রানা মাসুদ
১৩ মে, ২০২১ , ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ ; 493 Views
রংপুর শহরের উপকন্ঠে ঐতিহাসিক নিসবেতগঞ্জ মোড়। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রংপুরের রংপুরের বীর জনতা ক্যান্টনমেন্ট দখলের যে অভিযান চালিয়েছিলেন সেই গৌরব ও শোকের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতিসৌধ ‘ রক্তগৌরব'( এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য পাবেন আমার ‘ ‘৭১এর উত্তাল মার্চ: রংপুরের দিনগুলো’তে)। এর ঠিক উল্টো অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে রাস্তা ছাড়িয়ে একটু সামনে বাঁধ ও উঁচু-নিচু মাটির ঢিবিতে বছরের মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ে কালো পলিথিনে ছাওয়া অনেকটা নৌকার ছইয়ের আদলে বেশকিছু ঝুপড়ি। ওসব ঝুপড়িতে মানুষ থাকে। মানুষ। আমাদের মতোই মানুষ তারা। শীত,গ্রীষ্ম,বর্ষা কি শরতে ওদের ওখানেই থাকতে হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম নদী ভাঙনের শিকার কিংবা নিরাশ্রয়ী মানুষের অস্থায়ী আশ্রয়। কিন্তু ওই পথ দিয়ে যাবার সময় ওদের দেখে কৌতূহল মেটাতে এগিয়ে গেলাম। জানতে পারলাম ওরা বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন। পরিবার পরিজন নিয়ে আছেন । এই দলটা এসেছে মাস দেড়েক আগে। এদের কথা জানার আগে জেনে নেই এই সম্প্রদায় সম্পর্কে।(১)
‘সাধারণভাবে বেদেরা বাদিয়া বা বাইদ্যা নামে পরিচিত একটি ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠী। কথিত আছে যে, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে শরণার্থী আরাকানরাজ বল্লাল রাজার সাথে এরা ঢাকায় আসে। পরবর্তীকালে তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। এরা প্রথমে বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে এবং পরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও তারা ছড়িয়ে পড়ে। বেদের আদি নাম মনতং। বেদে নামটি অবজ্ঞাসূচক বাইদ্যা (হাতুড়ে ডাক্তার), পরিমার্জিত ‘বৈদ্য’ (চিকিৎসক) থেকে উদ্ভূত। অধিকাংশ বেদেই চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত বলে মনতংরা কালক্রমে বেদে নামে অভিহিত হয়। বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী (Mon-tong) গোত্রের দেশত্যাগী অংশ। তাই এরা নিজেদের মনতং বলে পরিচয় দিতে বেশি আগ্রহী। যুদ্ধ ও শিকারে অতিশয় দক্ষ বেদেরা কষ্টসহিষ্ণু ও সাহসী। এদের গাত্রবর্ণ ও আকৃতি বাঙালিদের মতোই।'(২)
গবেষক জেমস ওয়াইজ মনে করেন, ‘সংস্কৃত ব্যাধ (শিকারী ) শব্দ থেকে বেদে শব্দটি এসেছে। অপরদিকে ডব্লিউ, ডব্লিউ হান্টার বেদেদের একটি ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ি সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বেদেদের সাথে ইউরোপের জিপসীদেরও তুলনা করেছেন।’ (৩)
বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ ।সমাজসেবা অধিদফতরের জরিপমতে ‘বাংলাদেশে প্রায় ১৩,২৯,১৩৫ জন অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং ৭৫,৭০২ জন বেদে জনগোষ্ঠী রয়েছে। যাযাবর জনগোষ্ঠী বেদে সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। বেদে জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯৯ ভাগ মুসলিম এবং শতকরা ৯০ ভাগ নিরক্ষর। ৮টি গোত্রে বিভক্ত বেদে জনগোষ্ঠীর মধ্যে মালবেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, সান্দার, টোলা, মিরশিকারী, বরিয়াল সান্দা ও গাইন বেদে ইত্যাদি। এদের প্রধান পেশা হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসা, তাবিজ-কবজ বিক্রি, সাপের দংশনের চিকিৎসা, সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানো, সাপ বিক্রি, আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য সেবা, শিংগা লাগানো, ভেষজ ঔষধ বিক্রি, কবিরাজি, বানর খেলা, যাদু দেখানো প্রভৃতি।'(৪) ‘এরা জমিতে কাজ করাকে অমর্যাদার কাজ বলে মনে করে।
সহজ-সরল জীবনযাপনকারী বেদেরা খুবই সৎ প্রকৃতির। অপরাধ করে গুরুতর শাস্তির ভয় থাকলেও সর্দারের কাছে তারা অপরাধ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয় না। এদের জীবন ধারণের মান অত্যন্ত নিম্ন ও অপরিচ্ছন্ন। এদের খাদ্য তালিকায় বাছবিচার নেই। বিভিন্ন ধরনের মাদকেও এরা আসক্ত। বাঙালি মুসলমানদের সাথে এদের সামাজিক সম্পর্ক খুব কম।
মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তারা হিন্দু দেবদেবীর প্রশস্তি রচনা করে, বিশেষত রাম-লক্ষ্মণ-বিক্রমাদিত্যের গুণকীর্তন করে।'(৫)
সাধারণত বেদে পুরুষরা লুঙ্গি পরে। মহিলারা দশহাত কাপড় দুই টুকরা করে এক টুকরা কোমরের নিচে দুপ্যাঁচ দিয়ে পরে, অন্য টুকরা গলায় ওড়নার মতো ঝুলিয়ে রাখে এবং গায়ে দেয় ফতুয়া অর্থাৎ আঙ্গি। এ ছিল তাদের আদি বা ঐতিহ্যের । কিন্তু বর্তমানে অনেক বেদে নারী ও পুরুষ বাঙালিদের মতো পোশাক পরছে। এখানেও এমন চিত্র দেখা গেল। মূলত ক্রয় ও তৈরির সহজলভ্যতার জন্য এরকমটি হয়েছে বলে তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল।
”খা খা খা বক্ষিলারে খা,
ঠকবাজরে খা,
খেলা দেইখা যে পয়সা না দেয় তারে খা,
কাঁচা ধইরা খা…!’
