মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

আওলিয়া

শাওন আসগর

৩ জুন, ২০২৩ , ৯:৫৭ অপরাহ্ণ

আওলিয়া

আউটসোর্সিং কোম্পানির চাকুরিটা নাজমা বেগমের মন্দ যাচ্ছে না। ওর পদবি হলো সিকিউরিটি গার্ড কাম পিওন। তবে নাজমা বেগম নিরাপত্তার কাজ কিছুই করে না। সকালে অফিসে ঢুকেই চিফ স্যারের কক্ষের চেয়ার টেবিল মুছে কাগজপত্র ফাইল ঠিকঠাক করে রাখে আর দরোজার বাইরে টুলে বসে থাকবে বেলা পাঁচটা পর্যন্ত। কোনো গেস্ট এলে চা কফি বা গ্রিন টি সাথে লেক্সাস বিস্কিট যোগাড় করে সামনে দিয়ে আসবে। মাঝে মাঝে কাঁটাবনের পশ্চিমপাশের যে ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার আছে ওখান থেকে কিছু সিঙ্গাড়া, ছানা মিষ্টি বা সমুচা অথবা মিনি চায়নিজ রেস্তোঁরা থেকে শরমা এনে দেওয়াও তারই কাজ। আরেকটি কাজ তার করতে হয় দুপুরে। লাঞ্চ শেষ করে বেল টিপলে স্যারের খাবারের প্লেট ধুয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে রাখা। ও হ্যাঁ, স্যারের নিষেধ আছে দুপুরে খাবারের পর যেন বিশ-ত্রিশ মিনিট কেউ তার রুমে না ঢোকে। স্যার নাক ডেকে হালকা ঘুম দেন, অলসতা কাটান, ন্যাপ নেন।

নাজমা বেগমের বেতন গেল বছর থেকে চৌদ্দ হাজারে উন্নীত হয়েছে, তাতে স্বামীর চাকুরি আর তিন সন্তানের সংসার চলে যাচ্ছে, মন্দ নয়। কিন্তু সম্প্রতি নাজমা বেগম তার জীবনে একটি বড় পরিবর্তন যোগ করে ঘরের সবাইকে অবাক করে দেয়। একদিন অফিস থেকে ফিরে স্বামীকে বলে-আমি কাল থেকে বোরকা পড়ব, হেজাব ধরব। ব্যবস্থা করো। স্বামী প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি বিষয়টি। যে মহিলাকে বলে বলে সাধারণ শালীনতায় ঢুকাতে পারেনি স্বামী, সে কি না বোরকা আর হিজাব পড়বে-অবিশ্বাস্য। স্বামী রহমত উল্লাহ অবাক হয়েই স্ত্রীর দিকে চোখ রেখে বলে-ফাজলামো করছো না কি সত্যি সত্যি।

-বললামতো বোরকা কিনতে বিকেলে যাব। আমার কছে টাকা নেই তবে বেতন পেলেই তোমাকে বোরকার টাকা শোধ করে দেবো।

রহমত উল্লাহ ভাবনায় পড়ে গেল। কোথাও কোনো সমস্যা বেঁধেছে মনে হলো। সে প্রশ্ন করে–অফিসে কোনো সমস্যা ?

-না কোনো সমস্যা নেই কোথাও। কেন মানুষ কি পরিবর্তন করতে পারে না নিজেকে? ও হা তুমিও নামাজ পড়বে পাঁচ ওয়াক্ত। এবার রহমত উল্লাহর বিস্ময়ের শেষ থাকে না। সে তো নামাজ পড়েই, শুধু মাঝে মাঝে তাও মাসে একবার বা দুবার ফজরের নামাজ বাদ পড়ে যায়। সেটির কারণও নাজমা ভালো জানে।

