মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

জন্মদিন

রেজাউল ইসলাম হাসু

১৫ জুলাই, ২০২৩ , ১১:৫২ অপরাহ্ণ

জন্মদিন - রেজাউল ইসলাম হাসু

I’m Nobody! Who are you?

Are youNobodytoo?

Emily Dickinson

পাশের ফ্ল্যাটে কারো জন্মদিন উৎসবের গান বাজছে।

মনে মনে আমি তাকে আমন্ত্রণ ছাড়াই উইশ করবার পরিকল্পনা করি। এমনকি এক মিনিটের ভেতর করেও ফেলি! বিড়বিড় করে বলি, শুভ জন্মদিন হে অপরিচিত অথবা অপরিচিতা। যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে নিজের আলাপচারিতা এক ধরনের।

কেকের ঘ্রাণ সেই ফ্ল্যাট থেকে মৌমাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছে। কেক খেতে আমার ছয় বছরের বাচ্চাছেলেটা ভয়ানক ভালোবাসে। সেও কেকের ঘ্রাণ পেয়ে হাওয়াই প্লেনের মতো সেই ফ্ল্যাটে ছুটে গেল। এমনভাবে ছুটে গেল যেন সে আগে থেকেই আমন্ত্রিত ছিল। কিছুক্ষণ পর স্ত্রীর কাছে শোনলাম আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। শহর ভেবে আশ্চর্যফুল হয়ে অবাক কোনো পাপড়ি ঝরালাম না, না কোনো ঘ্রাণ।

দুপুরটা ক্রমশ দম হারিয়ে ফেলছে।

আমরা একটা অনারোগ্য করিডরের রেলিং ধরে হাঁটছি। বিগত সন্ধ্যায় দুটো রজনিগন্ধা জন্মেছে পুরোনো টবে। টবটা ব্যালকনির দক্ষিণে দারুণ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘদিগন্ত ভেঙে ছায়াবৃষ্টির ঝমর। গুচ্ছ ছায়াডানায় উড়ে আসছে বিপুল বিকেল। বিকেলের থোকা থোকা ঠান্ডা বাতাস আমাদের আরো হিম করে দিচ্ছে। কেবল জোড়া রজনিগন্ধা বিষাদগ্রস্ত ব্যালকনিটা উন্মুখ করে তুলেছে গন্ধে-ছন্দে-গীতে।

রজনিগন্ধার গন্ধে তলিয়ে যাচ্ছি আমি। সংখ্যাধিক স্মৃতির কয়েন ঝনঝনিয়ে ওঠে বুকপকেটে। হুট করে সেই চাচাজানের কথা মনে পড়ল। তিনি থাকলে আমার জন্মদিনটাও হেসে উঠত শিশুদের খুশির মতো। দশ বছর ধরে মন খারাপ করে থাকত না অন্ধ বালক হয়ে। আমি রজনিগন্ধা দুটোর দিকে চেয়ে থাকি আর চাচাজানের ঝাপসা স্মৃতিগহনে হারাতে থাকি। আমার স্ত্রী ও বাচ্চারা উনাকে চেনে না। উনি অতীত ভালোবাসতেন। অতীতের প্রেমে পড়ে কোনো একদিন বর্তমান থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে উনি বাড়ি ফেরার পথ ভুলে যান। সেই থেকে আমরা পথ চেয়ে থাকি তার জন্য। আমার ধারণা, ভবিষ্যতে উনাকে নিশ্চয় আগের মতো ফিরে পাব। আর উনাকে ফিরে পেলেই জানা যাবে অনেকের আহত অতীত।

