রংপুরের প্রসিদ্ধ গরুর হাট বলে খ্যাত লালবাগ হাট। এ শহরেই বাড়ি। সেই সূত্র ধরে লালবাগ হাট থেকে কুরবানির পশু কিনে অভ্যস্ত আমার পূর্বপুরুষগণ। সেই নীতিতে আমিও বহালতবিয়তে লালবাগমুখী।
কুরবানি ঈদ দ্বারপ্রান্তে। গরু কেনার প্রস্তুতি সম্পন্ন। ছোট ভাইকে সাথে করে নিয়ে রিকসায় চেপে হাটের দিকে রওয়ানা দেই বেলা তিনটায়। মহল্লার চিকন সড়ক পিছে ফেলে বড় রাস্তা দিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চালক তার রিকসা চালিয়ে গন্তব্যের দিকে যাচ্ছেন। রিকসা যতই এগুচ্ছে ততই চোখ আটকে যাচ্ছে গরু দেখে। রাস্তার দুই ধার দিয়ে ইয়া বড় বড় গরু, গলায় কাগজের রঙিন মালায় শোভাবর্ধন। মোটা-তাজা, উঁচু উঁচু গরু নিয়ে মোটা মোটা মানুষগুলো লুঙ্গি হাঁটুর উপরে তুলে দুলছে আর ছুটছে গরুর সাথে তাল মিলিয়ে।
‘ভাই গরু কত হলো’ বলে চিৎকার করে পাশে বসে থাকা ছোটভাই। অপরদিক থেকে জবাব আসে- ‘আটান্ন পাঁচ (আটান্ন হাজার পাঁচশত), চৌষট্টি দুই (চৌষট্টি হাজার দুইশত), এক বিশ (এক লাখ বিশ হাজার) বিয়াল্লিশ (বিয়াল্লিশ হাজার)।
রিকসা লালবাগ রেলগেট এসে থেমে যায়। ভিড়ের কারণে আর সামনের দিকে যেতে চাইছে না।
‘মামা জ্যামত আটকি না থাকি একশ গজ রাস্তা হাঁটি যাও, তাড়াতাড়ি হইবে।’
রিকসা চালকের কথায় আমল দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে পা বাড়াই গরুর হাটের দিকে। সামনে কিছুদূর এগুতেই দেখা গেলো- মূল রাস্তার দু’ধারে লাইন করে রেখেছে গরু। ক্রেতারা ভিড় করে সে গরুগুলো বিভিন্ন কসরতে দেখছে, কেউ লেজ তুলে দেখছেন, কেউ চামড়া টেনে টেনে দেখছেন, কেউ পেটে গুঁতা দিয়ে কী যেন মাপজোখ করছেন আবার কেউ কেউ গরুর মাথা উঁচু করে দাঁত দেখছেন। অনেকে বলে পরিপূর্ণ দুই দাঁত না হলে নাকি কুরবানি দেওয়া যায় না। কিছু কিছু গরু বিক্রেতা বলে থাকেন ‘দুই দাঁত না হলেও বয়স হয়েছে’ কুরবানির উপযুক্ত হয়েছে। এমন ভাসমান কথা শুনতে শুনতে ভিড় ঠেলে পা চালাই দুভাই। সিদ্ধান্ত হলো হাটের মধ্যভাগে গিয়ে গরু পছন্দ করে দরদাম করে কিনতে হবে।
অনেকদিন থেকে গরু কেনার দায়ভার থেকে মোটামুটি একটা আইডিয়া এসেছে। কোন গরু কত দাম হতে পারে। ছোটভাই ইতোমধ্যে ডানদিক থেকে তেড়ে আসা একটি গরুর নির্যাতনে ভারসাম্য হারিয়ে আমার গায়ে এসে পড়ে যাবার উপক্রম, আমি তাকে রক্ষা করার আগেই সামন থেকে আর একটি গরুর পা আমার পায়ের সাথে আলতো স্পর্শে একটি আঙ্গুলের রফাদফা করে। আহত পা সমেত চিকন-চাকন দেহটা দ্রুত ঘুরাতে না ঘুরাতেই পিছন দিক থেকে অন্য একটি গরু প্রকাশ্যে, স্বজ্ঞানে মলত্যাগ করে আমার দেহের নিম্নভাগে। মেজাজের ফালুদা করে গোবর-মুত্রে ডুবে যাওয়া পা নিয়ে সামনের দিয়ে অগ্রসর হতে না হতেই সম্মানের সহিত হিসু করে আর একবার প্রমাণ করে দিলো ‘গরুর আচরণ!’
