ইংরেজ কবি জন মিল্টন বলেছিলেন, ” সব যুদ্ধের সূচনা খুঁজে পাওয়া যাবে সংঘাতের প্রথম ঘটনায় নয় বরং তার প্রস্তুতি ও অভিমতসমূহে।” আর তাই আজকের নির্ঘুম রাতের অধ্যায়ন আর তার প্রকাশের প্রয়াস।
১৮৯৭ সালে বাসলে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জায়নবাদ(ইহুদিবাদ) সম্মেলন যাতে থিওডোর হার্ডল ঘোষণা করেন যে, “জায়নবাদের লক্ষ্য হচ্ছে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের একটি জাতীয় আবাস প্রতিষ্ঠা”। হার্জল পরিকল্পনা অনুসারে প্যালেস্টাইনে বসতি স্থাপন করবে প্রথম “সবচেয়ে বেপরোয়াগণ, তারপর গরিবেরা, এরপর স্বচ্ছল ব্যক্তিরা এবং সবশেষে ধনীদল। অভিন্ন স্বার্থে চাঁদা হিসেবে দিতে হবে একটি স্বর্ণমুদ্রা-শেকেল।” যারা বাসল কর্মসূচী মেনে দান করেছিলেন শেকেল তাদেরকে গণ্য করা হতো জায়নবাদীরূপে।
গঠিত তহবিল দ্বারা প্যালেস্টাইনে জমি কেনার কাজ চলছিল। বোমা তৈরিতে ব্যবহারযোগ্য এসিটোন উৎপাদনের ফর্মূলা উদ্ভাবন করলেন জায়নবাদী আন্দোলনের নেতা শাইম ওয়েজমান।১৯১৬ সাল থেকে ১৯২২সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লয়েড জর্জ যিনি এই সহায়তার বিনিময়ে ইহুদি আবাসভূমির পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেন। তখন আর্থার জেমস বালফোর ছিলেন foreign secretary এবং তিনি যুক্তরাজ্যের অন্যতম ধনী রথচাইল্ড পরিবারের সন্তান ও জায়নবাদীদের অন্যতম প্রধান নেতা ব্যাংকার রাজনীতিবিদ লিওনেল আর্থার রথচাইল্ড কে ইহুদি আবাসভূমির লক্ষ্য অর্জনে যথাসাধ্য প্রয়াস গ্রহণে রাজকীয় সরকারের আগ্রহ প্রকাশ করে পত্র প্রেরণ করেন ১৯১৭ সালের ২রা ডিসেম্বর যা বালফোর ঘোষণা হিসেবে বৃটেনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি হিসেবে পরিগণিত হয়। এরপরই ফ্রান্স, ১৯১৮সালে ইটালি ও আমেরিকা, এরপর গ্রীস ও জাপান এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। বালফোর ঘোষণায় ইহুদিদের জাতীয় আবাসের কথা থাকলেও পৃথক রাষ্ট্রের কথা ছিল না এবং সেখানে অ-ইহুদি প্যালেস্টাইনীদের অধিকার খর্ব না করার কথা লিখিত ছিল। ইতিহাসে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করে আসছিল প্যালেস্টাইনী আরবরা। বিশ শতকের শুরুতে নেয়া জরিপে দেখা যায়, প্যালেস্টাইন ভূমির জনগণের অনধিক ১০শতাংশ ইহুদি, ১০শতাংশ খ্রিষ্টান এবং ৮০ শতাংশ মুসলমান, তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির দীর্ঘ ঐতিহ্য। অটোমান শাসক ও বৃটিশ ঔপনিবেশিকদের অধীনে আরব ও ইহুদিরা শান্তিতে পাশাপাশি বসবাস করে আসছিল। এমনকি হিটলারের ফ্যাসিস্ট শাসনকালসহ ইউরোপে ইহুদি বিরোধিতার প্রকাশ বারবার ঘটলেও প্রাচ্যে তেমন কোন ইহুদি নির্যাতনের ঘটনা লক্ষিত হয়নি। বৃটিশ শাসনে ভূমি আইনের সংশোধনী, নীতিমালা এবং জমি কেনার পাশাপাশি চলছিল বল ও ভীতি প্রয়োগে আরবদের উৎখাত। এমনকি ৩.