পেন্সিল আমাদের যাপিত জীবনের একটি অপরিহার্য নাম। মানুষ বেঁচে থাকে তার জীবনকর্ম আর মৌলিক চাহিদা নিয়ে। সৃষ্টির সকল কিছুই যেমন তৈরি হয়ে আছে মানুষের জন্য, আবার তৈরিও হচ্ছে বিজ্ঞান চেতনার আলোকে। লিখতে চাইছি পেন্সিল নিয়ে দুয়েক লাইন। পেন্সিল বলতে আমরা সাধারণত লেখার কাজে ব্যবহৃত কাঠপেন্সিলকে সহজে বুঝি। কিন্তু না, নারীদের ব্যবহারের জন্য পরিচিত দু’প্রকারের পেন্সিল আমাদের সামনে দণ্ডায়মান। পেন্সিল স্কার্ট এবং পেন্সিল হিল। কাঠ পেন্সিলের অধিক গুরুত্ব থাকার কারণে শুরুটা করতে চাইছি কাঠপেন্সিল দিয়ে।
পেন্সিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বস্তুর নাম। আমাদের শিক্ষা জীবনে প্রথম লেখার উপকরণ হিসেবে পেন্সিলের ভূমিকা অপরিসীম। বাল্যকালে একজন মা তার সন্তানকে লেখার জন্য পেন্সিলের ব্যবহার শেখান প্রথমেই। অক্ষরজ্ঞানহীন একজন বাবা সারাদিন কাজ করে বাড়ি ফেরার সময় মনে করে সন্তনের জন্য পেন্সিল কিনে নিয়ে যান। আবার একজন গ্রামীণ নারী ফেরিওলার কাছে এক সের ধান বিক্রি করে হলেও পেন্সিল কিনে দিয়ে থাকেন সন্তানের পড়া-লেখার জন্য। সদ্য লিখতে থাকা সন্তান যেন সেই পেন্সিল দিয়ে লিখতে লিখতে একদিন অনেক বড় শিক্ষিত মানুষ হতে পারে।
সময়ের সাথে অনেক কিছু বদল হলেও পেন্সিলের পরিবর্তে আর কিছু আসেনি আমাদের হাতে। পূর্বে এবং পরে চক-শ্লেট ও ম্যাজিক শ্লেট থাকলেও কাঠপেন্সিলের আসনে আসীন হতে পারেনি আর কিছু। তবে এমন একটা সময় ছিল যখন বাঁশের কঞ্চি কলমের মতো কেটে কালির খালি দোয়াতে কাঠ পোড়ানো কয়লা গুড়া করে পানি দিয়ে গুলিয়ে কালি বানিয়ে তালপাতায় লিখত মানুষ।
শিশুদের লেখার পাশাপাশি এই পেন্সিল খেলনা হিসেবেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায় অনেক সময়। যেমন, পেন্সিলে কামড় বসানো, পেন্সিলের মাথায় লাগোয়া রাবারকে চকলেট মনে করে খাওয়া, আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল নিয়ে ঘুরানোসহ বিভিন্ন কসরতে খেলা করে থাকেন তারা। ছাত্রজীবনের শুরুতেই অর্থাৎ শৈশবে আমরা চকপেন্সিল দিয়ে শ্লেটে লেখার পর হাতেখড়ির অধ্যায় শেষ করে কাগজে পেন্সিল দিয়ে লেখার অধ্যায় শুরু করি। শৈশবে লেখার জন্য কলম হিসেবে কাঠের পেন্সিলের সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে মানুষের। কাঠপেন্সিল যে শুধু শৈশবে লেখার জন্য ব্যবহার হয় তা নয়। খাতায় রুল করা, ছবি আঁকা, হিসেবের কাজে ব্যবহার করা, অডিটে ব্যবহার ইত্যাদি।
অনেক কাজেই কাঠপেন্সিলের একটি বিশেষ গুণ রয়েছে যেমন, কাঠপেন্সিল দিয়ে লেখা যে কোনা অক্ষর শব্দ বা বাক্য লেখার পর ভুল হলে তা রাবার দিয়ে মুছে ফেলা যায়। কিন্তু কলম দিয়ে তা সম্ভব নয়। আর এই বিশেষ গুণটির কারণে শৈশবে লেখা শেখাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করার জন্য কাঠপেন্সিল সমাদৃত হয়ে আসছে।
আজ থেকে পায় পাঁচ’শ বছর আগে মানুষ সর্বপ্রথম পেন্সিল তৈরি করতে শেখে, তবে সেগুলো আজকালের পেন্সিলের মতো ছিল না। একটি গ্রাফাইট খণ্ডকে সরু কতগুলো টুকরা করে তা দিয়ে লেখার কাজ চালাত তখনকার মানুষ। এভাবে অনেক দিন চালানোর পর গ্রাফাইট কেটে আরও চিকন করে তার উপর নরম কাঠের আবরণ দিয়ে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