ক্যালেন্ডারের পাতা উলটালেই নভেম্বর।

নভেম্বর এলে মনে হয় কোনো এক লোকাল ট্রেন চলে এলো জীবনে। চড়লে আর পথ ফুরোতে চায় না। তবু জীবনকে তুলে দিতে হয়। ঝিকঝিক ঝিকঝিক করেই ডিসেম্বরের নাগাল পাওয়া। ডিসেম্বর আসন্ন। রহস্যের মোড়কে মোড়ানো এ এক দীর্ঘ দহনগাথা। ডিসেম্বর এলেই চাচাজানের মলিন মুখম-ল উজ্জ¦ল হয়ে উঠত। উদ্যমী হয়ে পড়ত তার ষাটোর্ধ্ব শরীর। কোনো ক্লান্তি, ক্লেদ তাকে এতটুকুও হারাতে পারত না। কলোনির সকলকে আমন্ত্রণ জানাত। বনফুল মিষ্টির দোকান থেকে অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসত বিশাল কেক। খাসির বিরিয়ানি, জর্দা পোলাও, মুরগির রোস্ট, দই, মিষ্টি, ফলফলাদিসহ মদও রাখা হতো অভ্যাগতদের আপ্যায়নের জন্য। চেনা-অচেনা লোকজনে ফ্ল্যাট ভরে যেত। কদর্য কোলাহলে সেদিনের সন্ধ্যাটা গমগম করত। ঠিক যেন খেলা চলাকালীন মিরপুর স্টেডিয়াম এক।

আমি মুখম-লে একটা সৌজন্যভাব প্রসাধনের মতো মেখে রাখতাম। আর একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নিশ্চুপ বসে থাকতাম। আমার সমবয়েসি ছেলেমেয়েরা আমাকে ঘিরে নাচ-গানে মত্ত থাকত। আমার এসব খুব যে একটা ভালো লাগত সেটা একদম মিথ্যে বলা হবে। একটা ক্লাউন হাসি ঠোঁটে ফ্যাশন হাউসের রেডিমেড থ্রি-পিসের মতো ঝুলিয়ে রাখতাম ওই সময়টুকু। যাতে আমার ভেতরে কী চলছে সেটা কেউ বুঝতে না পারে। অথচ আমি চাইতাম গির্জায় গিয়ে আমার জন্য কেউ আয়ু প্রার্থনা করুক। যা কিছু মঙ্গলজনক, তার সবকিছু আমার জন্য চেয়ে নিক। আর কয়েক ফোঁটা চোখের হিমজলে ঈশ^রের পা ধুয়ে দিক—যিনি আমাকে এভাবে পাঠিয়েছেন।

আমার স্ত্রী ও বাচ্চারা মিলে আমার জন্মদিন কবে জানতে চাইলে ভেতর-বাইর জুড়ে শিশিরের মতো নিস্তব্ধতা নেমে আসে। বোবা ও মূর্খদের মতো নিজেকে প্রদর্শন করি। তারা আমাকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারে না। আর তাদের সবসময় এভাবেই  বিশ্বাস  করাতে চাইছিলাম। তারা আমার পুরোনো কাগজপত্রাদির ট্রাঙ্ক হাতড়াতে থাকে। পুরোনো বইপত্র রাখা বুকসেলফটা এলোমেলো করে ফেলে। দরকারি দলিল-দস্তাবেজ রাখা ফাইলগুলোও হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে।

কোনো একদিন এলোমেলো কাগজের স্তূপ থেকে তারা আমার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সনদপত্রগুলো উদ্ধার করে। এবং সেখান থেকে আমার জন্মতারিখ জানতে পেরে পরস্পর উল্লাসে উপচে পড়ে। যেন বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ^কাপ জয় করেছে। ঠিক করে আসন্ন ডিসেম্বরে খুব আড়ম্বরতায় আমার জন্মদিন পালনের। আমি তাদের না করতে গিয়েও পারি না। কে যেন আমার জিহ্বায় শৃঙ্খল পরিয়ে রেখেছে। এবং তখনও আমি আমার অতীত অন্বেষণ করছি একাকিত্বের ইশতেহারে।