তো বোরকা আনা হলো, হিজাব পড়া হলো, অফিস চলছে যথারীতি। রহমত উল্লাহর অন্তরে এক নতুন কাঁটা প্রবেশ করে খোঁচাতে থাকে না জানি কদিন পর নাজমা বেগম হাত মোজা ও পায়ের মোজা কিনতে বলে। অবশ্য সেরকম কিছুই ঘটেনি। নীরবে সংসার করে যাচ্ছে সবাই। তিন সন্তানই বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাসে পড়ছে। নিজেরাই যেতে পারে ওরা, একসাথে বের হয় নিউ পল্টন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ওরা। নাইন সেভেন আর ছোটটি ফোর।

মাস দুয়েক হলো নাজমা বেগমের জীবনাচার বদলে গেল। ইদানীং সে তাহাজ্জুদ নামাজ ধরেছে। ফজরের অনেক আগেই ওঠে পড়ে। যে মানুষ ফজরের পর উঠত এবং মাঝে মাঝে রহমত উল্লাহ সকালের নাস্তা মুখে না দিয়েই বিদ্যালয়ে চলে যেত সেই নাজমা নিজের, স্বামী ও ছেলেদের নাস্তা সব ঠিকঠাক করে অফিসে বের হয়। সে খুব কম কথা বলে আজকাল। তবে তার ইবাদত বন্দেগির কারিশমায় এই যে পরিবর্তন তার প্রভাব পড়ে রহমত উল্লাহ ওপরও। এখন রহমত উল্লাহর কোনো ফজরের নামাজই বাদ পড়ে না। নাজমারতো বাদ পড়ার প্রশ্নই ওঠে না।

গেল দুবছর থেকেই ওদের সংসারের সংকট পাহাড়সম হয়ে যায় এই শহরে, তখন বাজারের তালিকা থেকে কেনাকাটার অনেক আইটেম বাদ পড়ে। অপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার বিষয়টি নাজমা নিজেই মনিটরিং করে ছোট করে দেয়। যখন বাজার খরচের কথা বলবে বা স্লিপে লিখবে কিছু তখন রহমত উল্লাহ খেয়াল করে স্ত্রী বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়াচাড়া করছে। হয়তো জিকির-আজকারে মশগুল থাকে।

কিন্তু নাজমা ঠিকই টের পায় যে বাজারে আগুন লেগে আছে। নিজের চৌদ্দ হাজার আর স্বামীর বেতন দিয়েও বাসাভাড়া সন্তানদের স্কুলের বেতন আর সংসার আগের মতো চলছে না। চলছে কোনো রকম ব্রয়লার মুরগীর মতো ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে অথবা মালামাল ভরা ভ্যান গাড়ির মতো ধীরে ধীরে। জীবন যেন রাজধানীর ট্রাফিক জ্যামের মতো, জ্যামে বসে থেকেই মোবাইলে দীর্ঘ কবিতা লেখা যায়, নাস্তা সেরে নেওয়া যায় বা শিশুকালের অনেক স্মৃতি রোমন্থন করা যায়। জীবন এখন খুব স্লো চারদিকেই।

নাজমা বেগমের নজরে বাজারের এই চড়া মূল্যের বিষয়টি আনলেও সে স্বামীকে বলে-ধৈর্য ধরো। আল্লাহ সব ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু রহমত উল্লাহ অধীর হয়ে বাজারে গেলেও অনেক দেরি করে ঘরে ফেরে কারণ সদাইপাতি যা কেনে তাতে নিজের ভেতর কোনো তৃপ্তি আসে না। তাই বাজারেই অস্থির হয়ে মাথা খাটাতে থাকে। সে এখন দেশি মুরগি না কিনে ব্রয়লার কেনে, গরুর মাংস না কিনে মাথা কেনে, খাসির মাংস না কিনে পায়া কেনে এবং হিসেব মেলাতে মেলাতে ঘেমে শেষ পর্যন্ত শোল বোয়াল রুই মাছ না নিয়ে তেলাপোয়া বা পাঙ্গাস মাছের দোকানে পায়চারি করে। অবশেষে ওই পাবদা বা তেলাপোয়া নিয়েই ঘরে ফেরে।