বর্তমান আমরা যে পেন্সিল দিয়ে লিখি তা আসে খনিজ পদার্থ থেকে। কাঠপেন্সিলের কাঠের মাঝখানে যে শিস থাকে তা একপ্রকার খনিজ দ্রব্য থেকে তৈরি, যার নাম ‘গ্রাফাইট’। গ্রাফাইট একটি মৌল পদার্থ। কয়লা বা কাঠকয়লা আংগারের একটি বিশিষ্ট শ্রেণি। আংগার দুই বা ততোধিক প্রকারের থাকতে পারে। হীরা ও গ্রাফাইট আংগারের প্রকারভেদ, গ্রাফাইট হীরার মতো উজ্জ্বল নয়। গ্রাফাইটের রং ধূসর বর্ণের আর হীরার রং উজ্জ্বল। গ্রাফাইট সব দেশেই পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি গ্রাফাইট পাওয়া যায় সিংহলে। সেই গ্রাফাইট দিয়ে তৈরি হয় কাঠপেন্সিল।
সবচে মজার কথা হলো- গ্রাফাইটকে আগেকার মানুষ মনে করতো সিসা। তাই গ্রাফাইট দিয়ে তৈরি পেন্সিলকে লেড পেন্সিল বলা হতো। পেন্সিল ছাড়াও গ্রাফাইট নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই কৃত্রিম উপায়ে গ্রাফাইট তৈরি করতে হয়। ১৮৯৬ সালে ‘এ্যাডওয়ার্ড এ কেশন’ নামের পেন্সিলভানিয়ার একজন বৈজ্ঞানিক এই গ্রাফাইট তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এতে সহজ উপায়ে গ্রাফাইট পাওয়া যায় এবং তা দিয়ে মানুষের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয়েছে। কৃত্রিম উপায়ে গ্রাফাইট তৈরি করতে মাত্র তিনটি দ্রব্যের প্রয়োজন হয়- বিচূর্ণ কোক, বালু এবং কাঠের গুড়া। এসব দ্রব্য একসঙ্গে মিশিয়ে বিদ্যুৎ চুলায় প্রায় চার হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে উত্তপ্ত করণে বিশুদ্ধ গ্রাফাইট তৈরি হয়। এখন আর গ্রাফাইট কেটে কাঠপেন্সিল তৈরি হয় না। কাঠের মধ্যে যে শিস থাকে তা শুধু গ্রাফাইট নয়, গ্রাফাইকে ভালো করে গুঁড়া করে নিয়ে এর সঙ্গে পরিমাণমতো কাদামাটি মিশিয়ে ছোট ছোট ছাঁচের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। এসব ছাঁচে সরু সরু লম্বা দণ্ড তৈরি হয়, যাকে আমরা পেন্সিলের শিস বলে থাকি। গ্রাফাইটের গুড়ার সাথে কাদামাটির পরিমাণ কমিয়ে অথবা বাড়িয়ে নরম বা শক্ত উভয় প্রকার শিস তৈরি করা হয়ে থাকে। নরম শিস তৈরি করতে হলে গ্রাফাইটের গুড়ার সঙ্গে অল্প পরিমাণ কাদামাটি মেশাতে হয় এবং পরিমাণমতো উত্তাপ দিতে হয়। আর শক্ত শিস তৈরি করতে হলে কাদামাটি ও উত্তাপ দুই-ই বাড়াতে হয়। পেন্সিল তৈরির এই গ্রাফাইটটি সিংহল ছাড়াও সাইবেরিয়া, আমেরিকা ও ইতালিতে পাওয়া যায়। গ্রাফাইটকে কাঠপেন্সিলের উপযুক্ত শিস তৈরি করে সরু কাঠের দন্ডের মধ্যে প্রবেশ করালে তৈরি হয় কাঠপেন্সিল।
দোকান থেকে আমারা অনেকেই ‘এইচ বি’ লেখা পেন্সিল কিনে থাকি, কিন্তু এইচ বি এসেছে ইউরোপ থেকে। ইউরোপে পেন্সিলের ব্যবসা যখন শুরু হয় তখন তাতে এইচ বি লেখা হতো। ইংরেজি অক্ষর ‘এইচ’ হলো ‘ইউনেস’ এর জন্য। এইচ বি হলো ‘ব্ল্যাকনেস’ এর জন্য। অর্থাৎ এইচ বি লেখা কোনো শিস যেটি হলো গ্রাফাইট শক্ত এবং তার রং হয় কালো। নম্বরের প্রশ্নে- গ্রাফাইটের শিস বা কোর কতটা শক্ত তা নির্ধারণ করে এই নাম্বার দিয়ে। ২, ৩, ৪ এই ধরণের সংখ্যাগুলি বোঝায় পেন্সিলের কোর শিস কতটা শক্ত। নাম্বার যত বেশি কোর তত বেশি শক্ত এবং লেখা হয় হালকা। পেন্সিল