লেখক ও সাংবাদিক আফতাব হোসেনের মুক্তিযুদ্ধের গল্প

ড.এস,এ,তালুকদার

১৩ মে, ২০২১ , ১:৩৮ পূর্বাহ্ণ ; 431 Views

বই আলোচনা - ড.এস,এ,তালুকদার

মুক্তিযুদ্ধের গল্প 

লেখকঃ আফতাব হোসেন

প্রকাশকঃ আইডিয়া প্রকাশন 

মূল্যঃ ২২০/-

 

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জনাব আফতাব হোসেন একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক। বৈশাখী টেলিভিশন রংপুর এর প্রতিনিধি। চারদশকের সাংবাদিকতা জীবনে দেশে-বিদেশে অনেক সম্মাননা তাঁর ঝুলিতে ভরেছে।সৃজনশীল এই সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষণার জন্যও তিনি একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বিনয়ী নম্র ভদ্র জনাব আফতাব হোসেনের অনুসন্ধিৎসু মন এবং তাঁর কলম জাতিকে আরো অনেক জ্ঞানের খোরাক জোগাবে বলে বিশ্বাস করি।

“মুক্তিযুদ্ধের গল্প” বইটি ২০১৮সালে “কিশোরদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। পাঠক চাহিদার প্রেক্ষিতে বইটির ৩য় সংস্করণ  এখন বাজারে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সারাদেশের মানুষের সাথে রংপুরের মানুষের ভূমিকাও অনেক বেশ উজ্জ্বল ছিল।আন্দোলন সংগ্রামে রংপুরের মানুষের ভূমিকা ব্রিটিশ আমল থেকেই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ৭১’এর উত্তাল দিনগুলোর ধাক্কা প্রথম থেকেই রংপুরের  মানুষকে আন্দোলিত করেছিল। ৩রা মার্চেই রংপুরে স্বাধীনতার জন্য অবাঙালিদের গুলিতে প্রথম জীবন উৎসর্গ করে কিশোর শংকু সমজদার।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭মার্চ ভাষণে রংপুরের সর্বস্তরের মানুষও উজ্জীবিত হয়। রংপুরের উদ্বেলিত দেশপ্রেমিক জনগণ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাঙালি সৈনিকদের উদ্ধারের আবেগে আধুনিক মারণাস্ত্রের সামনে দেশীয় দা,কুড়াল,বটি,তীর ধনুক নিয়ে ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে।রংপুরের মানুষের এসব বীরত্ব গাঁথা লেখক তাঁর “মুক্তিযুদ্ধের গল্প” পুস্তকে অতি সরল ও সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন।

অত্র গ্রন্থে লেখক রংপুরের গ্রামগন্জের মানুষের নিজের ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি জড়িত  এলাকা সমূহের সংগঠক থেকে শুরু করে যোদ্ধাদের ভূমিকা,ঐসব এলাকার আর্থসামাজিক পরিবেশ, যুদ্ধের জন্য আত্মত্যাগকারী পরিবারগুলোর তখনকার এবং বর্তমান সময়ের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরেছেন।  যা মুক্তিযুদ্ধের জনযুদ্ধ রূপ এবং সর্বোচ্চ ত্যাগের চিত্র কে ফুটে তুলেছে।  সেদিক থেকে এ গ্রন্থটি একটি বাস্তব গবেষণাধর্মী পুস্তক হয়েছে এবং এর জন্য লেখকের যে অস্বাভাবিক শ্রম ও মেধা প্রয়োগ করতে হয়েছে সেটিও প্রতীয়মান হয়।

মুক্তিযুদ্ধে রংপুরের সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততার বিষয়টি লেখক গল্পাকারে চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ মানুষের ভাবনাগুলো এতো নিখুঁতভাবে এসেছে যা পড়লে এ যুগের কিশোর যুবরা উৎসাহীত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

