনেক সময় নিজেরাই বিভিন্ন ডিজাইনের ঈদ কার্ড বানিয়ে নিতাম।কালক্রমে মোবাইল,ইন্টারনেটের ডিজিটালাইজেশনের যুগে আগের মতো ঈদ কার্ড বিনিময় হয় না। সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে ফোন কল বা মেসেজের মাধ্যমে। ফেসবুক যেন আরো সহজ করে দিয়েছে বিষয়টি। একটা সুন্দর শৈল্পিক স্টাটাস ব্যাস। মনে প্রশ্ন জাগে কেড়েও নিয়েছে কি অনেক কিছু? কাছে যাওয়ার, সামনাসামনি দেখা করে গল্প আড্ডার আন্তরিক অনুভূতি গুলো! কিছুটা তো বটেই।

আমাদের ছোট বেলায় ঈদ উপলক্ষ্যে যে পোষাকটি কেনা হতো সেটা ছিল আমাদের কাছে বিশেষ কিছু। এবং সেটা অনেক যত্ন করে আলমারিতে লুকিয়ে রাখা হতো।  পাছে কেউ দেখে ফেলে এই ভয়ে। বর্তমানে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতির ফলে ধনীরা তো বটেই মধ্যবিত্ত মোটামুটি সারা বছরেই নতুন পোশাক কিনে থাকে। ফলে ঈদের পোষাকের যে আলাদা চাপা আনন্দ তা প্রায় হারিয়ে গিয়েছে।

এছাড়া শহর কেন্দ্রিক মানুষের মধ্যে দেখা যায় অতিমাত্রায় ফ্যাশন সচেতনতা।

সেকালে  বাড়ির মেয়ে মাহিলারা ঘরোয়া পদ্ধতিতেই ঈদের আগের দিন রূপচর্চার বিষয়টি সেরে ফেলতো। একে অপরকে গাছের পাতার বাটা মেহেদী কাঠি দিয়ে পরিয়ে দিতো। বর্তমানে শুধু মেয়েরা নয় ছেলেরাও পার্লার গিয়ে সেরে নেয় রূপচর্চার বিষয়টি।  ঈদের দু’ তিন দিন আগে থেকেই পার্লারগুলোতে দেখা যায় উপচে পড়া ভীড়।

বর্তমানে অনেক ধনীদের মধ্যে আরেকটি নতুন চল দেখা যায়।  ঈদ মানে আত্মীয় স্বজন সবাইকে ছেড়ে বাড়িতে তালা মেরে দেশের বাইরে আশেপাশে অথবা দেশেই কোনো টুরিস্ট স্পটে গিয়ে ঈদ উদযাপন করা।  আবার ঈদের দিন বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে যে বেড়ানোর চল ছিল তার পরিবর্তে এখন বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন দামী রেষ্টুরেন্টে গিয়ে সবাই মিলে ঈদ সেলিব্রেশন করেন।

ঈদের বিশেষ রান্নার মেনুতেও দেখা যায় ব্যাপক পরিবর্তন।  বর্তমানে চাইনিজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিদেশী ডিস দখল করে ফেলেছে আমাদের রন্ধন শিল্পকে। কালের স্রোতে হারিয়ে গিয়েছে কিংবা যাচ্ছে আমাদের নানী দাদীদের রন্ধন পদ্ধতি কিংবা ঐতিহ্যবাহী কোনো রান্না।

বর্তমানে অনলাইন শপিং ঈদের কেনাকাটায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। চাকুরীজীবী মায়েরা তাদের ব্যস্ততার কারণেই অনলাইন কেনাকাটা সেরে ফেলেছেন।  তাছাড়া এক যায়গা থেকেই বিভিন্ন জেলাট ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র, পোষাক এমনকি খাবারও এই অনলাইন শপিং এর মাধ্যমে মানুষের হাতের নাগালে এসে গিয়েছে।  ঈদুল আযহাতেও এখন অনেকেই গরুর হাটে না গিয়ে অনলাইনে গরু পছন্দ করে থাকেন।

তবে স্বাধীন বাংলাদেশে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ২০২০ সালে কোভিড-১৯  এর মহামারীর কারণে আমরা এক ব্যতিক্রমধর্মী ঈদ পালন করেছি। সম্পূর্ণ গৃহবন্দী।  একা পরিবারে সাথে।  মহামারীর করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে গিয়েছিলো ঈদের সমস্ত আনন্দ। সম্ভবত গত ১০০ বছরেও এমন ঈদ দেখেনি বিশ্বের অনেক মুসলিম উম্মাহ।

যে বেলাতেই হোক আর যে কারণেই হোক। ঈদের আনন্দ থাকে সব বেলাতেই বা সব কালেই। শুধু বদলে যায় আনন্দ উদযাপনের ধরণ,অনুষঙ্গ বা রীতি। আর ঈদের উপহার দেয়ার যে আত্মতৃপ্তি এবং পাওয়ার যে আনন্দ  তা সব বেলাতেই  বজায় থাকে। বলা বাহুল্য ঈদে নতুন পোষাকের আনন্দ ধনী গরিব, সব দেশে সব কালেই চিরায়ত।

[wpdevart_facebook_comment curent_url="http://yourdomain.com/page-url" order_type="social" title_text="Facebook Comment" title_text_color="#000000" title_text_font_size="22" title_text_font_famely="monospace" title_text_position="left" width="100%" bg_color="#d4d4d4" animation_effect="random" count_of_comments="3" ]