চীনে অনেক লোকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে, অনেকেই ইংরেজি জানেন, কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলবেন না। দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলবেন। আমরা নানকিং বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে যাই। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ইংরেজি জানেন, কিন্তু আমাদের অভ্যর্থনা করলেন চীনা ভাষায়। দোভাষী আমাদের বুঝাইয়া দিলো। দেখলাম তিনি মাঝে মাঝে এবং আস্তে আস্তে তাকে ঠিক করে দিচ্ছেন যেখানে ইংরেজি ভুল হচ্ছে। একেই বলে জাতীয়তাবোধ। একেই বলে দেশের ও মাতৃভাষার উপরে দরদ।
আমাদের সভা চললো, বক্তৃতা আর শেষ হয় না। এত বক্তৃতা দেওয়ার একটা কারণ ছিল। প্রত্যেক দিন সভায় যে আলোচনা হয় এবং যারা বক্তৃতা করেন। তাদের ফটো দিয়ে বুলেটিন বাহির হয়। এই লোভটা অনেকেই সংবরণ করতে পারেন নাই। ‘আর আমার বক্তৃতা দেওয়া ছিল এই জন্য যে, বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিব’।
যে হলে আমাদের সভা হয় তাহা বড় চমৎকার। কলকাতা কাউন্সিল হাউসের মতো, বুঝি একটু বড়ই হবে। একদিকে সভাপতিমণ্ডলীরা বসেছেন, আর সামনে ডেলিগেটরা বসেছেন। সভাপতিমণ্ডলীদের ঠিক পিছনে ৩৭টা দেশের পতাকা একইভাবে উড়ছে। হলের গেটেও ৩৭টা পতাকা লাগাইয়া দেওয়া হয়েছে। আমাদের পাকিস্তানের পতাকাটা খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সিল্কের কাপড় দিয়ে করা ভারতের ও আমাদের পতাকা পাশাপাশি। হলের ভিতর ফ্ল্যাশ লাইট মাঝে মাঝে জ্বলে ওঠে—যখন ফটো নেওয়া হয়। ১০/১৫ জন ফটোগ্রাফার অনবরত ফটো নিচ্ছে। পাশ দেখাইয়া হলে ঢুকতে হয়। পাশের রুমে চা খাবার বন্দোবস্ত আছে। দরকার হলেই যেয়ে খেতে পারেন। পিছনে ফুলের বাগান ও মাঠ রয়েছে, রয়েছে বসার জায়গা। যখন বিশ্রামের জন্য সভাপতি সময় দেন, তখন একে অন্যের পাশে বসে আলাপ করে ঐ ফুলের বাগানে যেয়ে।
সম্মেলন ১১ দিন চলে। সকাল বিকাল এইভাবে চলতে থাকে। অনেক দেশের প্রতিনিধির সাথে আলাপ হয়। অস্ট্রেলিয়ার এক প্রতিনিধি আমার সাথে আলাপ করতে করতে বললেন, “তোমার দেশের রাষ্ট্রদূতরা মনে করে দুনিয়ার মানুষ আহাম্মক!” আমি বললাম, “কেন এ কথা বলছেন?” তিনি উত্তর করলেন যে, “রাষ্ট্রদূত ও কর্মচারীরা যেভাবে থাকেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও সেভাবে থাকতে পারে না। অন্যান্য যে সকল দেশের জনগণের অবস্থা খুব ভালো, খায়ও অনেক এবং পরিমাণে বেশি—আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতরা যে অবস্থায় থাকে, তার চেয়েও অনেক ভালো অবস্থায় থাকে এবং যা-তা ভাবে অর্থ ব্যয় করে। আমাদের বোঝাতে চায় যে, তোমরা কত ভালো আছ। আমরা রাজনীতি করি, দেশ-বিদেশের খবর রাখি। তোমাদের দেশের মাথাপ্রতি আয় কত? দেশের লোক না খেয়ে মরে, কাপড় পর্যন্ত জোগাড় করতে পারে না। এ সব খবর আজ দুনিয়ার শিক্ষিত সমাজ ভালো করেই জানে। দেশের মানুষ না খেয়ে মরে আর সেই দেশের কর্মচারী অথবা রাষ্ট্রনায়করা যেভাবে বাজে খরচ করে তা ভাবলে আমাদেরও লজ্জা করে।” আপনারা বুঝতেই পারেন কী উত্তর আমি দিবো! হ্যাঁ-না করে কেটে পড়লাম। লজ্জা হয়। যারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায়, আমেরিকা অথবা গ্রেট ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতদের সাথে পাল্লা দিয়া খরচ করে—আর তাদের কাছে আবার ভিক্ষা চায়, “আমাদের সাহায্য দেও, আমাদের মিলিটারি সাহায্য দেও”—যা বলবা তাই শুনবো। তোমাদের অস্ত্র তোমাদের মত ছাড়া ব্যবহার করবো না। কাঁচামাল আছে তোমাদের দেবো। তারপর যাহা থাকবে অন্যকে দেবো। সেসব দেশের মানুষ আমাদের নেতাদের বাহাদুরি দেখলে হাসবে না কেন?