সম্পর্কে আর একটি তথ্য হলো- আমেরিকায় বানানো বেশিরভাগ পেন্সিলের আবরণের রং হলুদ। এই প্রথা শুরু হয় অষ্ট্রিয়া- হাঙ্গেরিয়ান কোম্পানি এল এন্ড সি আর্ডমুল তাদের সবচে দামি কোহিনুর ব্রান্ডের পেন্সিল বাজারে ছাড়ার পর। সে সময় কোহিনুর ছাড়া অন্যান্য পেন্সিলের রং ছিল হলুদ। পরবর্তীতে অন্যান্য পেন্সিল উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো কোহিনুরের দেখাদেখি একইভাবে তাদের পেন্সিলসহ হলুদ রঙে বাজারজাত করে।
রং মানুষের দর্শন সংক্রান্ত একটি চিরন্তন ধর্ম। আলোর বর্ণালি থেকে রঙের উৎপত্তি লাভ করে। বিভিন্ন কারণে মানুষের কাছে রং এর পার্থক্য হয়ে থাকে। সাধারণত বলা হয়ে থাকে মৌলিক রং তিনটি, যথাক্রমে লাল, সবুজ ও নীল। বিভিন্ন ড্রইং বা লেখার ক্ষেত্রে পেন্সিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
এবার পেন্সিলের নামে ভিন্ন পরিচয়। ক্লাসিক ফ্যাশনেবল পোশাক হিসেবে গণ্য করা হয় পেন্সিল স্কার্টকে, পশ্চিমা নারীদের ওয়ারড্রবে থাকা একটি অসাধারণ পোশাকের নাম পেন্সিলস্কার্ট। এটি আঁটোসাটো হওয়ায় চলাচলের সুবিধা হতে পারে বিবেচনা করে সাধারণত এই স্কার্টটির পেছনের দিকে মাঝ বরাবর সামান্য একটু অংশ চিরে দেওয়া থাকে। আবার কিছু ক্ষেত্রে চিরে দেওয়ার বদলে কিছু অংশ ভাঁজ করে দেওয়া হয়। যা আরও বেশি মার্জিত। এই ভাঁজ করার ফলে ভাঁজকৃত অংশ চাহিদা মতো প্রসারিত হয়ে সব বয়সী নারীদের চলাচলে সুবিধা সৃষ্টি করে।
পেন্সিল হিলের প্রসঙ্গ এলে বলা যায় আধুনিক মেয়েরা বা ফ্যাশন সচেতন মেয়েরা হিল পরে না এটা ভাবা যায়! আমি মনে করি না। হালের ফ্যাশন জগতে পেন্সিল হিল তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে। অধিকাংশ মেয়ে বিভিন্ন পার্টি কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানে পেন্সিল হিলকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। পেন্সিল হিল পরলে মেয়েদের যেমন আবেদনময়ী দেখায় তেমনি তারা নিজেরাও স্বাচ্ছন্দ্য মনে করেন। পেন্সিল হিলের কারণে পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ একটু বেশিই হয় তাদের দিকে। তবে পেন্সিল হিলের একটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে- পেন্সিল হিল বিড়ম্বনায় পড়ে অনেক মেয়ে হাঁটতে গিয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে পায়ের বল্টু পর্যন্ত নড়েচড়ে যায়গা বদল করে বসেছে। আবার বিভিন্ন পার্টিতে দেখা গেছে পেন্সিল হিল পরে দুলিয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ উল্টে পড়ে মাটির সাথে মিশে যায় এবং সেখানে হিপের রসিকতায় পার্টি বর্জন করে বিরস মুখে ফিরে যেতে হয়েছে অনেক নারীকে।
পেন্সিল হিল, যা মার্কিন ইংরেজিতে ‘স্পাইক হিল’ নামে পরিচিত একটি চিকন হিলের জুতা। ১৯৩০ এর দশকের শুরুর দিকে এই ধরনের জুতাকে নির্দেশ করতে ‘স্টিলেটোমা ড্যগার’- অর্থাৎ ছুরির সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
এ ছাড়াও রং পেন্সিল নামে ২০১২ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হূমায়ন আহমেদ এর কিছু প্রবন্ধ নিয়ে সংকলিত গ্রন্থের নাম রং পেন্সিল।
তথ্য সহায়ক: ইউকিপিডিয়া।