যখন দেশের বিভিন্ন জেলায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। তখনই আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল খোদ রাজধানীতে। আগুনে পুড়ে অনেক প্রাণ গেছে সিদ্দিক বাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়ও। তার কদিন পরই এক ভোরে যখন মোয়াজ্জেন আজান শেষ করল, এর একটু পরেই রাতের নৈঃশব্দের স্তর ভেদ করে আগুনের লেলিহান শিখায় দুমড়ে মুচড়ে সর্বশান্ত হয়ে গেল বঙ্গবাজারসহ পার্শ্ববর্তী আরো ছয়টি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। চোখের জলে নরম হলো এই এলাকার মাটি-পাথর-ধুলিকণা। মানুষের দীর্ঘশ্বাসে ভরপুর হলো আশপাশ।
এসব দুর্বিসহ আগুনের প্রসঙ্গ বর্ণনা করলেই চোখে ভাসে বাজারেও চলছে এখন দ্রব্যমূল্যের আগুন। মূল্য বৃদ্ধির আগুনের তাপে এখন মানুষের মন পুড়ছে যা দৃশ্যত নয়। আগুনে পোড়া মানুষের হৃদয় পুড়তে পুড়তে এমন অবস্থা বিরাজ করছে যে মানুষ তার প্রতিবাদের ভাষাও প্রকাশ করতে পারছে না। দেশে দৃশ্যত আগুন আর বিদগ্ধ মানুষের অন্তরের ভেতর ধিকিধিক জ্বলে থাকা ছাইপোড়া অদেখা আগুনের বিহিত কারা করবে? এভাবেই এক অদৃশ্য আগুনে পুড়ে ছারখার হলো রাশেদার জীবন।
আগুনের এই তাণ্ডবে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা মেটাবার চিন্তা ব্যবসায়ীরা ভাবতে গেলে একেবারে মূক হয়ে যাওয়া ছাড়া বা কান্নায় ভেঙে পড়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। এর প্রভাবে যানজট, ভেতরের গ্যাস লাইন ফেটে বিস্ফোরিত কু-লির ধোঁয়া, টিনের শেড পুড়ে ছোট বিল্ডিং জ্বলে পুড়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। ফায়ার সার্ভিসের তাৎক্ষণিক কার্যক্রমের বিঘ্ন ঘটে। মানুষ দিকশূন্য হয়, অস্থিরতায় ভেঙে পড়ে ব্যবসায়ীদের মনোবল। হেলিকপ্টার, সেনা-নৌ-র্যাব-বিজিবি-পুলিশ সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসে সম্পদ রক্ষায়। পত্রিকার তথ্যমতে কেবলমাত্র বঙ্গবাজারের ক্ষয়ক্ষতিই হতে পারে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। এত যে ক্ষতি হয়ে গেল তারপরও মানুষ সচেতন নয়। আগুন লাগলেই ক‘দিনের মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় যার কার্যকারীতা সহজে আর আলোর মুখ দেখে না। আলোর মুখ দেখে না বলতে প্রকৃতপক্ষেই এসবের জন্য কার্যকরী প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। দেখা গেছে এসবের জন্য প্রথমেই মানুষের সচেতনতাকে দায়ী করা হয়। তারপর কিছু দোষ চলে যায় চলে যায় সিটি কর্পোরেশন এর ঘাড়ের ওপর, কিছুটা যায় ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থতা ওপর, আর সবশেষে যত দোষ নন্দ ঘোষ ওই মাকের্ট কর্তৃপক্ষের ওপর। রিপোর্টে প্রকাশ হয় ওদের অবেহলার গল্প। অনেক ক্ষেত্রেই মার্কেটগুলোতে আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতির কথাও পর্যাপ্ত নয় বলে উল্লেখ করা হয়।