আস্তে আস্তে পৌরাণিক সন্ধ্যাটা প্রগাঢ় হচ্ছে।

প্রেতাত্মাদের মতো রাত্রি গড়িয়ে আসছে শহরে। দূরে কিছু ঝাড়বাতি দপদপ জ¦লছে আর নিভছে। ওয়াচম্যানের বাঁশি ইসরাফিলের শৃঙ্গারে শয্যা ভাঙছে। কিছু পথকুকুর জেগে আছে না-পাওয়া মানুষদের মতো। দূরনক্ষত্রের উদ্দেশ্যে একটা রকেট শাঁ করে ছাদের উপর দিয়ে উড়ে যায়। রকেটের শব্দ হলে আমার জন্মতারিখ মনে থাকে না। কালকে মায়ের জন্মদিন। শয্যার বালিশে বিলি কাটতে কাটতে স্ত্রী মনে করিয়ে দেয়। মোবাইলটা কাচের টেবিল থেকে তুলে মেসেঞ্জারে শাশুড়ি-মাকে অগ্রিম উইশ করে রাখি। শুভ জন্মদিন মা। আপনার জীবন হোক গোলাপের, গৌরবের। তারপর পাশ ফিরলেই স্ত্রীর তলপেটে জন্মদাগটা চোখে পড়ে। আমি সেখানে একটা আলতো চুমু বসিয়ে দিই মাছের মতো। ও প্রজাপতির মতো নড়ে ওঠে। দ্রুতগতিতে তার নাসারন্দ্র ফুলতে থাকে। নরকের দরজা খুলে যায়। আমরা সেই দরজা দিয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করি। শরীর জুড়ে কালবৈশাখী ঝড়। উড়তে থাকে আমাদের নরম ডানা ও ডুমরু। একসময় ধপ করে পড়ে গেলে একগুচ্ছ মুখস্থ সকাল নিয়ে যে যার মতো দৌড়াতে থাকি।

অফিসে পা রাখতেই মেহেলি আবদার নিয়ে আসে নাবালিকার মতো। স্যার, নিমন্ত্রণ না করলেও যাব। আমি বাচ্চাদের মতো থ মেরে তার কথা শুনি। তারপর বলি, কিসের নিমন্ত্রণ যে না করলেও যাবে? মেহেলি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট লগইন করে আমাকে একটা পোস্ট দেখায়। পোস্টে আমার মতো একজন ভদ্র মহোদয়ের ছবি। ছবির ক্যাপশনে লেখা আছে : আসছে ডিসেম্বরে আমার জন্মদিন। জানি এটা আমার কাজ নয়। হয়তো আমার স্ত্রী ও বাচ্চারা মিলে এই মজাটা করেছে। আমি বুঝেও না বোঝার ভান করি। চুপচাপ অফিসরুমে ঢুকে পড়ি। এক নয়, দুই নয়, তিন চার গ্লাস পানি পান করি ইতরের মতো। তারপর আরাম কেদারায় বসে আমার অতীত ভাবি। কে আমি?

চাচাজান এক বৃদ্ধের গল্প করতেন। গল্পে কখনো তার নামটা নিতেন না। কেন নিতেন না? চিনে ফেলব এই জন্য! নাকি এর পেছনে রয়েছে আরো অজ¯্র আহত অতীত? আজও এসবের উত্তর উদ্্ঘাটনের কসরত করছি।

বৃদ্ধ না কি মানুষের অতীত বলতে পারতেন!

মাঝে-মধ্যে উনাকে অজ্ঞাত মোড়ে দেখা যেত। নীলক্ষেত পেরোলে পুলিশ চেকপোস্ট। চেকপোস্টের ভেতরে হাঁটলেই একটা সাপ-সদৃশ চিকন গলি। গলি ধরে আরো এক-পা দু-পা করে এগুলেই সেই মোড়। মোড়ের দু’পাশে সিটি কর্পোরেশনের ময়লাস্তূপ। সেই স্তূপের পাশেই উনাকে যোগাসনে ধ্যানমগ্ন দেখা যেত। লোকজন বলতেন, উনি জীবিত ও মৃতদের অতীত জানেন। একবার দেখা গেলে এক বছর তাকে আর দেখা যায় না। আবার এক বছর পর দেখা গেলে পরের পাঁচ বছর একেবারেই লা-পাত্তা হয়ে যেতেন। কোথায় যেতেন? তাও কেউ বলতে পারে না। চাচাজানের গল্পেও এই একই ব্যাপারগুলো ঘটত। আমরা অপার আগ্রহের সঙ্গে উনার গল্প শুনতাম।