দক্ষিণ আমেরিকার একটা দেশের ডেলিগেটের সাথে আলাপ হলো। তিনি বললেন, পাকিস্তান কি একটা স্বাধীন দেশ না ভারতের একটা প্রদেশ? আমি আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম। ভাবলাম, বোধ হয় লোকটা দলে পড়ে এসেছে। রাজনীতি বা দুনিয়ার খবর খুব রাখে না। তবে এ কথাও মনে হলো, পাকিস্তান সম্বন্ধে দুনিয়ায় কোনো বিশেষ প্রোপাগান্ডা হয় নাই। এটার প্রমাণ আমি ঢাকায় পেয়েছি। এক বন্ধুর বাড়িতে যাই। তার শালা আমাকে একটা চিঠি দেখালো, আমেরিকার একজন স্কুল মাস্টার লিখেছেন, উপরে ঠিকানা লেখা ‘পাকিস্তান-ইন্ডিয়া’। এতেই বোঝা যায়, আমাদের দূতেরা কি প্রোপাগান্ডাই না করেছে বিদেশে পাকিস্তান সম্বন্ধে! দুনিয়ার মানুষ জানে আমাদের লোকসংখ্যা কত? আর বাজেট কত? মাথাপিছু গড় আয় কত? আমাদের দেশের গ্রামে একটা কথা আছে, ‘মিঞার বাড়ি খাবার নাই, বাহির বাড়ি বড় কাচারি’, দশা হয়েছে তাই।
তবে এই কনফারেন্সে যোগদান করে ৩৭টা দেশের প্রতিনিধিরা পাকিস্তান সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে গিয়েছে। কাশ্মীর যে ভারতবর্ষ জোর করে দখল করে রেখেছে এ খবরটাও ভালোভাবে জানতে পেরেছে। কারণ আমাদের দেশের প্রতিনিধিরা কোনো দেশের প্রতিনিধিদের চেয়ে বুদ্ধি, কথা ও বক্তৃতায় কম ছিল না। আনন্দের ভিতরই আমাদের কনফারেন্স শেষ হয়ে গেল।
কনফারেন্স যখন চলছিল মাঝে মাঝে আমরা বিখ্যাত জায়গা, বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি স্কুল, মসজিদ, শ্রমিকদের অবস্থা, কৃষি ব্যবস্থা দেখতে যেতাম। আমি তো প্রায়ই রিকশা একখানা নিয়া বেরিয়ে পড়তাম। পিকিং শহরে আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো। আমরা এক ক্লাসে ল’ পড়তাম। আমার সাথে পড়ার সময়ই খুব খাতির ছিল। বেচারি কাগজে আমার নাম দেখে আমাকে খুঁজতে এলো। কিন্তু আমাদের পায় নাই। সে যখন আসতো আমি তখন বাহিরে থাকতাম।
‘লিবারেশন ডে’-নয়াচীনের স্বাধীনতা দিবসে আমরা জনগণের মিছিল এবং সামরিক কুচকাওয়াজ দেখতে গিয়েছি। উপরে দাঁড়াইয়া আছি। হঠাৎ দেখি আমার মতো কালো আচকান, সাদা পায়জামা পরে সাথে একজন শাড়ি পরা মহিলাসহ এক ভদ্রলোক যাচ্ছেন। চেয়ে রইলাম, কে যায়? হঠাৎ দেখি মাহবুব ও তার স্ত্রী। মাহবুব পাকিস্তান দূতাবাসের থার্ড সেক্রেটারি। ও যে এ চাকরি কবে পেয়েছে, এ খবর আমার জানা ছিল না। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে, নাম ধরে ডাকতে শুরু করলাম।
তিন-চার ডাক দেওয়ার পর ওর স্ত্রী ওকে ধাক্কা মেরে আমাকে দেখিয়ে দিলো। ও আমাকে বললো, “বেলা ৪টায় তোর হোটেলে যাবো।” বিদেশে একটা বন্ধুকে পেয়ে বড় আনন্দ হলো। ঠিক চারটায় মাহবুব ও তার বিবি উপস্থিত হলো। আমাদের ওর বাসায় খেতে দাওয়াত করলো। আমি ওর স্ত্রীকে বললাম, আপনি যদি ঝাল দিয়া মাছ পাক করে খাওয়ান তবে এক্ষুণি আপনার বাসায় যাবো। উনি বললেন, আজ তো আর বাজারে মাছ পাওয়া যাবে না। আজ এমনি বেড়াইয়া আসুন, কাল খাওয়াব। আমি