৫ শতাংশ জমি বৃটিশ সরকার সরাসরি জায়নবাদী সংস্থাকে হস্তান্তর করেছিল। ফলে বারবার ঘটছিল বিদ্রোহ এবং ১৯৩৬ সালে সাধারণ অভ্যুত্থান। প্যালেস্টাইনী আরবরা বুঝে গিয়েছিল তাদের দেশের বুকে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে এবং তাদের দাবি ছিল একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা যেখানে আরব ও ইহুদিরা একই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পাশাপাশি বাস করবে। সঙ্গতভাবেই দাবি করা হয়েছিল দেশান্তর প্রক্রিয়ার অবসান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে বৃটেন জাতিসংঘের কাছে প্যালেস্টাইন সমস্যা ন্যস্ত করে এবং বিশেষ কমিটির রিপোর্ট ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নেয় যে, প্যালেস্টাইনকে দুই ভাগে ভাগ করা হবে। আরব অংশে থাকবে ১১১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা(দেশের ৪২শতাংশ)। ইহুদি রাষ্ট্রে থাকবে ১৪১০০ বর্গ কিলোমিটার (দেশের ৫৬শতাংশ)। জেরুজালেম, বেথেলহাম ও সংশ্লিষ্ট এলাকা থাকবে আন্তর্জাতিক তদারকিতে। হিসেব অনুযায়ী আরব অংশে থাকবে ৭,২৫,০০০ আরব ও ১০,০০০ ইহুদি এবং ইহুদি অংশে থাকবে ৪,৯৮,০০০ ইহুদি ও ৪,০৭,০০০ আরব। অথচ ১৯৪৭ সালে ক্রমাগত ইহুদি আগমণের পরও প্যালেস্টাইনী জনগণের ৬৭ শতাংশ ছিল আরব এবং তারা আবাদযোগ্য জমির ৯৩ শতাংশের মালিক ছিল। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে বৃটিশ ম্যান্ডেটের অবসান ঘটে ও জাতিসংঘের উপর প্যালেস্টাইনের দায়িত্ব অর্পিত হয় তবে ইহুদিরা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে শুরু হয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। পশ্চিমা স্বার্থের বাহক হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৪৯ সালের ১১ মে ইজরায়েলকে নির্দিষ্ট সীমারেখা না থাকা সত্ত্বেও সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে অথচ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাধারণ নীতি অনুযায়ী চিহ্নিত সীমানা ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পশ্চিমা শক্তির সক্রিয় সহযোগিতায় ইজরায়েল প্যালেস্টাইনের তিন চতুর্থাংশ এলাকা দখল করে নেয় এবং মধ্যযুগীয় রাজশাসকদের নেতৃত্বাধীন ইসলামী বিশ্ব কার্যকর কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫৩ সময়কালে ৭,৪০,০০০ ইহুদি দেশত্যাগী আশ্রয় নেয় প্যালেস্টাইনে, স্থাপিত হয় ৩৭০ টি নতুন বসতি। জাফা, হাইফা, রামাল্লা ও অন্যান্য ১২টি আরব শহর এবং সাত শতাধিক আরব গ্রাম বাজেয়াপ্ত করা হয়। ইহুদি তৎপরতায় উদ্বাস্তু হয় ২,৫০,০০০ প্যালেস্টাইনী। সমস্যার ব্যাপ্তি ও তীব্রতায় জাতিসংঘ ইজরায়েলকে উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা নিতে এবং ক্ষতিপূরণ দিতে আহ্বান জানালেও ইজরায়েল শুধু এক লক্ষ উদ্বাস্তুকে গ্রহণ করতে এবং বাকিদের স্থায়ীভাবে প্যালেস্টাইনের বাইরে অবস্থান করার শর্তে ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। ১৯৫০ সালের জুন মাসের মধ্যে জাতিসংঘের সহায়তাপ্রাপ্ত মরুতে তাঁবু খাটিয়ে বসবাসরত উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯,৬০,০০০।
