মারা যাওয়ার পর লাশটা দেশে আনা গেল না। জার্মানিতেই দাফন করা হলো। বৃন্দাবনের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল। দেশে তার বউ আর টিনেজ মেয়ে। হঠাৎ স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ায় হঠাৎ করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পড়ল ইসমত জাহান। সবগুছিয়ে নিতে বছর দুয়েক লাগল। ততদিনে মেয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেছে। তাই ইসমত হাফ ছেড়ে বাচঁল। সুখের নিশ্বাস নিতে পারছে। সুখের বিরহটাও জমেছে যে তা টের পেতে শুরু করেছে।
মেয়ে নিজে নিজেই চলাফেরা করতে পারে। তাকে নিয়ে চিন্তা নেই। বরং মেয়ে তার মাকে নিয়ে এখন ভাবছে। আর কত এভাবে একলা?
কবিতা ক্যাফেতে নিয়মিত ইসমতের যাতায়াত বেড়েছে। ভালো লাগে। এর মধ্যে এক ছেলের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে তারা বেড়াতে যায়। বয়স এবং ইতিহাস ভুলে তারা প্রেমে মশগুল। ছেলেটার সাথে যে সম্পর্ক তা প্রেম কি না বলা মুশকিল। তবে ইসমতের মাথায় সবসময় ছেলেটাই। ছেলেটার বয়স বেশি নয়- ভার্সিটির স্টুডেন্ট সে। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা নাই বলে বর্তমানটা দারুণ মুগ্ধময় যাচ্ছে।
সেক্স করার জন্য ইসমত হোটেলে যায়। তার নিজের বাড়িতে লজ্জা পায়। যদিও তার মেয়ে এ ব্যাপারে কিছু জানে না। মেয়ে জানে মা বইপাগল, বইয়ের প্রেমে মত্ত। আর কারো সাথে সম্পর্কে জড়ালে সে খুশিই হবে।
বছরখানেক হলো। এক পর্যায়ে প্রেগন্যান্ট হয়েছে বুঝতে পারল ইসমত। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেল। মেয়ের কাছে লুকোতে চাইলেও পারল না। মেয়েই তাকে বলল-নো প্রবলেম।
ইসমত কেঁদে ফেলল মেয়ের সহানুভূতি আর সমর্থনে। সারা দিনরাত মায়ের পাশে মেয়ে। কখনও বিব্রতকর কোনো কথা বলেনি। ইসমত অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো- অ্যাবরশন করবে।
মেয়ে এই বিষয়ে এইবার মাত্র হাসল। বলল, কেন?
-তুই বুঝবি না।
-একটা প্রাণ নষ্ট করছ তা কি ঠিক?
-ঠিক না তা জানি।
-তাহলে কেন সেই পাপ করছ? তাকে পৃথিবীতে আসতে দাও।
-আমি এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।
-ওকে। তোমারটাই ঠিক, তাই হবে। আমি তোমার সাথে আছি।
হসপিটালে গিয়ে অ্যাবরশন করা হলো।
ইসমত একটা নতুন প্রাণ নষ্ট করায় অনুতপ্ত। কিন্তু কী করবে? তাকে পৃথিবীতে আনলে তার সামনে বেড়ে ওঠা প্রাণবন্ত মেয়েটার কী হবে? সমাজে তার মেয়েটা কোথায় দাঁড়াবে? যতই মানুষ জীবনের কথা বলুক আসলে জীবনকে বিষিয়ে তুলতে তো সেই মানুষকেই দেখেছে ইসমত। সে এখন শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এবং এক পর্যায়ে সব স্বাভাবিক হয়ে গেল।
ইসমতের মেয়ে একদিন বলল, মা তুমি কার সাথে প্রেম করছ?
আগে এসব বিষয়ে কিছু জানতে চায়নি তার মেয়ে। ইসমতের পাল্টা প্রশ্ন, তাতে তোর কী?
-এমনি জানতে চাইছি।
-দরকার নাই।
-পরিচয় করাবা না?