গরুর এহেন কার্যকলাপে কিঞ্চিত অতিষ্ঠ হয়ে ছোটভাই নিজেকে রক্ষা করে গরুর দরদাম শুরু করে।
‘গরু কি দাঁতছে’ (দুই দাঁত)
‘ না ভাই দাঁত ওঠে নাই, দুই বছর বয়স, কুরবানির উপযুক্ত হইছে।’
বাড়ির পোষা গরু, তেল চর্বি কিছু নাই, খালি ঘাস খিলি গরুক মানুষ করছি।’
ছোটভাই তাচ্ছিল্য করে বলে-
‘ঘাস খাইয়ে গরুকে মানুষ করা যায় না কি?’
‘অই হইল আরকি। কতা না প্যাঁচেয়া গরু নিলে দাম করো।’
(গরু, মহিষ কুরবানীর উপযুক্ত হওয়ার জন্য দুই বছর পূর্ণ হওয়া জরুরি। বিশেষ দাঁত উঠা জরুরি নয়।
সাধারণত বিশেষ দুটি দাঁত দুই বছর পূর্ণ হলেই উঠে থাকে তাই দুই দাঁত উঠাকে দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আলামত মনে করা হয়। এ কারণেই মানুষ কুরবানীর পশু কিনতে গেলে তা পরীক্ষা করে। এতে দোষের কিছু নেই।
অবশ্য যদি কোনো গরুর ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, দুই বছর পূর্ণ হয়ে গেছে কিন্তু বিশেষ দুটি দাঁত এখনো উঠেনি তাহলে সেই গরু দ্বারা কুরবানী হয়ে যাবে।
-মুসলিম শরীফ ২/১৫৫; ফাতাওয়ায়ে খানিয়া ৩/৩৪৮; ইমদাদুল ফাতাওয়া ৩/৬১১৷ মুফতী মেরাজ তাহসীন মুফতীঃ জামিয়া দারুল উলুম দেবগ্রাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
বাজেটের বাইরে দাম চাইছে বলে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে সে, আমি হাঁটি পিছে পিছে। ছোটদের জন্য আসন ছেড়ে দিতে হয় সেই খেয়ালে। অল্প একটু এগিয়ে আবার কালো একটা গরুর সামনে দাঁড়ায়, সামন-পিছন দেখে নেয়। কী দেখল, ঠিক ঠাহর করতে পারিনি।
‘ভাই কয় দাঁত।’
‘চাইর দাঁত, একেবারে উপযুক্ত। নিলে নেও, কম দামোত দিয়া চলি যাইম। সেই এগারোটা থাকি খাড়া হয়া থাকতে থাকতে ন্যাসপ্যাসা হয়া গেনু।’
আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে শুনছি দুজনের কথোপকথন। ছোটভাই দাম জানতে চাইলে গরু বিক্রেতা বলে-
‘তোমরা গরুটা নিলে বাষট্টি হাজার দেমেন।
সাড়ে তিন মন পার হয়া যাইবে।’ একেবারে দেশি বাঞ্জি গরু। তিন বছর থাকি বাচ্ছা দেয় না, সেই জন্তে বেচা।’
বাঞ্জি গরুর কথা শুনে এই প্রথম চোখ কপালে উঠে যায় ছোট ভাইয়ের। আমি বুঝতে পেরেও কিছু বলিনি, দেখি কি করে।
এবার আমার দিকে মুখ করে বলে-
‘গরু যে বাঞ্জি তা এতক্ষণ পরে বল্লো?’
আমি মুচকি হেসে বলি-
‘ গরু বিক্রেতা হয়তো জেনেছে যে, তুই বাঞ্জি গরু চিনেই দরদাম করছিস।’
‘ও’
ছোটভাইয়ের উত্তর নাই। আবার পা চালাতে উদ্যত। গরুর মালিক হাঁক ছাড়ে-
‘কি হইল ভাইজান গরুটার দাম কইনেন না যে।’
‘না ভাই, বাঞ্জি গরু কিনবো না’
বলার সাথে সাথে উত্তর –
‘বাঞ্জি কিনবার ন্যান ফির বাঞ্জি দাম করেন ক্যান।’
‘ভাই ও বুঝতে পারে নাই। বলে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমিও পা চালাই ছোট ভাইকে অনুসরণ করে।
এবার মাঝারি এক এঁড়ে গরুর সামনে দাঁটিয়ে বলছে-
‘এটাও বাঞ্জি গরু নাকি?’
