নাহিদা ইয়াসমিন
১৩ মে, ২০২১ , ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ ; 542 Views
মেয়েলোকের ওই একটাই সমস্যা, সব কিছুকেই নিজের বাপের সম্পত্তি মনে করে। আমার ভাবীকে দেখেছি বিয়ে হতে না হতেই, মার ৩০ বছরের সংসারের চাবির গোছাটা সে ৩ মাসের মধ্যে নিজের করে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, এ বাড়ির আরো দুটো রুম, কিচেন এমনকি আমার বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়ার রুমটাও সে নিজের বাপের সম্পত্তি মনে করে নিজের করে নিয়েছে। মিতুর স্বভাবটাও অনেকটা ভাবীর মতো। ( মিতু আমার বান্ধবী।) আমার কোন বই বা নোট নিলে দেবার নাম নেই। বাপের সম্পত্তি মনে করে সিন্দুকে তুলে রাখে। মেয়েদের এ ধরণের স্বভাব আমার একদমই পছন্দের না।
আজকের ব্যাপারটাই ধরা যাক, তিন ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বাসের টিকিটটা কাটলাম। ঈদের সময় বাসে ট্রেনে এত ভিড় থাকে যে, জার্নি করাটা এক ধরনের যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করার মত। চারদিন ফিরে গিয়ে আজকে লম্বা লাইনে ভোর থেকে দাঁড়িয়ে থেকে টিকেটটা কাটলাম যে, একটু আয়েশ করে জানালার পাশে বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে বাড়ি যাব। কিন্তু তার আর ভাগ্যে জুটল না। সবার আগে বাসে উঠে দেখি আমারও আগে এক তন্বী ললনা আমার সিটটা দখল করে বসে আছেন। মেজাজটা বিগড়ে গেল। সুন্দরী টুন্দরী কিছু আর মানলাম না। কাছে গিয়ে কড়া গলায় বললাম,“চোখে কী কোন সমস্যা আছে নাকি? টিকেট দেখে বুঝতে পারেননি, সিটটা যে আমার?”
মেয়েটি বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত স্বরে বলল,“ জী জানালার পাশে বসাটা আমার ভীষণ দরকার ছিল।”
“ইশ! জানালার পাশের বসাটা ওনার দরকার ছিল! মনে হচ্ছে উনি একজন মহাকবি। প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে উনি যেন মহাকাব্য লেখে ফেলবেন। যত্তসব !
মেয়েটি এবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,“ আপনি আমার পাশের সিটটায় বসুন। ওটা আমার সিট।”
“ওটাতে আপনি বসলে ক্ষতি কী? আমি কেন আপনার সিটে বসতে যাব।” বিড় বিড় করে বললাম।
“ কিছু কী বললেন?”
“ না না বলছিলাম কী আপনি যাবেন কোথায়?”
“পলাশবাড়ী।”
আপন মনে আঁতকে উঠে বললাম,“ওহ মাই গড! পলাশবাড়ী ! সে তো রংপুরের কাছাকাছি। আমাকে তাহলে এতটা পথ এই অহংকারী মেয়েটার পাশে বসে যেতে হবে? ইশ! শালা কপালটাই মন্দ। আজ যে কার মুখ দেখে বাসা থেকে বেরিয়েছি। আর কথা না বাড়িয়ে মুখের উপর একটা পেপার মেলে বসলাম। খুব অসহ্য লাগছে। এতটা পথ যাবো কী ভাবে?