-বেশি পাকনামি করিস না।
-একটা কথা বলব?
-কী?
-আমি কিন্তু প্রেমে পড়েছি।
-তাই! দেখাবি ছেলেটাকে?
-না।
‘তোমারটাকে আগে দেখাও’ বলে মেয়েটা পালাল।
মেয়ে প্রেমে পড়েছে-এ নিয়ে ইসমতের ভয় শুরু হলো। কোন ছেলে, কেমন ছেলে ইত্যাদি ইত্যাদি…
ইসমত রাতে মেয়ের রুমে এসে বলল, তোর বয়ফ্রেন্ড কী করে?
-এসব নিয়ে কিছু বলতে পারব না। তোমার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে আমি গবেষণা করি না। সো, তুমিও আমারটা নিয়ে গবেষণা করবা না।
-কতদিনের সম্পর্ক?
-সম্পর্ক নয়। আমি ছেলেটাকে পছন্দ করি ছেলেটা আমাকে করে না। সে সিনিয়র কারো সাথে রিলেশনে জড়িয়েছে।
ইসমতের মেয়ে বিবিএ শেষ করে জব শুরু করেছে। ইসমত মেয়ের বিষয়ে আশাবাদী। তবে একটা বিষয়ে ভয়ে থাকে। কয়েক বছর ধরে মেয়ে যে ছেলেকে পছন্দ করে সে ছেলে তো মেয়েকে পাত্তা দিচ্ছে না। এর ফলে মেয়ের জীবন কোন দিকে যে মোড় নেয় তা বোঝা কঠিন। ওদিকে ইসমত আর তার বয়ফ্রেন্ডের মধ্যে সময়ের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ছেলেটা জব করছে। সেও আর তাকে সময় দিতে পারছে না। শুধু সেক্সের অফার দিলে ছেলে এখুনি দৌড়ে আসবে কিন্তু মায়ার টানে আসবে না। ইদানীং সেক্সের চেয়ে বন্ধুত্বটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং উপভোগ করে সে। ছেলেটার প্রতি একটা মায়ার কারণে এই দূরত্বটা মেনে নিতে কষ্ট। হৃদয়ে একটা জায়গা তৈরি করেছে ছেলেটা। সম্পর্কটা বেশ উপভোগ্য। তাকে ছাড়তে পারছে না। দিনকে দিন মরিয়া হয়ে যাচ্ছে মায়ার টানে আর ছেলের টান অন্য দিকে…
নতুন করে দুর্ভোগ হিসেবে ইসমতকে ভোগাচ্ছে মেয়ের একাকিত্ব। সে চায় মেয়ের একাকিত্ব ঘোচাতে। নিজের একাকিত্ব ঘোচানোর চেয়ে মেয়ের একাকিত্ব ঘোচানোকে অগ্রাধিকার দিলো।
মেয়েকে বলল, ওই ছেলের সাথে আমি যোগাযোগ করে দিই তোর। চেষ্টা করে দেখি।
মায়ের এই অফারে বিস্ময়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল মেয়ে। এই উপকারটুকু করার কেউ ছিল না।
মেয়ের মুখে ছেলেটার মোবাইল নম্বর শুনে থ হয়ে গেল ইসমত। এটা যে তার বয়ফ্রেন্ডের নম্বর! ইসমত অনেক সাহস সঞ্চার করে মেয়েকে তা জানাল। মেয়ে কষ্টে কুঁকড়ে উঠল। মেয়ে নিশ্চল বোবা হয়ে গেছে। ইসমত বুঝতে পারল ব্যাপারটা।
ইসমত কষ্ট চেপে ধীরে সুস্থে জানাল, ওর সাথে বয়সের কারণে দূরত্ব বেড়েছে আমার। এই বয়সে ওই ছেলের দরকার তোর মতো সঙ্গী।
ইসমতের মেয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে।
নিজের কথা ভুলে ছেলেটাকে তার মেয়ের জন্য রাজি করাতে কবিতা ক্যাফে’র পথে নামল।