‘না এটা ঠিক আছে। ‘
গরুটা মাঝারি হলেও শারীরিক গঠন বেশ ভালো দুই দাঁত, ছোট সিং, গায়ের রং কালো। কালো রঙের গরু সাধারণত সবাই পছন্দ করে, দেখতেও বেশ ভালো। তবে দাম একটুবেশি হয়।
গরুর দড়ি হাতে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী লোকটা পান খেতে খেতে তরমুজ বিচি সম্বলিত দাঁতে ফিক করে হাসি দিয়ে জানতে চাইলো-
‘ভাইজান গরু নিমেন। গরু একেবারে বাপেরবেটা, দুইজনেও সামলা মুশকিল আছে। সকালে খিলিয়া আনচি, আর খায় নাই, দ্যাকচেন না খাবার না প্যায়া এক দিনোতে শুকি কাঠ হয়া গেইছে। নিলে কন, কমবেশি করি দিয়া চলি যাইম। আর খাড়ায়া থাকবার মোনায়চোল না।’
বলেই আমাদের আকৃষ্ট করতে হাতে থাকা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গরুর পিঠে দু’ঘা মেরে গরুকে বিগড়ে দিলো। গরুটা হিঁ হিঁ করে ঘোড়ার মতো লাফ দিয়ে ওঠে। আমরাও ভয়ে তিন হাত পিছিয়ে যাই। সেই সাথে পাশে থাকা অন্য গরুগুলোও নাড়া দেয়।
‘ভাইজান গরুটা কিন্তু খুব ভালো জাতের’।এমন আরো অনেক ডায়লগ শুনে শুনে মনে হলো গরুর মূল মালিক সে নয়। হয় দালাল নয়তো দিন হাজিরায় মালিকের গরু বিক্রি করে দিচ্ছে। গরু আমাদেরও পছন্দ হয়েছে। দরদাম চলছে। বিভিন্ন ভঙ্গি কাজে লাগিয়ে দাম চাচ্ছে, ছোটভাই আকাশ-পাতাল দাম শুনে কিছুটা বিরক্ত বোধ করছে, সেটা আমার বুঝতে বাকি রইল না। দরদামে বনিবনা না হলে গরু ছেড়ে এক পা এগুতেই এক পর্যায় পিছন থেকে একজনের আবির্ভাব হলো। বয়স্ক মোটা লোক, ভুঁড়িওয়ালা, পড়নে লুঙ্গি, গায়ে সবুজ রঙের বাবাশার্ট, কাধে গামছা। তিনিও চপচপ করে পান চিবুচ্ছেন। একেবারে আমার গা ঘেঁষে আস্তে করে বললেন-
‘বাবাজি গরু পছন্দ হইছে’
আবাক হলাম না। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতেও বাকি নাই যে তিনিই গরুর মালিক। গরুর দড়ি ধরে থাকা লোকটির কাছে জানতে চায়-
‘কতো কচিস’
তাদের দুজনের কথোপকথন চলে তাদের নিজস্ব ভাষায়। গরু বিক্রেতা এবং গোস্ত ব্যবসায়ীদের নিজস্ব ভাষা আছে। যে ভাষা সাধারণের সামনে প্রয়োগ হবে কিন্তু সাধারন মানুষ তা বুঝবে না।
‘গরু তো দেখলাম, দামে তো হচ্ছে না।’
আমার সরল জবাব।
‘বাবারে আল্লাহর রাহে কুরবানি দিমেন, এতো দামাদামি করলে হইবে? আল্লাহ্ যদি তোমার কুরবানি কবুল করেন তাইলে তো সোনায় সোয়াগা।
‘আমি দাম বলেছি, দেখেন দেয়া যায় কি না।’
আরে বাবা, গরু কি হামরা বাড়িত নিয়া যায়া খামো। ব্যাচপার আনচি ব্যাচে যামো।
আচ্ছা উগলা কতা বাদ দিয়া তোমরা আর পাঁচটা হাজার বাড়ে দিয়া নিয়া যাও।
ভেবে দেখলাম একটু কমবেশি করে এই গরুই নেওয়া যায়। ছোটভায়ের সাথে আলোচনা বলে আরো দুই হাজার টাকা বাড়িয়ে কেনা হলো কুরবানির জন্য গরু। টাকা পরিশোধ করে হাটের রশিদ দিলেন ইজারাদারের সরকার। তবে গরুর মালিকের কাছে আমার আব্দার হলো, হাটের বাইরে গরুটি দিয়ে আসতে হবে।
কাজ হলো, কিন্তু বিনিময়ে চা খাওয়ার জন্য তাদের ছেলেটাকে কিছু দিতে হবে।
রাজি হলাম।