বললাম, ঠিক আছে চলুন। আমরা ওর বাসায় গেলাম। নাস্তা খেলাম, দেশের কথা বললাম। ওর স্ত্রী আমাদের খুব আদর-যত্ন করলেন। মনে হলো তিনি আমাদের পেয়ে হাতে চাঁদ পেয়েছেন। এর কারণ প্রায় দুই বৎসর ওরা দেশে যায় নাই। ওর স্ত্রী দেশের কথা জানতে পাগল হয়ে উঠলো। এ প্রশ্ন ও প্রশ্ন, ঢাকার অবস্থা কী? পরিবর্তন কিছু হয়েছে কি না? রাজনীতির সাথে তাদের সম্বন্ধ নাই। ঐ প্রশ্নই আমাদের করলো না। আমরা তাদের সাথে রাজনীতি আলোচনা করলাম না। সময় পেলেই আমরা ওদের ওখানে যেতাম।
পাকিস্তান ডেলিগেটদের একদিন আমাদের রাষ্ট্রদূত রাত্রে খাওয়ার দাওয়াত করলেন। আমরা সকলেই সেখানে গেলাম। পিকিংয়েও আমাদের নিজেদের জায়গা আছে। রাষ্ট্রদূত সকল কর্মচারীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। নিজেই আমাদের যত্ন করতে আরম্ভ করলেন: ‘আপনি এটা খান, ওটা খান সবই পাকিস্তানি খাবার তৈরি করেছি।’ খবর নিয়ে জানলাম, রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী নিজেই আমাদের জন্য পাক করেছেন। সকাল থেকে আর পাকের ঘর ছেড়ে বাইরে আসেন নাই। বোধ হয় দেশি মানুষ বহুদিন পান নাই, তাই আমাদের পেয়ে খুবই আনন্দিত হয়েছেন। আমাদের রাষ্ট্রদূতের নাম মেজর রেজা। পূর্বে মিলিটারিতে ছিলেন। লোকটাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগলো, কত অমায়িক ব্যবহার। বেশি আড়ম্বরের সাথে থাকে না, আর টাকাও বেশি খরচ করেন না বলে মনে হলো। লোকটার দেশের জন্য অত্যধিক দরদ—কথায় বুঝলাম। রাষ্ট্রদূত এই রকম লোক হলেই দেশের ইজ্জত বিদেশে বাড়ে। তাঁর সাথে আমাদের আলাপ হলো অনেকক্ষণ ধরে। নিজের বাড়িতে এসেছি মনে হলো, তাই উঠতে ইচ্ছা হয় না। রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত আমরা সেখানে রইলাম। পরে সবাইকেই গাড়িতে করে পাঠিয়ে দিলেন—আমরা যে হোটেলে থাকি সেই হোটেলে।
আমি ২/৩ দিন পরে আবার রিকশা নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতের অফিসে যাই। অফিসের সাথেই আবার মাহবুবের বাড়ি। অফিসে একজন ডিউটি অফিসার ছিলেন। ভদ্রলোক পাঞ্জাবি, খুবই অমায়িক ব্যবহার। অনেকক্ষণ পরে যখন মাহবুবের বাসায় এলাম, দেখলাম মাহবুব ও তার বিবি বেরিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সাথে আর একজন সেক্রেটারি আছেন। বেচারা মোটর থেকে নেমে আমাকে বললো, বেরিয়ে যাচ্ছি, বড়ই দুঃখিত, কাল এসো অথবা রাতে এসো। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো। আমি বললাম, মোটরের প্রয়োজন নাই। আমি একাই রিকশায় বেড়াই। দেখতে চাই কী অবস্থায় এদেশের লোক আছে। আর কীভাবে এরা বাস করে! কাল যদি সময় পাই তবে নিশ্চয়ই আসবো। এই বলে আমি বিদায় নিলাম।
[১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন নয়াচীন ভ্রমণে যান একটি সম্মেলনে অংশ নিতে। তাঁর সে সময়ের ভ্রমণের কাহিনি নিয়ে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থটি। আলোচ্য অংশটুকু সেই বই থেকে নেওয়া।]