গ্রাম-গঞ্জের খোলার মাঠ কিংবা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান গেয়ে, এভাবে নানা বাক্যধ্বনিতে সাপের খেলা দেখিয়ে ঘুরে বেড়ান বেদেরা। গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটলে এখনো কানে ভেসে আসে ‘এই সিঙ্গা…, সিঙ্গা… লাগাই…., দাঁতের পোক ফালাই….’ বেদেনীদের এসব জোরালো আবেদন মানুষের মনে নাড়া দেয় ব্যাপকভাবে।
এই বেদে সম্প্রদায় এদেশের প্রান্তিক পর্যায়ের এমন একটি জনগোষ্ঠী যাদের জীবনযাপন, আচার-আচরণ দেশের মূলধারার সংস্কৃতি থেকে একেবারেই আলাদা। বেদেরা যাযাবর শ্রেণীর মানুষ। এরা নদী-নালার আশপাশের সমতল ভূমিতে মাচা তৈরি করে দলবদ্ধভাবে বাস করে। তাদের কেউ কেউ আবার নৌকাতেও বাস করে।’ (৬)
‘বেদেরা কৌমসমাজের রীতিনীতি মেনে চলে ও দলবদ্ধ হয়ে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে বেদেরা পিতৃপ্রধান সমাজ হলেও মেয়েরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেদে ছেলেরা অলস প্রকৃতির। সব রকমের কঠোর পরিশ্রম মেয়েরাই করে থাকে। বেদেরা সাধারণত সমতল ভূমিতে নদী-নালার আশপাশে দলবদ্ধভাবে মাচা তৈরি করে অথবা নৌকায় বাস করে। তাই নৌকা এদের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। বছরের অধিকাংশ সময় বিশেষ করে ফসল তোলার মৌসুমে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এরা বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে পরিভ্রমণ করে। এই পরিভ্রমণকে বেদেদের ভাষায় গাওয়াল বলে। মহিলারাই বেশি গাওয়ালে যায়। তাদের সাথে থাকে সাপের ঝাঁপি বা ঔষধের ঝুলি। এরা সপরিবারে গাওয়ালে যায় শীতের শুরুতে অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে ও আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়ার্ধে।
প্রথম দফায় চৈত্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ও দ্বিতীয় দফায় আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এরা গাওয়াল করে। গাওয়ালের সময় এরা স্থানীয়ভাবে মূলত নৌকা, তাঁবু বা কোন স্কুল ঘরের বারান্দায় সপরিবারে থাকে। গাওয়াল শেষে দলবদ্ধভাবে আবার স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে আসে। গাওয়ালে এরা হেঁটে যায় কিংবা নৌকা ব্যবহার করে।'(৭)
‘বহরের বা দলের দলপতি সর্দার নামে পরিচিত। নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার সকল দায়িত্ব সর্দারের। সর্দার নিয়মভঙ্গকারীকে শাস্তি দেন। শাস্তি হিসেবে জরিমানা আদায় করা হয়। আদায়কৃত অর্থে বহরের লোকদের খাওয়ানো হয়। সর্দারের ভরণপোষণের দায়িত্ব বহরের।
এছাড়া আছে উপগোত্রীয় ও গোত্রীয় সর্দার। বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পূর্বনির্ধারিত স্থানে বহরের সর্দাররা মিলিত হয়ে উপগোত্রীয় ও গোত্রীয় সর্দার নির্বাচন করেন।এদের জীবন ধারণের মান অত্যন্ত নিম্ন ও অপরিচ্ছন্ন। এদের খাদ্য তালিকায় বাছবিচার নেই। বিভিন্ন ধরনের মাদকেও এদের অনেকেই আসক্ত। বাঙালি মুসলমানদের সাথে এদের সামাজিক সম্পর্ক খুবই কম।
এদের সার্বজনীন পেশা হলো চিকিৎসা ব্যবসা ও ওষুধ বিক্রয়। নানারকমের বুনো লতাপাতা আর শেকড়বাকড় এরা ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করে।