গাড়ি ছুটে চলল সাঁ সাঁ করে। যমুনা সেতুর কাছে এসে দেখি লম্বা লাইন। মনে হচ্ছে বিকেলে কেন আজ রাত ১২টায় পৌঁছাতে পারব কি না খোদাই জানেন। প্রায় ৫৫মিনিট ধরে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। আশে পাশে কোন দোকানপাট নেই। তবু নামলাম যদি কিছু পাই। দেখলাম একটা ভাঙ্গা চায়ের দোকান। ছুটে গেলাম। কিছুই নেই। তবুও নদীর তীরে দাঁড়িয়ে খানিকটা ঠাণ্ডা বাতাস খেলাম। দেখি, দেরির কারণে বাস থেকে সবাই একে একে নেমে পড়ল। কিন্তু নবাব নন্দিনী ওনার সিট থেকে এক চুলও নড়লেন না। আশ্চর্য! মানুষের মন এত সংকীর্ণ হয় কী করে? আমার ভয়ে সে নিশ্চয় সিট ছেড়ে উঠছে না ? ছিঃ এত ছোট মন। আমি ওর মতো নাকি? আপন মনে বক বক করতে করতে আবার এসে সিটে বসলাম। আমার সিটে বসেছে বলে আমার কোন আপত্তি নাই। একদিন জানালার পাশে না বসলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, একজন অকৃতজ্ঞ মানুষের পাশে বসে যেতে আমার অসহ্য লাগছে। সে এতটাই অকৃতজ্ঞ যে, আমার সিটে বসে আমাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলো না। হোক সে অপূর্ব সুন্দরী। তবুও তার পাশে বসে যেতে আমার সত্যি খুব অসহ্য লাগলো।
বাসটা ছেড়ে দিলো। সাঁ সাঁ করে আবার ছুটে চলল বাসটা। পথে আরো দু’তিন জায়গায় বাসটা থামল। ভাবলাম একবার যদি সে কোথাও দুমিনিটের জন্য নামে, তাহলে চট করে আমি আমার জায়গায় বসে পড়ব। মেয়েলোক বলে খাতির করব না। কিন্তু হায় কপাল ! পলাশবাড়ী এসে গেল, তবু ম্যাডাম ফুলি কোথাও নামলেন না। মনে হচ্ছে রংপুর চলে এলেও ম্যাডাম কোথাও নামবেন না। আজ উনি বাসের ভেতরই রাত্রি যাপন করবেন। বাসটা ২৫মিনিট হলো থেমেছে। কিন্তু ওনার নামার কোন তাগিদ দেখছি না। আর সহ্য না করতে পেরে বলেই ফেললাম,“ আপনি কি আজ নামবেন না। আপনার জন্য কি বাস এখানে একঘন্টা লেট করবে?”
আবারো সেই শান্ত কন্ঠস্বর, “আমাকে নেবার জন্য মামা আসবেন?”
দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,“কচি খুকি! ঢাকায় থেকে একাই এল। আর বাড়ির কাছে এসে ওনার পালকির দরকার পড়ল। ঢং দেখলে গা জ্বলে যায়।” মেয়েটির আচরণে সবাই খুব বিরক্ত।
একজন তো বলেই ফেলল,“আরে ম্যাডাম নামুন তো; আপনার জন্য কি আমরা সবাই বাসে ঈদ করব? নামুন বলছি।”
কিন্তু ম্যাডাম এক চুলও নড়লেন না।
এমন সময় লক্ষ করলাম, দুজন লোক বাসের দরজার কাছে একটা হুইল চেয়ার এনে রাখলেন। একজন বয়স্ক লোক বাসে উঠে মেয়েটিকে পাঁজাকোলা করে কোলে নিয়ে নিচে নেমে গেল। মেয়েটি যাওয়ার সময় আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে গেল,“আমার আসলে কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবশ, তাই তো এতক্ষণ উঠতে পারি নাই। কিছু মনে করবেন না।”
এই মুহূর্তে নিজেকে একটা থার্ডক্লাস ছেলে মনে হলো। মনে হতে লাগল আমি চিড়িয়াখানার কোন ছোট্ট একটা প্রাণি। এতক্ষণ ধরে মেয়েটির পাশে বসে ছিলাম। অথচ বুঝতেই পারলাম না, সে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। সত্যি নিজেকে মানুষ ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। না জেনে আমরা কত সহজে অন্যের সম্পর্কে আজেবাজে মন্তব্য করে ফেলি। এই স্বভাব গুলো আমাদের বদলাতে হবে। বাকি পথটা সিটটা ফাঁকায় পড়ে থাকলো। আমি ফাঁকা সিটটায় মেয়েটির পরশ অনুভব করলাম। বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো। আমার মনটাও আজ এক অজানা বৃষ্টিতে ভিজে গেলা।