তানজিলা লাবণী
১৩ মে, ২০২১ , ২:২০ পূর্বাহ্ণ ; 787 Views
ইদ মানেই বাধ ভাঙা আনন্দ উচ্ছাস কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথেই এই উচ্ছাস কোথায় যেন মিলিয়ে যায় দিনের আলোর মত। এই নিয়ে অন্য একদিন লিখব, সেখানে বিষাদ আর কষ্ট থাকবে, দায়িত্বের কষ্ট, সাধ থাকা সত্ত্বেও সাধ্য না থাকার কষ্ট, সকল কে খুশি করতে না পারার কষ্ট আরো অনেক অনেক অনেক চেনা-অচেনা কষ্ট।
আমার ছোট বেলার ইদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে খুব বেশি মনে পড়ে হাড় কাপানো শীত, নতুন জামা, টকটকে লাল রঙের মেহেদি রাঙা হাত আর সালামি।
তখন আমাদের মাটির বাড়ি, ৩ টে বড় বড় ঘর। আমি আর আপু থাকতাম কোণের ঘরে একপাশের ঘরে দুই ভাই অন্য টাতে আব্বা মা। কিন্তু সাহরির জন্য আমরা ৩ ভাই বোন এক বিছানায় ঘুমাতাম। ছোট ভাইয়া তখন মাদ্রাসার আবাসিকে। ৩ ভাই বোনের একসাথে থাকা দেখে মা প্রায়ই বলতো ছেলে মেয়েরা এক কাথার নিচে থাকা পর্যন্তই জীবনের সুখ নির্ধারিত এরপরে আলাদা হয়ে গেলে কষ্ট। তবে মা কে এখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি আমরা আলাদা হওয়াতে তার কষ্ট হয় কি না? তবে নিশ্চিত একদিন জিজ্ঞেস করব।
আব্বা সামান্য বেতনের চাকরি করেন, ৬ জনের সংসারে অভাব নিত্য দিনের সংগী। তবুও আব্বার সবাইকে ভাল রাখার যে আপ্রাণ চেষ্টা সেটা বোঝার পর কোন কিছুর জন্য বায়না করতাম না। সবার জামা কাপড় কেনার সামর্থ্য ছিল না। তবে হ্যা আমি ছোট হওয়ায় অন্য ভাই বোন দের ভাল জামা না হলেও আমি এই সুবিধাটুকু পেতাম। আমার জামার দায়িত্ব ছিল ভাইয়ার উপর। ভাইয়া টিউশনের টাকা জমিয়ে প্রত্যেক ইদেই আমার জামা নিয়ে আসতো সুদূর রাজশাহী থেকে এবং সেটা পাড়ার সকলের থেকে আলাদা এবং সুন্দর হতো। ইদের যখন ১ সপ্তাহ বাকি ভাইয়া রাতে বাসায় আসতো। সকালে চোখ খুলেই দেখতাম আমার বিছানায় নতুন জামা। কি যে আনন্দ হতো! সেই আনন্দ এখন কোটি টাকা দামের জামা পেলেও হবে না নিশ্চিত!
জামা পুরোনো হয়ে যাওয়ার ভয়ে লুকিয়ে রাখতাম মায়ের আলমারি তে। তারপরেও সমবয়সী রা যখন মায়েদের সাথে নিয়ে আসতো তখন বাধ্য হয়েই দেখাতাম। তারপর এক রাশ অভিমান নিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতাম। এই অভিমান শেষ হতো ইদের চাঁদ দেখার মধ্যে দিয়ে। চাঁদ দেখার সাথে সাথেই শুরু হতো মেহেদি দেয়ার পালা। উঠানে সবাই টর্চ লাইট, ল্যাম্প অথবা হারিকেন নিয়ে বসে পড়তাম মেহেদি লাগাতে। (সহপাঠিনী পলি মিতু রেখার সাথে মেহেদি দেয়ার সেই দিন গুলো যদি ফিরে পেতাম! মানুষের সব চাওয়া কেন পূরণ হয় না? খুব করে চাই সবাই ফিরে পাক সোনালি শৈশব, শৈশব ফিরে না পাক অন্তত বন্ধু দের ফিরে পাক)।
মেহেদি দেয়ার এই কার্যক্রম শেষ হতো সুবহে সাদিকে। এরপর রাস্তা উঠান ভাগাভাগি করে নিয়ে চলতো ঝাড়ু দেয়ার কাজ।
পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষে যে যার যার বাড়িতে ফিরে যাওয়া এরপর কাপতে কাপতে কলের ঠান্ডা জলে গোসল সেরে নতুন জামা গায়ে চড়িয়ে শুরু হতো সালামি আদায়ের কাজ। শুরুতে আব্বা, মা, ভাইয়া তারপর বাকি সদস্য।
সালামি নেয়া শেষে পায়েস/সেমাই রুটি খেয়ে দল বেধে যেতাম ইদগাহ মাঠে।
সেখানে মেলার মত অনেক দোকান পাট বসতো।
নানা রঙের মাটির খেলনা-পুতুল, বাশি, হরেক রকম বেলুন আর মিষ্টান্ন।
এসব কিনে বাড়ি ফিরতাম।
বাড়ি ফিরে সালামির বেচে যাওয়া টাকা তুলে দিতাম মার হাতে, সেখান থেকেই স্কুলের টিফিনের টাকা নিতাম।
এরপর দুপুরের জন্য তৈরি হতো মজাদার সব খাবার। পোলাও, রোস্ট, কোরমা আর জর্দা পোলাও। মায়ের হাতের সব রান্না যেত অমৃত! (১০ বছর মায়ের হাত ভাঙা, এই ভাঙা হাতে আর পারেন না রান্না করতে। যদিও আপুর পর এই দায়িত্ব টা আমার কাঁধে কিন্তু স্বাদ হয় না মার রান্নার মত। মায়েরা জাদু জানে খাবার সুস্বাদু করতে) দুপুরের খাবার শেষ করে আবার দল বেধে বেরিয়ে পড়তাম পুরো পাড়া ঘুরতে বন্ধুদের বাড়িতে বাড়িতে।
সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরতাম ক্লান্ত শরীরে, রাতের খাওয়া শেষে কখন যে ঘুমের দেশে হারিয়ে যেতাম।
সকালে ঘুম ভেঙে মা কে জিজ্ঞেস করতাম মা ইদ শেষ?
মা বলতো নাহ, আজকেও ইদ।