মুক্তিযুদ্ধে রংপুরের তৃণমূল মানুষের অংশগ্রহণ সহ তাদের দুঃখ কষ্ট, যাপিত জীবনের কথাগুলো লেখক- “বঙ্গবন্ধু, বাদশা ও শহীদ মিনার,প্রথম শহিদ শংকু,শহিদ শাহেদ আলী ও প্রথম যুদ্ধ, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও ও মুক্তিযুদ্ধ, রূপালী সিংহ ও শ্রাবণের বৃষ্টি, আদিবাসী ও মুক্তিযুদ্ধ, টাউন হল বধ্যভূমি ও বীরাঙ্গনা” শিরোনামে মোট আটটি গল্পে বইয়ে বিধৃত করেছেন।রংপুরের কৃষক শ্রমিক খেটে  মানুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকে উপজীব্য করে তুলেছেন। প্রতিটি গল্পই লেখক কাছে থেকে শুনেছেন বলে মনে হয়েছে। গল্পের চরিত্রগুলোর বুননে বাস্তবতার ছোঁয়া থাকায় উপন্যাসের মতো বুদ হয়ে পড়তে হয়েছে। যা পরিশেষে পাঠকের মনে ইতিহাসকে গ্রোথিত করেছে।

পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং রংপুরে আগমণ এ অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল। দিনটি ছিল সম্ভবত ১৯৭২ সালের ১০মে।  লেখক অবশ্য তারিখটা উল্লেখ করেননি। বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার যে তাগিদ এবং প্রচন্ড ভীড়ে লেখকের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে বইয়ের প্রথম গল্পের নামকরণ ” বঙ্গবন্ধু “।

মাহিগন্জের খোর্দ্দ রংপুরের একটি গ্রামের ছেলে বাদশা কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠলো এবং যুদ্ধ শেষে তার আর ফিরে না আসা নিয়ে গল্প ” বাদশা ও শহিদ মিনার”।  গল্পে বাদশার প্রেম,পাড়া প্রতিবেশীর ভাবনা,বাবা মায়ের ভাবনা অতি সুন্দরভাবে ঐতিহাসিক গল্পে রূপ নিয়েছে।

রংপুর কৈলাশ রন্জন স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির একজন ছাত্র। বাবা মন্দিরের পূজারী। সামান্য আয়ের একটি সংসার। এই পরিবারের ইতিহাস, কিশোর শংকুর মুক্তির মিছিলে যাবার তাড়া,উর্দুতে লেখা সাইনবোর্ড নামাতে যেয়ে গুলি খেয়ে শহিদ হওয়া এবং পরিবারটির পরবর্তী দুঃখ কষ্ট, কিছুটা সুখের কথা লেখক খুব কাছে থেকে দেখেছেন এবং লেখেছেন। পাঠক নিশ্চিত উদ্বুদ্ধ হবে এ গল্পের নায়কের রংপুরের প্রথম শহিদ হয়ে উঠার ইতিহাসে।

২৪ মার্চ। রংপুর ক্যান্টনমেন্টের পাশের গ্রাম সম্মানীপুর। এ গ্রামের সাহসী একজন মানুষ পেশায় কসাই শাহেদ সহ আশেপাশের অন্য গ্রাম,বড়বাড়ি,দেওডোবা,মনোহরপুরের দেশপ্রেমিক মানুষরা দুঃসাহসিক এক যুদ্ধের সূচনা করে। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে আসা পাকসেনাদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। একজন আর্মি অফিসার কে হত্যা করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি এক অনন্য ঘটনা। প্রতিশোধের জন্য লালবাগ হাট থেকে কসাই শাহেদ কে সিভিল ড্রেসে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে। এ গল্পের আদ্যোপান্ত আছে-শহিদ শাহেদ আলী  ও প্রথম যুদ্ধ গল্পে।

২৮ মার্চ ১৯৭১. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রংপুরের মানুষের গৌরবগাঁথা দিন। রংপুরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি ইপিআর ক্যাপ্টেন নওয়াজেসের যোগাযোগ হয়। ক্যান্টমেন্ট ঘেরাও এর পরিকল্পনা হয়। মুজিবর মাস্টারের মুখে কথোপকথন ভঙ্গিতে লেখক ঘটনার পূর্বাপর বর্ণনা করেছেন পুস্তকে। সাথে ঐ এলাকার মানুষের কর্ম,বিভিন্ন উৎপাদিত ফল ফসলাদি এবং আদিবাসীদের কথা। সেদিন যে সকল দেশপ্রেমিক নিরস্ত্র মানুষ অকাতরে কামানের গুলিতে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন তাদেরকে স্মরণে নিসবেতগন্জে ” রক্তগৌরব” আজও কথা বলে। এসব ইতিহাস “রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও  ও মুক্তিযুদ্ধ ” গল্পে সাবলীল ভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক।