আমি তাকে পাঁচ বছর ধরে খুঁজছি।

ইতোমধ্যে পাঁচটি জন্মদিন হেসে-খেলে চলে গেছে আমার। এবং পাঁচবারই আমার ভেতর আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করবার কসরত করেছি আড়ালে-অন্দরে। কে আমি? ষষ্ঠ জন্মদিন আসন্ন প্রায়। স্ত্রী ও বাচ্চারা অগ্রিম পরিকল্পনা করে রেখেছে সেই দিনটা ঘিরে। গতকাল জন্মদিনের কেকের অর্ডার দিতে গেলে অচেনা দোকানদার বাবার নাম জিজ্ঞেস করেছিল। কার্তিক মাসের প্রথম সন্ধ্যা ছিল সেটা। স্ট্রিটে থোকা থোকা হিমহাওয়া এসে মেয়েদের এলোচুলে ধাক্কা খাচ্ছিল। অথচ আমি জঘন্যভাবে ঘামছিলাম। উত্তর না পেয়ে দোকানদার কী ভাবতে পারে সেটা আমার অনুমেয় ছিল। নিরুত্তর থাকা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না।

সেই কেকের দোকান থেকে মাথা নিচু করে বের হই। যেন আমার আবার জন্ম হচ্ছে এই শহরে। আমি মায়ের জরায়ুর ভেতর থেকে মাথাটা পৃথিবীর মাটিতে রাখছি নিচু করে। মার্কেটটা ছিল ছয়তলা। সুসজ্জিত। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। লিফটের ভেতরটা ছিল তাকিয়ে থাকার মতো অদ্ভুত সুন্দর। অথচ আমাকে বীভৎস দেখাচ্ছিল। লিফটের আয়নায় তারই আবছায়া দেখে শীতেই ঘামছিলাম। আর ভুলে যাচ্ছিলাম শপিং তালিকায় থাকা দোকান ও দ্রব্যের নামসমূহ। ছয়তলা থেকে লিফট ছ’বার নেমেছে এবং উঠেছে। আমি টেরই পাইনি। এবারও টের পেতাম না যদি কোনো এক অচেনা ভদ্র মহোদয় আমার জুতাপরিহিত পা পাড়িয়ে লিফটে না উঠতেন। হঠাৎ করে শক পাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হলে আমি সম্বিত ফিরে পাই। দুই সংখ্যার বাটনে আবার চাপ দিই। সংখ্যাটা লাল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন লাল চোখওয়ালা চাচাজানের সেই গল্পের বৃদ্ধ। যাকে কোনোদিন দেখিনি। যার সঙ্গে দেখা করা খুব জরুরি। দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে মার্কেটটাকে মন থেকে মুছে ফেলতে চাইছিলাম।

গল্পের বৃদ্ধকে কোথায় পাব?

একটা রিকশায় উঠি। নীলক্ষেতে এসে নামি। সামনে পুলিশ চেকপোস্ট। চেকপোস্টের ভেতর হাঁটলেই সাপ-সদৃশ সেই চিকন গলি। গলিতে এক-পা দুপা করে পা বাড়াই। একটা সুনসান মোড় উপচে পড়ে শরীরের উপর। চারদিকে ময়লাস্তূপ। বিদ্্ঘুটে বাতাসের বয়ান বহমান। এটা সেই অজ্ঞাত মোড়। চাচাজানের গল্পের বর্ণনা মিলে গেলে নিশ্চিত হই। ইতিউতি তাকাই। সেই বৃদ্ধকে খুঁজি। না, কোথাও অমন লোককে দেখি না।

দূরআকাশে উড়ছে একটা একাকী চিল।

একে ওকে জিজ্ঞেস করি। প্রথমে কেউ বলতে পারে না। আমি ঘামতে থাকি। অচেনা কেকের দোকানির ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নটা ঘামতে থাকে। এমতাবস্থায় ময়লার স্তূপ থেকে নবজাতকের কান্না কানে এসে বাজে করুণ বিউগেলের মতো। আমি হাতের সবকিছু ফেলে সেই কান্নার কাছে ছুটে যাই। যেন একটা নিরীহ পৃথিবী ডুকরে কাঁদছে। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। তারপর কোলে তুলে নিই। তার গলায় ঝোলানো একটা রুপার লকেট। লকেটে মোড়ানো ছোট্ট এক চিঠি। চিঠিতে দুঃখিনী বর্ণমালায় লেখা আছে :

দুঃখিত বাবা, আমি তোমাকে শুভ জন্মদিন বলতে পারলাম না…