এই যে সব কারণ তা আসলে সময়ক্ষেপণ করারই নামান্তর। আসলে উন্নত দেশে থেকে আরও বিশেষজ্ঞ বা যন্ত্রাপাতি বা নগর পরিকল্পনাবিদদের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক যা দেশে বিদ্যমান যথাযথ অথরিটি গ্রহণ করে না। আগুন কি শুধু ব্যবসায়িদের ক্ষতি সাধন করছে নাকি ভোক্তা পর্যায়ে যারা আছেন তাদেরও ক্ষতি হচ্ছে? সরবরাহ কম হবার কারণে গ্রাহক পর্যায়েও পরবর্তী সময় মূল্য বৃদ্ধির চাপ পড়ে। যে ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্থ হলো সে যে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লোন নিয়েছে তাতে ব্যাংকের ভেতরও খেলাপি ঋণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ফলে ব্যাংকেও তারল্যর ওপর প্রভাব পড়ে। আবার ব্যক্তিগত ধারদেনার ফলে সমাজের অনেক বিত্তবানের ওপর তার প্রভাব পড়ে। এভাবে একটি ঘর, আরেকটি ঘর করে করে এসবের প্রভাব বিভিন্নভাবেই বিভিন্ন সংস্থায় আঘাত করে। ক্ষতির বর্ণনায় আসতে পারে বিভিন্ন মার্কেটে খেটে খাওয়া হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষের গোপন কথা। যোগ হতে পারে তাদের সংসারের মর্মান্তিক অভাব আর দায়দেনার গল্প।
এই আগুনে শেষ হয়ে গিয়েছিল হাজার হাজার শ্রমিকের সংসারও। এখানে আরও প্রায় পাঁচ হাজার কর্মীর জীবন নির্বাহ হতো, ছিল আরো সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও কর্মী। কর্মীরা বেঁচে ছিল তাদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে। এমনি রাশেদাও।
রাশেদাকে নিয়ে যখন তার বৃদ্ধা মা সিদ্দিক বাজারের ঘিঞ্জি এক রুমের একটি কক্ষে থাকতে লাগল আরও তিন বছর পূর্বে, তখন থেকেই ওদের কাজ ছিল বঙ্গবাজারের দশটি দোকানে খাবার সাপ্লাই করা। রাশেদার মা সকালে গুলিস্তানের কাপ্তান বাজারে চলে যেত হাতে প্লাস্টিকের একটি ব্যাগ নিয়ে, সাথে ষোল বছরের রাশেদাও। বাজার থেকে কোনো দিন ডিম, শাকসবজি, ছোট মাছ বা গরুর কলিজা বা হিসাব মেলাবার জন্য কোনে কোনে দিন শুটকিও যোগ করত রুটিনে। এভাবেই বঙ্গবাজারের দোকানিদের জন্য বাসা থেকে খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করত ওরা। দুপুর আর রাতের খাবার দোকানিরা দোকানে বসেই খেত। প্রতিজনের বিল আসত দুপুরের আশি টাকা আর রাতের ষাট টাকা করে। রাশেদার হাতে পাঁচ বাটির দুটো টিফিন ক্যারিয়ার দিয়ে পাঠানো হতো বাজারে দোকানিদের কাছে। দোকানিরা এই ‘হোম মেইড’ খাবার খেয়ে শান্তি পেত এবং অপেক্ষমান রাশেদার হাতে নগদ টাকা ও বাটি ফিরিয়ে দিত।