১৯৬৭ সালে ইজরায়েল অতর্কিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে মিশর ও সিরিয়ার উপর। সাতদিনের যুদ্ধে দখল করে নেয় পুরনো জেরুজালেম, জর্ডান নদীর তীর, গাজা, সিনাই ও সিরিয়ার গোলান উচ্চভূমি। এরপর থেকে দখলকৃত এলাকায় দ্রুত গড়ে তোলা হয় ইহুদি বসতি। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের হিসাবে দেখা যায়, ১৩,৮৫,০০০ আরবের বিপরীতে ইহুদিদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩,৬৫,০০০। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর প্রতি বছরে প্যালেস্টাইনী উদ্বাস্তুর সংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫,০০০। জাতিসংঘ যে ইজরায়েলের জন্য বরাদ্দ করেছিল ১৪,৬০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা সেখানে তৎকালীন ইজরায়েলের মোট আয়তন দাঁড়ায় ৮৮,০০০ বর্গ কিলোমিটার। যাইহোক, বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে ও কৌশলগত কারণে মিশর, সিরিয়া, জর্ডান, লেবাননের দখলকৃত ভূমি ছেড়ে এখনো তাদের আয়তন ২২,০৭২ বর্গ কিলোমিটার। ইজরায়েল ইতোমধ্যে তেলআবিবের পরিবর্তে জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী ঘোষণা করেছে। মুসলিম অধ্যুষিত ৩১টি দেশ ইজরায়েলকে স্বীকৃতি না দিলেও মিশর, জর্ডান ইতোমধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং শান্তিচুক্তি করেছে। ১৭ লক্ষ আরব জাতিভুক্ত (যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান) এখন ইজরায়েলের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বাস করছে। কোন প্যালেস্টাইনী কৃষক হয়তো এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলো তার বসতবাড়ি ও আবাদি জমির মাঝখানে চলে গেছে কাঁটাতারের বেড়া। অর্থাৎ তার জমি নিরাপত্তাজনিত কারণে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা আইনের আশ্রয় লাভের উপায় নেই। এভাবে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে অধিকৃত এলাকার এক তৃতীয়াংশ জমি। প্রায় প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজন কারাগারে। গুপ্তহত্যা, অপহরণ, বোমাবাজি, নির্যাতন প্রভৃতি নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সামরিক আদেশে কোনো জাতীয়তাবাদী গান গাওয়া বা প্যালেস্টাইনী পতাকার রং প্রদর্শন দন্ডনীয় অপরাধ গণ্য করা হয়েছে। জাতিসংঘ স্বীকৃত শরণার্থী শিবিরেই ৩০ লক্ষ ৪৫ হাজার ৯৪৮ জন উদ্বাস্তু রয়েছে। এছাড়া লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন এলাকাজুড়ে। ভূমধ্যসাগরের কূলঘেঁষা ছোট এ আরব ভূখণ্ডের ছোট জাতির উপর অন্যায় অবিচারের এটি হচ্ছে এক সংক্ষিপ্ত বিবরণী। আর এ অন্যায়ের বিরুদ্ধেই দীর্ঘদিন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে প্যালেস্টাইন মুক্তি আন্দোলন।
১। হৃদয়ে আমার প্যালেস্টাইন: মফিদুল হক; বাংলাদেশ আফ্রো-এশীয় লেখক ইউনিয়ন
২। প্যালেস্টাইনী সমস্যা সম্পর্কে বিশটি মৌল সত্য: ডাঃ ফায়েজ এ সায়েম
৩। উইকিপিডিয়া
মোঃ কুদরাত-ই-খোদা
জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার
(সিনিয়র সহকারী জজ)
কুড়িগ্রাম।