২৫ মে, ২০২১ , ১২:০৩ পূর্বাহ্ণ ; 936 Views
মুইন বাসিসু
ভাই আমার!
আমার ঘাড়েও যদি ওরা তরবারি শান দেয়,
হাঁটু মুড়ে বসবো না আমি;
আমার রক্তাক্ত মুখের ওপর
ওদের চাবুকের আঘাতেও না,
ভোর যদি এতোটাই নিকটবর্তী
পিছু হটবো না আমি;
আমাদের প্রচণ্ড ঝড়গুলোকে
পরিপুষ্ট করে যে ভূমি
জেগে উঠবো সেখান থেকে।
ভাই আমার!
তোমাকে হাঁটু মুড়ে বসাবে বলে
জল্লাদ যদি তোমার চোখের সামনেও
আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় কসাইখানায়,
যাতে তুমি করুণা ভিক্ষা চাও;
আমি আবারো বলছি, দাঁড়াও মাথা উঁচু করে
আর দেখো আমাকে কতলের দৃশ্য!
দেখো জল্লাদকে,
আর আমারই রক্তে ভেজা তরবারি!
আমাদের নির্দোষ রক্ত ছাড়া
কী আর দেখাবে সেই খুনী?
রাত্রিবেলা বন্দুকের মুখে
ওর পরিখা থেকে
ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওরা,
তারপর কারাপ্রকোষ্ঠের অন্ধকারে
নিক্ষেপ করা হয়েছিল সেই নায়ককে,
সেখানে শেকল ছাড়িয়ে
উড্ডীন এক পতাকার মতো ছিল সে।
শেকল হয়ে উঠছিল জ্বলন্ত মশাল,
আর জ্বালিয়ে দিয়ছিল
যা কিছু ঢেকে রেখেছিল আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে।
আর আজও বেঁচে আছে সেই নায়ক,
আজও কয়েদখানার রুদ্ধ প্রকোষ্ঠের দেয়ালে দেয়ালে
শোনা যায় তার বিজয়ী পদধ্বনি।
[মুইন বাসিসু ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গাজায় থেকেই পড়াশোনা করেন। পরে তিনি মিশরে থিতু হন। অনেকগুলো কবিতার বই প্রকাশ হয়েছে। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে তিনি লন্ডনে মারা যান ]
———————————————
তাহা মুহাম্মদ আলী
সময় সময়
মনে হয়
যে মানুষটি হত্যা করেছে আমার বাবাকে,
আর গুড়িয়ে দিয়েছে আমাদের বসতি-ভিটা,
খণ্ডিত এক ভূ-খণ্ডের দিকে ঠেলে দিয়েছে আমাকে,
তার সাথে যদি লড়াইয়ে নামতে পারতাম।
যদি সে হত্যা করতো আমাকে,
শেষমেশ বিশ্রামে যেতে পারতাম আমি,
আর যদি সুযোগ আসতো আমার,
আমি বদলা নিতাম!
কিন্তু সেই শত্রু লড়াইয়ে নামার কালে
যদি জানা যেতো-
তার একজন মা রয়েছে,
যে কিনা অপেক্ষা করছে তার জন্য,
বা একজন বাবা,
ছেলের আসতে
কিছুটা দেরির কারণে
বুকের বাম পাশটায় চেপে ধরে যে,
তাহলে তাকে হত্যা করতাম না আমি,
সুযোগ থাকলেও না।
একইভাবে…
তাকে হত্যা করতাম না আমি
যদি জানতাম কোনো ভাই বা বোন আছে তার
যারা তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে,
আর অপেক্ষা করে সারাটা সময়
তাকে একনজর দেখবার জন্য,
কিংবা যদি থাকে স্ত্রী
তাকে স্বাগত জানাতে,
বা সন্তান,
যারা এক মুহূর্তও সইতে পারে না তার অনুপস্থিতি,
বাবার আনা খেলনা পেলেই লাফিয়ে ওঠে আনন্দে,
অথবা যদি তার বন্ধু কিংবা সঙ্গী থাকে,
চেনাজানা প্রতিবেশী,
কারাগার বা হাসপাতালের ইয়ার-দোস্ত
বা স্কুলের সহপাঠী…
যারা তার কুশল জানতে চায়,
তাকে পাঠায় সম্ভাষণ।
কিন্তু যদি দেখা যায় নিঃসঙ্গ সে,
গাছ থেকে ছেঁটে ফেলা বিচ্ছিন্ন একটা ডালের মতো,
যার না আছে মা, না আছে বাবা,
না আছে ভাই কিংবা বোন,
নেই স্ত্রী, নেই সন্তান,
আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব কিছুই নেই,
