মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

ছায়া রোদ 

কামরুন নাহার রেনু

২০ মে, ২০২৩ , ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ ;

ছায়া রোদ 

ঝিম লেগে বসে আছে প্রীতম। সারাটা বিকেল নিস্তব্ধ কেটেছে আজ। চৈত্রের তপ্ত রোদেও যেন মেঘের ঘনঘটা তার পৃথিবী জুড়ে। গতকাল বৃষ্টি হয়েছিল, বাসার সামনে মাঠটায় পানি থই-থই করছে। অথচ অন্য সময় ঠিকই মেয়েকে নিয়ে কাগজের নৌকা বানিয়ে  চলে যেত মাঠে, নৌকা পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে বলত—দেখ, কী সুন্দর পানির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে!  চল আমরা আজ সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়াব, আজ আমাদের জলের সাথে সন্ধি। মেয়ের হাত ধরে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে চলা, কখনো মেয়ের ঝপাত—ঝপাত লাফে পানির নিত্যে হেসেই কুটি-কুটি। তারপর বাড়ি ফেরার সময় হলে বলত— আজ চল বাড়ি ফিরে অনেকগুলো নৌকা বানিয়ে জমিয়ে রাখব, আবার যখন বৃষ্টি হবে তখনি আমরা নৌকা ভাসাব মাঠে।

মেয়ে পূর্ণ বাবার কথায় চোখ মেলে তাকায় মাঠটার দিকে, নতুন কোনো কল্পনা বুকে নিয়ে বাবার নোখ ধরে পা বাড়ায় বাড়ির উদ্দেশ্যে।

এমনি অনেক বরষা কেটেছে তাদের বরষার গান শুনে। জলের মাঠে আনন্দের আলপনা এঁকে।

বারান্দায় গ্রিলের ফাঁক বেয়ে আসা আকাশটাকে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায়, নিঃসঙ্গ বিকেলের ঝরে পড়া পাতার মতো বুক থেকে ঝরে পড়ে কল্পনার ধারাপাত। জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো এক—এক করে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকে কুচকাওয়াজে হেঁটে যাওয়া সারিবদ্ধ মানুষের মতো।

গতকাল ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফিরেছে প্রীতম। দীর্ঘদিন  ক্লিনিকের বেডে শুয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেছে প্রতিনিয়ত।

স্ত্রী নিতার চঞ্চলতা, জগৎ ভুলানো হাসি সব কিছুর মাঝে একটা দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন চলে আসে নিজের অজান্তেই, প্রীতম বিষয়টা অনুভব করে, আর তখনই তার অনুভূতির শিকড়ে পচন ধরে। নিজের অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল।

জীবনের ধারাপাতে নামতার ঘরে কোথায় যেন একটা সংখ্যা বাদ পড়ে যায়, তাই সব হিসেব এলোমেলো হয়ে যায়।

কল্পিত জীবনে—হঠাৎ এমন অপ্রত্যাশিত অসুস্থ হয়ে যাওয়া কেমন যেন এলোমেলো করে দিলো সব!  

সব কিছুই যেন চোখের সম্মুখে জ্বলজ্বল করে উঠে প্রীতমের.  .. 

প্রতিদিনের মতোই অফিসের কাজে ব্যস্ত প্রীতম, কন্যার রুটিন মাফিক স্কুল, স্ত্রীর গৃহকর্মে ব্যস্ততা। আফিস শেষে বিকেলে ঘুরতে বেরুবে আজ। মেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে, স্ত্রী গৃহ কর্ম সেরে অপেক্ষা. ..  কিন্তু আজ একটু ভিন্ন বিষয় লক্ষ করছে নীতা।  

প্রতিদিন প্রীতম অসংখ্যবার মেয়ের বাড়ি ফেরা, দুপুরের খাওয়া ইত্যাদি সব বিষয়ে খোঁজ নেয় অসংখ্যবার। অথচ আজ সব কিছুর মাঝেই একটা গ্যাপ। নীতা ভাবে, হয়তো অফিসে কাজের চাপ বেশি তাই খোঁজ নিচ্ছে না।