আবার সেই ভিড় ঠেলে বের হতে হচ্ছে। কাদা পানি মাড়িয়ে লালবাগ রেললাইন পর্যন্ত এসে আমাদের হাতে গরুর দড়ি তুলে দিয়ে বিদায় নিলেন।
গরুর দড়ি ধরেছি আমি, ছোটভাই পিছন পিছনে। ফিরছিলাম বাসার দিকে। বেশ ভালই লাগছিল। রাস্তার দুদিকে অলস মানুষগুলো উতসুক হয়ে আমার কাছে শুনতে চায়- ভাই গরু কত হলো/ ভাই গরুর দাম কত/ বাহ ভালই হয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বেশ ভালই লাগছিল, মানে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে হাঁটছিলাম গরু নিয়ে। কিন্তু কিছুদূর এসে গরু নিজেই় বাধ সাধল, সে আর যাবে না। জোড় করে নিয়ে যেতে চেষ্টা কিরছি, দড়ি ধরে টানছি কাজ হয় না। ছোটভাই কোত্থেকে একটা বাঁশের কঞ্চি এনে পিঠে ঠাস ঠস করে বসায় কয়েক ঘা।
নাহ, কিচ্ছু হচ্ছে না। গরু আমাদের বাসায় যাবে না, আবার হাটের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। আমি টানি আমার বাসার দিকে আর আমার কেনা গরু আবার ফিরে যাবে তার মুনিবের কাছে। এই দড়ি টানাটানির একপর্যায় রাস্তার পাশে অবস্থান নেয়- শুয়ে পড়ে- অনশন করে। আমি নির্বাক। তার মালিককে তো আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, তিনি কড়কড়ে নোট কোমরে গুঁজে বিদায় নিয়েছেন অনেক আগেই। ভাবছি কি করলে গরুকে বশে আনা যায়, সাথে থাকা ছোট ভাইয়ের সাথে কথা হলো, গরু যেদিকে সহজে যাবে সেদিকে নিয়ে যাবো, তবুও তার কঠিন অবস্থান সে যেন তুলে নেয়। যেই কথা সেই কাজ। গরু বাবাজি সোজা লালবাগ হাটের দিকে হাঁটছে, আমরা হাঁটছি তার পিছে পিছে। একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট। গরুই আমাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অজানা পথে। ইস এভাবে যদি আমাদের বাড়ির পথে হাঁটতো! কত ভালোই না হতো।
লালবাগ হাটের কাছে গিয়ে থেমে যায় গরু। সম্ভবত দিক হারিয়েছে। আবার চেষ্টা করি ফিরতি পথে ফেরাতে। বিফল। পাশে খেয়াল করে দেখি ছোটভাই নেই। কিছুটা হতাশা কাজ করতে শুরু করেছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, হাট ভাঙ্গার একটা আবহ তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে। আরো বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ছোটভাই কোত্থেকে যেন এসে আমার হাতে একটি পলিথিন ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললো-
‘ব্যবস্থা হয়ে গেছে, আর সমস্যা নেই।’
আমি অবাক হই। ব্যাগের ভিতর আবার কি ব্যবস্থা হলো।
‘ব্যাগে কি আছ, আর কিসের ব্যবস্থা হলো?’
ব্যগে গুড়ের জিলাপি। গুড়ের জিলাপি লান্সকে পরিস্কার করে। বাসায় ছোট বড় সবাই খাবে। একেবারে গরম গরম জিলাপি। আর, একটা গাড়ি ভাড়া করলাম। গাড়িতে গরু নিয়ে যেতে হবে।’ নচেৎ…
গাড়িতে গরু তুলে গাড়ি ছেড়ে দেয় দুই কিলোমিটার দূরত্বের পথ কামারপাড়ার মুখে। এখন আর কেউ জানতে চাইছে না- ‘গরুর দাম কতো, বেশ ভালই হয়েছে’র মতো বাক্য।
অবশেষে গাড়ি চলছে। চলতে চলতে একবার মনে হলো, নগরীর পিচঢালা সড়কে গরুর গাড়িতে যেতে ভালোই লাগছে।