মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

উৎসব ও নৈতিক দ্বন্দ্ব

সাঈদ সাহেদুল ইসলাম

২৫ জুন, ২০২৩ , ৮:৫৫ পূর্বাহ্ণ

উৎসব ও নৈতিক দ্বন্দ্ব - সাঈদ সাহেদুল ইসলাম

সুখ-দুঃখ জীবন নদীর দুটি শাখা। যাদের কাছে সুখের ঘনত্ব বেশি তাদের চলন-বলন-রীতিনীত এক রকম, আবার যাদের কাছে সুখের চেয়ে দুঃখের ঘনত্ব বেশি তাদের ঠিক একই কর্ম ভিন্ন রকম। এভাবে সুখ-দুঃখ আমাদের মাঝে ঘুরে ফিরে আসে। তাই আমরাও একেক সময় একেকটার চরিত্রে অভিনয় করি মাত্র।

আমরা অনেকভাবে অনেক উৎসব পালন করি। মুসলমানদের দুটি প্রধান উৎসব ঈদ আর হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দূর্গাপূজা। সাথে নবান্ন ও নববর্ষ- উভয়ের। আরও রয়েছে ছোটখাটো অনেক উৎসব্ আর বাকিগুলো যে যার মতো পালন করে। সবগুলো উৎসবে আনন্দ-খুশির জোয়ার বয়ে যায়। কিন্তু সে আনন্দ-খুশির স্বাদ দেহ-মনের কাছে কি এক? দেহের কাছে এক হলেও মনের কাছে যেমন নয়, তেমনি মনের মধ্যে এক রকম হলেও দেহের মধ্যে নয়। আর যদি একই রকম না হয়ে থাকে তবে এই সত্য প্রকাশের যোগ্যতা অর্জন করা আমাদের প্রয়োজন। কারণ, আমরা অনেক সময় বড় বড় উৎসবের দিন বলি- ‘আজ আমরা ধনী, গরিব, আমির, ফকির, রাজা, প্রজা সবাই সমান। এক কাতারে দাঁড়িয়ে একই স্রষ্টার কাছে ভক্তি করি, অর্চনা করি।’ সবকিছু ঠিক আছে, তবে যিনি এমনটি ভাবছেন তার অন্তর-বাহির নামের দুটি দিক আছে। তাই ভাবতে হবে দুভাবেই। নয় তো বিখ্যাত লেখক জর্জ অওয়েলের “অ্যানিমেল ফার্ম” এর মতো বক্তব্য চলে আসতে পারে ‘সকল প্রাণীই সমান’ এমনটি বিবর্তিত হয়ে যায় “সকল প্রাণীই সমান কিন্তু কিছু প্রাণী অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে একটু বেশি সমান”- কী রকম হাস্যকর ব্যাপার না?

যা হোক, মানুষের অন্তর-বাহির বিশ্লেষণে আমি আমি একটি উৎসবকে বেছে নিতে পারি। হতে পারে সেটা ঈদ অথবা দূর্গাপূজা। অথবা একটিও নয়। দুটোর মধ্যে একটি শব্দ প্রয়োজন। সাধারণভাবে শব্দটিকে ‘উৎসব’ হিসেবেই ধরে নিতে পারি। উৎসব মানে আনন্দ-খুশির অনাবিল ঝরনা। উৎসব সে তো স্বপ্নীল আকাশের শান্তির আহবান। মানুষের মহামিলনের ক্ষেত্রই উৎসব। উৎসব মানে সৌন্দর্য, কল্যাণ, পবিত্রতা, শান্তি- যতটুকু ভালোগুণ সব। উৎসব মানুষের চির ঐতিহ্যের আবহ। উৎসব নিঃসন্দেহে একটি শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে এবং ধনী, দরিদ্র, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষসহ সবাইকে একটি বৃক্ষের নিচে নিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করে। কিংবা উৎসব ধনী-দরিদ্র, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং সুবিধাবঞ্চিতসহ সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও ঐক্যের সম্পর্ক গড়ে তোলে- এ সব কেবল নীতিকথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কারণ, এ উৎসবকে বাহ্যিক বিশ্লেষণের প্রক্রিয়ায় ফেলে কোনো কিছু বা কাউকে এড়িয়ে যাওয়া খুব সহজ। যারা এমনটি করেন, তাদের মনে ‘উৎসব’ শব্দটি সীমাবদ্ধতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। কারণ আভিজাত্য আর দুঃখের ব্যবধান আলো আর আঁধারের মতো। মূলত আজ আমরা ধনী, গরিব সমান- তার মানে শুধু আজকেই সমান- আর তার পরদিন থেকে থেকে নয়?