রাতের খাবার একটু আগেই পাঠানো হতো, রাত আটটার মধ্যে। রাশেদা খাবারের মাঝের আধ ঘন্টা বিরতিতে বাজারের এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে দেখতো আর স্বপ্ন বুনতো কোনো একদিন হয়তো এই বাজারেই ছোট্ট একটি ঘরে কাপড়ের ব্যবসা করতে বসবে। তিন বছরে তার অভিজ্ঞতায় অনেক ভাবনা জড়ো হয়ে আছে। সে ভাবে একদিন দোকান হলে মাকে আর খাবার রান্নার জন্য আগুনের পাশে বসে থাকতে হবে না। সে মায়ের শরীরের ঘামের ভেজা নোনা গন্ধ পায়। মা যে ক্লান্ত হয়ে জীবনের জন্য আল্লাহর কাছে অভিশাপ পাঠান এবং অহরহ মৃত্যু কামনা করেন তার অবসান হবে একদিন। রাশেদা তার স্বপ্নের নকসি কাঁথার গল্প মাকে বলে না। সব মনের ভেতর গোপন করে রাখে আর ঘরে ফিরে মায়ের সাথে রান্নার এন্তেজামে মগ্ন হয় আর অবশিষ্ট শাকসবজি উচ্ছিষ্ট ময়লা হাঁড়ি পাতিল পরিস্কার করার কাজে লেগে যায়। কোনো কাজই তাকে দমাতে পারে না। শুধু এই ষোল বছরের শরীরটা মাঝে মাঝে ইকির বিকির করে ওঠে যখন মহল্লার বদ ছেলেরা তাকে দেখে শিস মারে, অসভ্য শব্দ উচ্চারণ কর। সে তখন বুকের ওড়না ঠিক করে শরীরের সব উত্তেজক অংশকে ঢেকে রাখে। তবে মাঝে মাঝে সে-ও খিস্তি বলে ছেলেদের জবাব দিতে ভয় করে না।
ঢাকা শহরের অনেক মহল্লার খবর সে রাখে। মায়ের কাছে শোনে আর বাড়ির মালিকের বউয়ের কাছেও শোনে। দশ-বারো স্কয়ার ফিটের বাসাটি ছোট্ট চিলতে এক ঘর। তবু চলে যাচ্ছে কিন্তু বাড়ির মালিকটির অসভ্য দৃষ্টি থেকে রাশেদা মুক্তি পায় না। প্রতিদিনই প্রায় সন্ধ্যা হলেই লোকটি মদের বোতল নিয়ে বসবে আর চানাচুর বাদাম মুখে নিতে নিতে বউয়ের সাথে নোংরা ভাষার গালাগালি বা নিজের বউকে অর্ধ-উলঙ্গ করেই যা-তা করে বসবে। প্রায়ই সেসব অস্বাভাবিক দৃশ্য রাশেদাকে দেখতে হয়। নেশায় পড়ে একদিন লোকটি রাশেদাকেও জড়িয়ে ধরেছিল কিন্তু মা মা বলে চিৎকার করে রক্ষা পেয়েছিল।
মাস তিনেক হলো রাশেদার মা চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে ওখানে, রাশেদাকে ছেড়ে। রাশেদা কোথায় যাবে তা নিয়ে সে উদ্বিগ্ন হয়নি খুব। সে জানত মায়ের ব্যবসা বা ‘হোম মেইড’ খাবারের ডেলিভারির সব নিয়ম কানুন। তা-ই সচল রাখল। নিজের হাতে আরও কিছু রান্নার আইটেম বাড়িয়ে দোকানের মালিক কর্মচারিদের কাছে খাবার পাঠানো হলো। এবার সে নিজে আর বঙ্গবাজারে গেল না। মহল্লার একটি ছেলেকে রাখল এই কাজে।
মাসের খরচ গিয়ে বেশ ভালো উপার্জন তার। বাসা বদলও তার করতে হয়নি। বাড়িওয়ালাও তার উপর বেশ সদয় হয় এবং মাঝে মাঝে প্রয়োজন হলে টাকা ধার দেয়ার আগ্রহের কথাও প্রকাশ করে। প্রয়োজনে রাশেদাকে আরও বড় ব্যবসার কথা বলে অনুপ্রেরণা যোগায়। কিন্তু সমস্যা বাঁধে যখন তার বউ ঘরে থাকে না, তখন বাড়িওয়ালা নিজেই রাশেদার ঘরে উঁকিবুকি দেয়, কাছে আসে, গায়ে হাত স্পর্শ করতে চায়। রাশেদার বয়স আর শরীরের উত্তাপকে চাগিয়ে দেয় লোকটি। গভীর রাতে ঘুম না এলে রাশেদা যেন দেখতে পায় একজন পুরুষ মানুষ তার শরীরের ওপর বয়ে যায়। এক নরম-গরম ভিন্ন এক উত্তেজনা টের পায়। ঘুম ভেঙে গেলে সে জীবনের নিরাপত্তা আর নির্ভরতার কথা ভাবে। সে যেন আরো নির্ভরতা চায়, নিরাপত্তার চাদরে ওম নিতে ইচ্ছে করে তার। আরও বিত্তবান হবার অজানা পাখায় ভর করে ঢাকা শহরে স্থায়ীভাবে ঠাঁই চায়। আরও অর্থের যোগান তার রক্তকোষে লালসা ধরিয়ে দেয়। এই শহরে তাকে টিকতে হবে, এখানে ভালো করে তাকে বাঁচতেই হবে কারণ গ্রামে তার কেউ নেই, জায়গাজমি, বাড়ি ঘর কিছুই।