নাজমা বেগম তাতেও রাগ করে না, কোনো প্রকার অনুযোগও নেই তার। মাঝে মাঝে রহমত উল্লাহ ইচ্ছে করেই স্ত্রীর মেজাজ বুঝার চেষ্টা করে। সে ফ্যান ছেড়ে বসতে চাইলে নাজমা বলে–ওই জানালার কাছে বসো বাতাস আছেতো। রহমত উল্লাহ তাই করে। জানালার কাছে বসেই নাজমার দিকে তাকিয়ে বলবে–নাজমা তুমিতো এখন আওলিয়া হয়ে গেছো। সংসারতো চলছে না। কিছু বললেই বলো ধৈর্য ধরো আল্লাহ সব ব্যবস্থা করে দেবেন। সামনে যে বাচ্চাদের ভর্তি আর বাসাভাড়া বাড়বে তখন কী হবে ?

স্বামীর দিকে চেয়ে নাজমা বলে–একবার ভাবো দেশের কোটি কোটি মানুষ কত অসহায় জীবন চালাচ্ছে। কত মানুষের চাকুরি ব্যবসা নেই, কত মানুষের ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা নেই। আর আমরা দু‘জনই চাকুরি করছি। হয়তো বেতন অনেক কম। তবু যেভাবে চলছি তা কি আল্লাহ করে দিচ্ছেন না ?

আওলিয়ার একথার জবাব নেই রহমত উল্লাহর মুখে। সে বলে–আচ্চা হয়েছে হয়েছে, এবার আমাকে এককাপ চা দাও। ..চা হলো কিন্তু নাজমার জন্য চা আসেনি। –তোমার চা কোথায় ? জবাব এলো–আমি চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

রহমত উল্লাহ সত্যি এবার স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ল। তার মনে হলো যে মানসিক শক্তি সহনশীলতা ধৈর্য তার ভেতর জন্ম নিয়েছে, যে শক্তিতে ভর করে সংসার ধরে রেখেছে নাজমা, তা এই সংকটময় সময়ে সব ঘরেই প্রয়োজন। যে নারীটি এক সময় নিজের হাত খুলে চলেছে, যে বাজারে গিয়ে নিজের জন্য, স্বামীর জন্য এবং আত্বীয় স্বজনের জন্য অনেক কেনাকাটা করেছে, সেই নারীর এই পরিবর্তন তাকে অবাক না করে পারে না। আর তার পরিবর্তন তার আমল সত্যি প্রশংসা করার মতোই।

রহমত উল্লাহ মজা করেই স্ত্রীকে একদিন ‘আওলিয়া’ বলেছিল। কিন্তু এখন বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ সে দেখতে পাচ্ছে যে নাজমা বেগমের ভেতর সত্যি এক অন্যমাত্রার ধর্মীয়বোধ ঘটছে এবং যদিও ঘরে অভাব লেগেছে কিন্তু মনের ভেতর ভিন্ন এক প্রশান্তির শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে।

গত রাতে আওলিয়া চিংড়ি মাছ স্বপ্নে দেখেছে। চিংড়ি মাছ স্বপ্নে দেখলে নাকি অর্থের সন্ধান আসে। সে আজ ভোরে আরো দুরাকাত নফল নামাজ অতিরিক্ত আদায় করে। স্বামীকে বলে তার স্বপ্নের কথা। রহমত উল্লাহ অবাক হয়। কীভাবে আওলিয়ার এই স্বপ্ন সত্যি হলো! গতকালই রহমত উল্লাহ স্কুল থেকে দু‘বছর আগের খাতা দেখার একটি বিল পেয়েছে। তেরো হাজার চারশত আশি টাকা। কিন্তু এই অর্থপ্রাপ্তির সংবাদটি সে আওলিয়াকে এখনো বলেনি। সে শুধু আওলিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।