এর ব্যাখ্যায় এবার অন্তর বিশ্লেষণে হাঁটাহাঁটি করে তাকে দৃশ্যমান করে তোলা যায়। আমরা দেখি, কারো কারো দুঃখের অশান্ত ডানায় ভর করে বস্তির ভাঙা ঘরে উৎসব আসে, যেখানে ক্ষুধাতুর শিশুর কান্না আছে কিংবা মায়ের অসুখের নিরাময় নেই, সেখানে ছেলেমেয়ের দুঃখজটে স্বর্গীয় স্মৃতিপটে শুধু ধূলি জমে যায়, সুখ কমে যায়। সাথে সাথে বেঁচে থাকার পৃথিবীতে উঁচু-নিচু নামের বিশেষণ দ্বন্দ্ব দিন দিন বেড়ে যায়। মূলত বস্তির ভাঙা ঘরের উৎসব কিছু কিছু বিপরীত সুখী মানুষের কাছে আনন্দরাঙা সুখের স্বপ্নের মতো। এভাবেও যদি উৎসব আসে তবে আভিজাত্যের রক্তে মঙ্গার অনুপস্থিতির আশঙ্কা কম থাকার কথা নয়। উৎসব যেখানে আভিজাত্যের ঘনত্বে পূজনীয় সেখানে পথের দুঃখী হাজারও সন্তানের মায়ের শাড়ির আঁচলে দুঃখ খেলা করে যা সুখীদের দৃষ্টিতে পড়ে না। অথবা প্রচণ্ড শীতে যারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রে যান্ত্রিক কিংবা গরমেও যারা এসিতে থেকে প্রাণীর মর্যাদা পেয়ে থাকেন, মন হৃদয়ের উপস্থিতি সেখানে কতটা সাধ্য বা দুঃসাধ্য অন্তর বিশ্লেষণে তা ভাববার বিষয়। আনন্দ, প্রীতি বা সুখের টানে কাগজে কলমে বা এমনিতে উৎসবের দিনে অনেকের ব্যস্ততা অনেক বেড়েও যায়। অথচ আজকের দিন শেষে নিরামিষ রক্তের মানুষের প্রতি অন্যের দয়া, আনুগত্য, প্রেম, প্রীতির দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আবার দ্ব¦ন্দ্ব বাড়ে সুখ-দুঃখের ঘনত্বের। দুঃখীদের দুঃখ দেখে দেখে নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে ছোট হলে অনাথ অসহায়দের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। মিথ্যে হয়ে যায় কাগজ-কলমের জ্ঞান।

এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে একদিন শ্রম না দিলে যাকে উপোস করতে হয়, সে উৎসবের দিনেও বেছে নেয় রোজগারের উপায়। অথচ তার উৎসবে যাওয়ার কথা ছিল, কথা ছিল সংসারি ছোঁয়া পাওয়ার। তবু না পাওয়া নিয়ে উৎসব আসে, দিন কেটে যায়। বিলীন হয়ে যায় অনেকের নীতি কথা। অসহায়দের কথা ভেবে ভেবে আজকের সময় বা শ্রম দেওয়ার মতো অত লোক কোথায়? আমরা মানুষের অধিকারের কথা বলি। কিন্তু সে অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমরা কতটুকু সচেতন? তাই উৎসবের চাঁদে যে শিশুটি কষ্টের ফাঁদে নিমজ্জিত থাকে তার চোখে অন্যের হাসির বাঁধের কী মূল্য আছে? একটি শিশু তো গোটা রাষ্ট্রের শিশুদের মাইক্রোকোজম। তার কষ্ট নিছক একক কষ্ট নয়, এ কষ্ট সকল শিশুর যারা অপ্রাপ্তির ফাঁদে পদে গুড়ের মতো মিঠা ফলের আশায় দিন কাটায়। তাই শিশু অধিকারের বাহ্যিক বিশ্লেষণ সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় ব্যাধি। দেশ-সমাজের দক্ষ কারিগর কর্তৃক লালন করা এ উপস্থাপন নিঃস্বদের প্রতি ব্যঙ্গ আর ছল-চাতুরি ছাড়া কিছুই নয়। তাই উৎসবকে ঘিরে মানুষের সুখ দুঃখের পার্থক্য নিয়ে কথা বললে একটি চিত্র পাওয়া যায়। ধরুন, সুখ- সে তা চোরাবালি- কারো মজ্জাগত নয়, সুখ আপেক্ষিক। আভিজাত্যের মগডালে যাঁরা বসে আছেন, তারা ক’জন জীবনের স্থবিরতা ও গতির পর্যবেক্ষক? রঙিন চশমার ফ্রেমে অন্যের দুঃখ-কষ্ট ভাববার বিষয়টা এত সহজ নয়। রঙিন চোখেও পীড়িতদের স্বচ্ছভাবে দেখা যায় না। অর্থের চোখে অনাথের জীবন অনাবিল মনে হলেও অসারল্যে অবলীলায় অনাথেরা দুঃখে আসীন। তাই বোধকরি, দুঃখীদের কাছে আভিজাত্যের মনটা প্রকৃতির মতো। বলা যায়, প্রকৃতির বুকে বাতাস নেই, ফ্যানের কাছে বাতাস চেয়ে কী লাভ তাদের? তাহলে কী করতে হবে? সত্য কথা বলতে হবে যে, আমরা সবাই সবাইকে সমান চোখে দেখতে পারি না অথবা সমান চোখে দেখার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। অথচ লক্ষ্য করুন, একজন তৃষ্ণার্ত ভিক্ষুক এক গ্লাস পানি পান করে যে তৃপ্তি বা সুখ পেয়ে থাকেন- একজন তৃষ্ণার্ত বিত্তবানও ঠিক একইভাবে সেই সুখ বা তৃপ্তি অনুভব করেন। এটাকে বলে অন্তরের তৃপ্তি। সুতরাং বাস্তবতা হলো লেখাপড়া না করে এক সময়ে এসে তা বুঝতে পেরে আবার যদি সেই লেখাপড়ার বয়স ফিরে পাওয়া যেতো- সংসারের জন্য আগ্রহ থেকে সংসার জীবন যাপন করার অভিজ্ঞতা অর্জনের পর আবার যদি সেই সংসারের পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া যেতো- যৌবনের পর বার্ধক্যে এসে আবার যদি সেই যৌবন ফিরে আসতো এবং সবমিলে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সে জীবনটা মৃত্যুর পর যদি পৃথিবীর জীবদ্দশায় আবার সেই জীবনে ফেরৎ যাওয়া যেতো- তাহলে কোনো বিধান প্রয়োজন হতো না মানুষের। মানুষ সত্য-মিথ্যের পার্থক্য বুঝতো, অন্যায়-পাপ পৃথিবীর বুকে থাকতো না। কিন্ত এটা অন্তত অনুধাবন কজন করতে পারেন?

সার কথা, যাঁরা দুঃখীর কষ্ট বোঝেন, তাদের অনেকের সামর্থ্য নেই, যাঁদের সামর্থ্য আছে তারা অনেকেই কষ্ট বোঝেন কি? যদি বোঝেন তো কতটুকু? মূল অঙ্কে হিসেব করেও কাজ হবে কি? হলেও বা কতটুকু হবে? তাই বলি, আসুন আমরা মানুষ হয়ে মানবিক হই। যারা শুধুই মানবিক তারা সবক্ষেত্রে মানুষ না-ও হতে পারেন- আগে মানুষ হওয়া চাই। কম কথা বলে কাজ বেশি করার মতো আনন্দ আর কোথায় থাকতে পারে? 

সাঈদ সাহেদুল ইসলাম

লেখক ও শিক্ষক, রংপুর