একদিন বাড়িওয়ালা তার বউকে সাথে নিয়ে দুপুরের সময় রাশেদার কক্ষে ঢোকে। রাশেদাকে উদ্দেশ্য করে বউটিই বলে– রাশেদা তুমি আমাগো ঘরেভি খাবার পাঠাইয়ো। আমার শইল গতরভি ভালা যাইতাচে না। মগার খালি পেটেতো থাকন যাইবো না। তুমি টাকা পইছা লইয়া চিন্তা কইরো না। আর আমরা ভাড়া নিয়াও তোমার ছাথেভি প্যারাপ্যারি করুম না। ভাড়াভি বারামু না। টেনছন নিয়ো না। আমার আব্বার বাড়িতে জরুরি কাম পড়ছে। আমি এক মাস থাকুম না। তোমার ভাইজানরে খাবার দাবার করাইও।
রাশেদা কোনো কথা বলে না। সে ভাবছে সামনে তার অন্ধকার সময়। অন্ধকার তার চারদিকে ঘেরাও করবে। তার চুপ থাকা দেখে বাড়িওয়ালা বলে- কিছু একটা কও রাশেদা। আমারে খাবার দিবা না? তোমার ঘরে আইসা খাইয়া যামু।
যেদিন এসব কথা হয় তার পরদিনই বঙ্গবাজার পুড়ে সাফ। রাশেদার ভাগ্য এক অদৃশ্য আগুন-বাতাসে পুড়ে যায়। কিন্তু এই আগুন কেউ দেখে না। সে পুড়তে থাকে, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে থাকে তার পোড়া হৃদয়। তার সব কাজ খাবার সাপ্লাই বন্ধ হলে সে আরো চুপচাপ নির্বাক হয়ে ঘরের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকে আর ভাবে নিজের ভবিষ্যত : মা নেই বাবা নেই। একা সে কীভাবে সামাল দেবে এই শরীর আর জীবন ?
বাড়িওয়ালা দুপুরের খাবার খেতে আসে। প্রথমে রাশেদার খোঁজ নেয়। মার্কেটের সব তত্ব তালাশ করে। কিছু সময় দম নিয়ে রাশেদার শরীরের কাছে ঘেঁষে বলে–রাশেদা চিন্তা করো কে-লা ? আমি আছি। তোমার টেনছান ছব আমি নিলাম। মাগার কতা দিতে অইবো তুমি অন্য কোনোখানে যাইবা না। আমার ঘরেই থাকবা। কও রাজি আছোনি ? রাজি আছো..?
রাশেদা অনেকক্ষণ কিছু বলে না। ক‘মাস পূর্বে যখন মা জীবিত ছিলেন তখন সাহসের তীব্রতা ছিল তার ভেতর, সামান্যতম উলোটপালট কোনো কথা শুনলেই জ্বলে ওঠত। এখন তার বিশ্বাসে ফাটল এসেছে, জীবনের ভাবনাগুলোতেও। বন্যার তোড়ে যখন সবকিছু ভেসে যায় তখন বাঁচার আঁকুতিই বড়, তখন সামান্য খড়কুটো পেলেই জড়িয়ে ধরে মানুষ। রাশেদা এখন বুঝতে পারে একমাত্র সাহসই তাকে সফলতা এনে দিতে পারে, তাকে বাঁচাতে পারে। তবে ভাবনার সাথে সুষ্ঠু চিন্তার যোগসূত্র না মিললে হতাশায় পুড়তে হবে। তখন আর এই জীবনের ঘানি টেনে তার অনেকদূর যাওয়া সম্ভব হবে না।
একটু ভেবে রাশেদা এই দুর্দিনে দুঃসময়ে একটি কঠিন ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। বাড়িওয়ালার চোখের দিকে আর সামনে রাখা ভাতের মেলামাইন থালার দিকে তাকিয়ে সে জবাব দেয়-হ।
..
শাওন আসগর
প্রযত্নে: আশিকুল কাদির। সীমানা গ্রীণ হাউস-৩য় তলা # ২০৯/ক লালবাগ রোড, ঢাকা-১২১১।
মোবা: ০১৬৮২৮৮০৯৮৬ ।