বেদেদের নিজস্ব ভাষা আছে। এই ভাষার নাম ঠেট বা ঠের। স্বগোত্রীয়দের সাথে কথা বলার সময় এরা এই ভাষা ব্যবহার করে থাকে। তবে বাংলা-ভাষাভাষীর সাথে এরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। উল্লেখ্য, এই ঠেট ভাষার সাথে আরাকানিদের ভাষার প্রভূত মিল আছে।'(৯)
‘বাংলাদেশের বেদেরা এদেশেরই নাগরিক। ভোটাধিকারসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা তাদের প্রাপ্য বলে তারা মনে করে। পরস্পরকে পছন্দ ও অভিভাবকের সম্মতিতে বিয়ে করে। বিয়ের ব্যাপারে যুবক-যুবতীর পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে।’ (১০) তবে অনেক বেদে পুরুষ ও নারী তাদের ঐতিহ্য ছেড়ে দেশের মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গেছে। তারা ভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়ে জীবন জীবিকা চালাচ্ছে। এমনকি বিয়ে- শাদি করে এরা এদের আদি পরিচয় থেকে অনেক দূরে সরে গেছে বলে বিভিন্ন নিবন্ধে জানা গেল।
কথা বলে জানতে পারি নিসবেতগঞ্জের এই বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন এসেছে ঢাকার সাভার থেকে। পঁচিশ ঘর (এদের এক ঘর এক পরিবার ধরা হয়) বেদে এসেছে আজ থেকে প্রায় মাস দেড়েক আগে । কতদিন থাকবে কেউ বলতে পারছে না। একজন জানালেন সর্দার যখন বলবেন তখন তারা চলে যাবে। কোথায় যাবেন এটাও সর্দারের ওপর নির্ভর। তবে কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, এই দলটা এসেছে সাভার থেকে।’ঢাকার অদূরে সাভারের অমরপুর নামক একটি স্থান। সেখানকার কয়েক বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বেদেরা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। আনুমানিক প্রায় দুইশ’ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় তারা সেখানে বসবাস করে আসছে।'(১১)
নিসবেতগঞ্জের এই অস্থায়ী বেদে পল্লী ঘুরে দেখা গেল তাদের প্রান্তিক জীবনযাত্রা। নৌকার ছইয়ের আদলে বাঁশের কঞ্চি ভাজ করে তিন-চার ফুট উচ্চতার আধা বৃত্তাকার একেকটি আশ্রয়। তাদের ভাষায় ঘর। প্রতিটি ঘরে নারী, পুরুষ ও শিশুদের গাদাগাদি করে এক অমানবিক বসবাস। সূর্যটা তখন পশ্চিমে ঘাঘটের জল ছেয়ে গাছ গাছালির আড়ালে চলে গেছে। মুখে আনন্দ নিয়েই অনাগত অন্ধকার ভবিষ্যতকে তুচ্ছ করেই খেলাধুলা করছে বেদে শিশুর দল। বেদে রমণীরা যার যার ঝুপড়ির সামনে রাতের রান্না নিয়ে ব্যস্ত। একজনকে দেখলাম হাঁস ছিলতে। আরেকজনের চুলার হাঁড়ি থেকে মাংস কষানোর গন্ধ আসছে। বুঝলাম ওদের রসনা বিলাস বেশ ভালো। দিনটি শুক্রবার থাকায় মনে হলো সপ্তাহান্তে ভালো কিছু খাবার আয়োজন। পুরুষদের কাউকে সন্তান কোলে নিয়ে থাকতে, কাউকে রান্নার খড়ি বা লাকড়ি কাটতে দেখলাম। ঝাপড়াগুলোর হাল দেখে থমকে যেতে হয়। বউ, বাচ্চা নিয়ে ওখানে মানুষ কীভাবে থাকে ভাবতেই মনটা আর্দ্র হয়। ঝুপড়ির ভেতর ও বাইরে ছোট ছোট কাঠের বাক্স। সাপ আছে সেসবে। বাইরে আরও কিছু খাঁচা। জানতে পারলাম সেসবে মুরগী পালন করে তারা। মজার ব্যাপার ঝুপড়ির বাইরে ছোট ছোট সোলার ডিভাইস। নিজেদের জন্য লাইট কিংবা ফ্যানের সুবিধার জন্য না। এসব সোলার সিস্টেম ব্যবহার করা হয় তাদের মোবাইলে চার্জ দিতে। #
(১) সরেজমিন
(২) জনাব জয়নাল আবেদিন খান, বাংলাপিডিয়া
(৩) মাহামুদস পেজ
(৪) বাংলাদেশের তথ্য বাতায়ন
(৫) প্রাগুক্ত জনাব জয়নাল আবেদিন খান
(৬) শংকর লাল দাশ, দৈনিক জনকন্ঠ ১০ এপ্রিল ২০২১,
(৭)(৮)(৯) (১০)প্রাগুক্ত জনাব জয়নাল আবেদিন খান,
(১১) ঢাকা ট্রিবিউন।
( ছবিগুলো লেখকের তোলা)