রূপালী সিংহ।  এক সুন্দরী নারী। তার সুখের জীবন কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী কেড়ে নেয়। তার বর্ণনা আছে “রূপালী সিংহ ও শ্রাবণের বৃষ্টি ” গল্পে। এই বীরাঙ্গনা পরিবারের বর্তমান দুঃখ দুর্দশার চিত্র অত্যন্ত নিপুণ হাতে তুলে ধরেছেন অভিজ্ঞ ইতিহাসবেত্তা সাংবাদিক আফতাব হোসেন।  এ গল্পে মুক্তিযুদ্ধে কতো কিছুর বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা তা উপলব্ধি করা যায়।

মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অবদানও লেখক তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন।  রংপুরের পাশের উপজেলাগুলোতে বসবাসরত সাঁওতাল ও অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ দেশের জন্য জীবনবাজি রেখেছে। আর্থিক নানা সংকটেও তাদের দেশপ্রেমের অভাব ছিলো না।” আদিবাসী ও মুক্তিযুদ্ধ গল্পে” লেখক আদিবাসীদের কৃষ্টি কালচার এবং আয় ইনকামের উৎসগুলোই গল্পে উপস্থাপন করেছেন। লেখকের অভিজ্ঞতায় আদিবাসীদের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। তারা লেখাপড়া শিখে চাকুরী করছে।

সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র রংপুর “টাউন হল”। এই প্রাঙ্গণে আছে শতবছরের পুরানো ‘রঙ্গপুর পাবলিক লাইব্রেরি’ রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ । মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণচঞ্চল  সৃজনশীল এই চর্চাকেন্দ্রটিকেই পাক হানাদার বাহিনী নির্যাতন কেন্দ্র বানিয়েছিল।অসংখ্য নিরপরাধ নারী পুরুষ, তরুণ,যুবক-যুবতীকে ধরে এনে টাউন হলে নির্যাতন করতো। নারীদের কে ধর্ষণ ও হত্যা করেছে।

১৭ ডিসেম্বর রংপুর বিজয়ের পরও টাউন হলে নির্যাতিতা নারী আর্তনাদ শোনা গেছে। গাদাগাদা লাশ পাওয়া গেছে এখানে। ভয়ংকর স্মৃতি নিয়ে টাউন হল আজও আছে। অত্র গ্রন্থের শেষ গল্প ” টাউন হল বধ্যভূমি ও বীরাঙ্গনা “।  গল্পটির শুরুতেই রংপুরের গুণীজনদের মুখে লেখক রংপুরের  ইতিহাস ঐতিহ্য ও গর্বের বর্ণনা দিলেও টাউন হলে পাক হানাদের কৃত্তি কাহিনী আজও লোমহর্ষক। এখানে হাজারো নারীর সম্ভ্রম হারানোর বিভৎসতা গল্পে ইতিহাসের স্মারক হয়ে উঠে এসেছে।

রংপুরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখক সাংবাদিক আফতাব হোসেনের বিশাল অভিজ্ঞতা পুস্তকের প্রতিটি গল্পে প্রতিফলিত।  রংপুরের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের নিয়ে তাঁর টেলিভিশন, রেডিও অনুষ্ঠানগুলোর সফলতার প্রতীকও ” মুক্তিযুদ্ধের গল্প” বইটি। বইটি স্কুল কলেজের ছাত্র/ছাত্রী এবং সর্বস্তরের মানুষের জন্যই সুপাঠ্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বই। লেখকের কাছে মুক্তিযুদ্ধের উপর আরো গবেষণা ধর্মী লেখা এবং তাঁর সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।

[wpdevart_facebook_comment curent_url="http://yourdomain.com/page-url" order_type="social" title_text="Facebook Comment" title_text_color="#000000" title_text_font_size="22" title_text_font_famely="monospace" title_text_position="left" width="100%" bg_color="#d4d4d4" animation_effect="random" count_of_comments="3" ]