তাহলে তার সেই নিঃসঙ্গতায়
নতুন করে আর কোনো যন্ত্রণাই
ঢালতাম না আমি,
মৃত্যুযন্ত্রণাও না।
বরং পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়
তার দিকে ফিরেও না তাকানোতে
সন্তুষ্টি খুঁজে নিতাম;
কেননা আমি জানি,
তার প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগ না দেয়াই
এক কঠিনতম প্রতিশোধ।
[ফিলিস্তিনি কবি ও গল্পকার তাহা মুহাম্মদ আলী ১৯৪৮ সালের আরব- ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ১৭ বছর বয়সে পরিবারের সাথে লেবানন চলে যান। সেখানেই থিতু হন। ইংরেজি ও আরবি ভাষায় তার অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারা যান ]
———————————–
মুরিদ বারগুতি
তাকালাম নিজের দিকে:
কোনোই সমস্যা নেই আমার।
একদম ঠিকঠাক আছি,
আমার ধূসর চুল আকর্ষণীয়ই মনে হবে
কিছু কিছু মেয়ের কাছে;
সুন্দর করে বানানো আমার চশমা,
শরীরের তাপমাত্রা একদম ৩৭,
ইস্ত্রী করা শার্ট
আর জুতাজোড়াও আরামদায়ক।
কোনোই সমস্যা নেই আমার।
হাতে নেই হাতকড়া,
এখনও জবান বন্ধ করে দেয়া হয়নি,
এমনকি কারাগারেও যেতে হয়নি আমাকে,
ছাটাই করা হয়নি কাজ থেকে,
কয়েদখানায় আত্মীয়-স্বজনদেরও দেখতে যেতে পারি,
নানান দেশে তাদের কবর জিয়ারতেও
যেতে দেয়া হয় আমাকে।
কোনোই সমস্যা নেই আমার।
বন্ধুর মাথায় শিঙ গজিয়েছে
তা নিয়ে মোটেও বিচলিত নই আমি,
পোশাকের তলায়
লেজ লুকিয়ে রাখায় তার চাতুরি পছন্দ আমার,
পছন্দ তার শান্ত থাবাও,
আমাকে খুনও করতে পারে সে,
কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে
তাকে ক্ষমা করে দেবো আমি;
যে কোনো সময়
আমাকে আঘাত করতে পারে সে।
কোনোই সমস্যা নেই আমার।
টিভিতে উপস্থাপকের হাসিতে
মোটেও আর অসুস্থ বোধ করি না আমি,
খাঁকি’রা আমার স্বপ্ন, রাত আর দিন রুদ্ধ করে দেয়
তাও সয়ে গেছে।
সে কারণেই সবসময় পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখি,
এমনকি সুইমিং পুলেও।
কোনোই সমস্যা নেই আমার।
গতকাল রাতের ট্রেনে চড়ে বসে আমার স্বপ্নেরা
আর আমি বুঝেই উঠিনি
কী করে তাদের বিদায় জানাতে হয়।
শুনলাম, এক ঊষর উপত্যকায়
বিধ্বস্ত হয়েছে সে ট্রেন
(কেবলমাত্র ট্রেনের চালক বেঁচে গেছে)।
খোদাকে শুকরিয়া জানালাম আমি,
আর ব্যাপারটাকে সহজ করে নিলাম,
যেহেতু ছোটখাটো দুঃস্বপ্ন হয় আমার,
আশা করি এগুলোই একদিন
দুর্দান্ত এক স্বপ্নের জন্ম দেবে।
কোনোই সমস্যা নেই আমার।
জন্মের প্রথম দিন থেকে আজ অব্দি
নিজের দিকে তাকিয়ে আছি আমি,
নিরাশার কালে শুধু মনে রাখি-
মৃত্যুর পরেও এক জীবন আছে;
ফলে কোনোই সমস্যা নেই আমার।
কিন্তু প্রশ্ন রাখি:
হে খোদা,
মৃত্যুর আগে কী কোনোই জীবন নেই?
[মুরিদ বারগুতি ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ফিলিস্তিনের রামাল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের যুদ্ধের সময়ে তিনি মিশরের কায়রো চলে যান। পরবর্তী ৩০ বছর তিনি আর ফিলিস্তিনে ফিরে আসেননি। কিন্তু তাঁর কবিতায় শেকড়হীনতার সুর ফুটে উঠেছে বারবার। তাঁর ১২ টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মারা যান ]