হঠাৎ একটা ফোন আসে নীতার নাম্বারে! নীতা হিসাব মিলাতে পারে না, মেয়েকে নিয়ে ছুটে যায় ক্লিনিকে। অবচেতন ভাবে শুয়ে আছে প্রীতম। কারণ জানতে চায় নীতা। ডাক্তার জানায়, ব্রেন স্টোক করেছে। রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে, বলা—মুশকিল কি হবে।

নীতি কিছুতেই মানতে পারে না, অবচেতন মুখটার দিকে তাকিয়ে হাজার কথা জানতে চায় কোনো উত্তর পায় না।

সারারাত গড়িয়ে ভোর হয় চোখের পাতা ভার হয়ে আসে, শুধুই অপেক্ষা—প্রীতম চোখ মেলে তাকাবে, মেয়েকে কাছে টেনে বলবে, মাগো বাবার বুকে মাথা রাখো। বাবার জন্য কেঁদে—কেঁদে চোখগুলো কেমন ফুলিয়ে রেখেছো। এইতো, কালই বাড়ি যাব— আমরা। এবার কিন্তু তুমি আমার একটা ছবি আঁকবে, বাবা বুড়ো হলে কেমন হবে সেই ছবি। এমনি হাজারো কল্পনা ভিড় করে নীতার রাত জাগা চোখে। শুধুই অপেক্ষা, এমনি করে কেটে যায় আরো পাঁচটি রাত। প্রীতমের অবস্থা একটু উন্নতির দিকে। একটু মিট-মিট করে তাকায়। নীতার বুকে আশার প্রদীপ জ্বলে। স্বামীর মাথায় হাত বুলায়। হাত দুটো টেনে মুখে লাগায়, প্রীতমের উষ্ণতায় যেনো পৃথিবীটা রঙিন হয়ে উঠে। পরম মমতায় চুলের ভাঁজে বিলি কাটে পৃথিবীর  সবটুকু সুখ অফুরন্ত মনে  হয়।  

দিন গড়াতে থাকে, কেটে যায় আরো পনেরোটি দিন। এখন প্রীতম কথা বলছে, কিন্তু আরো কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা বাকি।

কাল ডাক্তার চেকআপ শেষে রিপোর্ট দিবে, তার পর বাড়ি ফেরা।

নীতার কল্পনার পৃথিবী যেন তার আঙিনায় লুটোপুটি খায়। কল্পনার ডানায় ভর করে  ভেসে বেড়ায় পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। এখন শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা. .. 

রাত গড়িয়ে দিন হয়, রিপোর্টগুলো ডাক্তারের হাতে। কেন যেন ডাক্তারের চোখে কোনো সন্তুষ্টির ছাপ খুঁজে পায় না। জানতে চায় নীতা, সব ঠিক আছে তো?  ডাক্তার জানায়— প্রীতমের বাঁ হাত বাঁ পা প্যারালাইসিস্ট হয়ে গেছে।

পৃথিবীটাকে বিবর্ণ মনে হয় নীতার কাছে। স্বপ্নগুলো যেন টুকরো কাঁচের মতো ভেঙে— ভেঙে পড়ে চোখের সম্মুখে। চোখের কোণ বেয়ে কখন পানি গড়িয়ে পড়ে নিজেই জানে না। আজ তাদের বাড়ি ফেরার পালা। বাড়ি ফিরে আসে প্রীতমকে নিয়ে।

নিজের এই অস্বাভাবিক জীবন মেনে নিতে পারে না প্রিতম। কষ্টে তার চোখ বেয়ে পানি গড়াতে থাকে। নীতা প্রীতমের চোখ মুছে দেয়।

প্রীতম নীতাকে বলে, আমায় ক্রাচটা দিবে? একটু বারান্দায় যাব, কতদিন আকাশ দেখি না।

নীতা প্রীতমের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, প্রীতমের হাতটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বলে, ক্রাচের কী দরকার আমার কাঁধে হাত রাখো.  … 

Latest posts by কামরুন নাহার রেনু (see all)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *