মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

আমাদের রবীন্দ্রনাথ

তানইয়া নাহার

১৩ মে, ২০২৩ , ১২:২৭ অপরাহ্ণ

আমাদের রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের শৈশবে ছিলেন ঘরের মানুষ হয়ে, দেয়ালের আপাদমস্তক ছবিতে। সুদৃশ্য কাঠের এক নৌকাযুক্ত ছবিটির কোণায় লেখা ছিল “অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।” আসা-যাওয়ার পথের ধারে এই লাইন দুটি পড়তে পড়তে আমরা ভাইবোনরা জেনে গেলাম তরণী বাওয়ার দৃশ্যও কত মনোমুগ্ধকর লাগে কারও কারও কাছে। আর ‘মধুর’ শব্দের আগে মন্দ যুক্ত হলে মন্দ আর মন্দ থাকে না, হয়ে যায় চমৎকার।

তিনি ছিলেন আমাদের বৈশাখী মেলায়, মাটির মূরতি ধরে। ফিরতেন আমাদেরই হাত ধরে আমাদের গ্রাম ও মফস্বলের প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে। এই তো, সেদিনও।

আমরা বানান শেখার আগেই রবীন্দ্রনাথ শিখেছি। জেনেছি “তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে!” অথবা, “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।”

আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেনার আগেই গেয়ে উঠেছি “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি”।

হেমন্ত, সাগর সেন, বন্যা, সাদী মোহাম্মদ, মিতা হক, চিন্ময়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য ও শ্যামল মিত্রগণ আমাদের ঘরে যখন তখন গেয়ে উঠতেন রবীন্দ্রসংগীত। আমরা রবিঠাকুরের গান শুনেছি প্রাত্যহিক অভ্যাসবশে, নাওয়াখাওয়ার মত সাধারণ নিয়মে।

আমরা (ভাইবোনরা) গল্পগুচ্ছ পড়ে ফেলেছি প্রাথমিকের গন্ডী পেরোনোর আগেই। আব্বার সাথে গল্প করেছি গল্পগুচ্ছের ঘাটের কথা, কাবুলিওয়ালা, গুপ্তধন, পোস্টমাস্টার, মুসলমানীর গল্প, সুভাষিণী, পণ, কঙ্কালসহ কত অসংখ্য গল্প নিয়ে!

‘সমাপ্তি’ পড়ে অপূর্ব-এর প্রেমে পড়ে গেছি তুলনামূলক কম বয়সেই। ‘লাইব্রেরি’ পড়তে গিয়ে শত বছর আগের মানুষদের আধুনিকতায় চমকিত হয়েছি। ‘নষ্টনীড়’-এর অচলার একাকীত্ব আমাকে ছুঁয়েছে বার বার, একান্ত কিছু ভাবনায়।

নৌকাডুবি, শেষের কবিতা, চোখের বালি, গোরা, চিরকুমার সভা আমি পেয়েছি আমার পড়ার টেবিলেই, বড় ভাইবোনদের বা আব্বা-আম্মার কল্যাণে। প্রতিযোগীতাহীন প্রতিযোগিতায় আমরা সেসব পড়েছি পাঠ্যবইয়ের সাথে সাথেই। গীতবিতান থেকে কত কত দিন পড়ার টেবিলে বসেই মিলিয়ে নিয়েছি ক্যাসেটের গান।

বড় বোন কোনদিন হয়তো গভীর মমতায় গেয়ে উঠেছে ” জেনেশুনে বিষ করেছি পান”। অজানা বেদনায় বেদনার্ত হয়েছি সেই সুর ও কথায়।

জোছনা রাতে উঠোনে বসে বসে আম্মা একের পর এক “তুই ফেলে এসেছিস কারে মন, মন রে আমার”, “গ্রামছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ”, “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে” গাওয়ার সময় কখনও কখনও রফিক ভাই (ফুপাতো ভাই) বা আমিও হয়তো গলা মিলিয়েছি অদ্ভুত কোন সম্মোহন বা মায়ায়।

ভাইয়া যখন ভাবীকে চিঠি লিখতো তখন ( প্রেম চলাকালীন সময়ে) আমার দায়িত্ব ছিল গভীর সব প্রেমপূর্ণ লাইন সঞ্চয়িতা থেকে কোট করে দেয়া। আর এই দিতে গিয়ে নিজেই যেন প্রেমে পড়ে গেছি অজানা-অচেনা কোন পথভোলা পথিকের। তারপর অকারণেই উদাস হয়ে থেকেছি কত না দুপুর-বিকেল!

হাইস্কুলে বান্ধবী পাতার বইয়ের মলাটে রবীন্দ্রনাথের কম বয়সী ছবি দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি! যেন আমি ধরেই নিয়েছিলাম দাড়ি ছাড়া বা কাঁচা দাড়ির রবীন্দ্রনাথ কখনও কোনদিন ছিলেন না ধরণীতে, হাহা।

এভাবে তাঁকে চিনতে চিনতে যতই বড় হয়েছি ততই মনে হয়েছে কিছুই যেন চেনা হয়নি! যে গানগুলোকে ছোটবেলায় প্রেমের ভেবেছি বড় হয়ে বুঝেছি সেসবে আছে আরও গভীর কোন নিবেদন, কেবল প্রেম বা পুজা নয়। যে গল্পকে ভেবেছি হাস্যরসের, পরে দেখেছি তার পরতে পরতে আসলে দুঃখগাঁথা, চেনাজানা গন্ডীর বাইরেও আরও অচেনা কোন বোধের কথামালা সেই সব। যে উপন্যাসকে ভেবেছি বিপ্লবের, পরে মনে হয়েছে সেটা হয়তো আসলে শ্রেণীবিভেদ বা বর্ণবাদবিষয়ক চিরকালীন বাস্তবতা।

এভাবে ধীরে ধীরে এমন সব সত্যও জেনেছি যে রবীন্দ্রনাথ মানে কেবল বিশ্বকবি, নোবেল বিজয়ী, বাঙালি মানসপটের ছবি, বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় নাম এসবই শুধু নয়! রবীন্দ্রনাথ বিস্তর সমালোচিত এক নামও! যাই হোক, চেষ্টা করেছি সেসব দেখেও না দেখার।

অমন যারা, তারা যে যা-ই বলুক, আমরা যারা জানার তারা তো জানিই, রবীন্দ্রনাথ আমাদের ঠিক কতখানি। আর তাই তো আমাদের প্রাত্যহিকতায় তথা সংগীতে, কবিতায়, গল্প- নাটক- উপন্যাসে এমনকি প্যারোডিতে, হালের মিমেতে মজার ছলেও আমরা তাঁকে এড়াতে পারি না কিছুতেই।